Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাজার করার হাজার কৌশল


১৯ আগস্ট ২০১৮ ১৩:০৮

শরীফ শহীদুল্লাহ্ ।।

খাবনামায় লেখা থাকে, ‘স্বপ্নে কী দেখিলে কী হয়’, আর আমার মস্তিস্ক নামের হার্ডডিস্কে বাজার করার হাজারখানেক কৌশল আপলোড করে একটি ‘কৌশল সমগ্র’ প্রণয়ন করেছি, যার উদ্দেশ্য হলো-কোন কৌশলে কী কেনা যায়। এই কৌশলের কিছু বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা, কিছু ঠেকে শেখা-কিছু ঠকে শেখা এবং বাকিটা স্বউদ্ভাবিত। গরু যেমন অবসরে চর্বিত-চর্বণ করে, তেমনি আমি অফিসের কাজের অবসরে গতকালের কিংবা গত পরশুর বাজারের ভুলভ্রান্তি মনে করে তা শোধরানোসহ নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করি। সব সময় একটাই ভাবনা, বাজার করে গিন্নির চোখই যদি না ভরাতে পারি, তবে আর এত পরিশ্রম করে কী লাভ? মানুষের জীবনের বিভিন্ন ধরণের লক্ষ্য থাকতে পারে, তবে আমার লক্ষ্য একটাই-সফল ক্রেতা হওয়া!

বিজ্ঞাপন

জ্ঞানীরা বলেন, বাজার করে রাজার আস্থাভাজন হওয়া গেলেও গিন্নির মন জয় করা কঠিন। তাই গিন্নির নামে শিন্নি মানত করে অন্যসকল কর্তাকূলের মতোই প্রতিনিয়ত বাজারে হাজিরা দিই, গিন্নি খুশি তো জগত খুশি! কিন্তু গিন্নির ঝাড়ির কথা মাথায় রেখে বাড়ির দরজায় ভয়ে ভয়ে হাজির হতেই গিন্নির মুখস্থ ঝাড়ি,‘ কী এনেছো? এসব মানুষ কেনে?’ মানুষ কিনুক আর ছাগলেই কিনুক, গৃহ দরজায় বাজার এসেছে, বাজার-সদাই ঘরে না ঢোকালে কী আর চলে? গিন্নির হাত ধরে বাজারের ব্যাগ ঘরে ঢোকে। আর পেছনে পেছনে অর্থাৎ বাজারের ব্যাগের উছিলায় আমি ঘরে ঢোকার উপায় খুঁজি। উপায় মেলেও, যেন বাজারের ব্যাগ আর আমার জনম-জনমের দোস্তি- দু’জন ধরাধরি করে ঘরে ঢুকি!

বিজ্ঞাপন

তবে তরি-তরকারির সৌভাগ্যই বটে, ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে গিন্নীর নরম হাতের স্পর্শ কপালে জোটে। গরম দামে কেনা মাছ তরকারির কপালে জোটে শীতলতা, নরমাল ও ডীপে স্থান হয় তাদের। আর আমার ঘাড়ে পড়ে গিন্নির গরম নিঃশ্বাস! মাঝে মাঝে ভাবি, আহা! মাছ-তরকারি হতে পারলে অন্তত কিছুটা সময় ফ্রিজে অবস্থান করে শীতল হতে পারতাম। এ জনমে যেহেতু হলো না, মনে মনে পণ করি-পরজনমে সুযোগ থাকলে বিধাতার কাছে তরকারি হয়ে পুনর্জন্মের আবদার করব!

বাজার করতে গিয়ে ঠেকা ও ঠকা থেকে বেশ কিছু জ্ঞানও রপ্ত হয়েছে আমার। যেমন, যারা খুব সকালে তাজা গো-মাংস কিনতে যান তারা মুলত গো-ধরাটাই খান। অতি ভোরে জবাই করা গরুর তাজা রক্ত আগের দিনের মাংসে লাগিয়ে টানানো হয়, আর সকাল সকাল আসা ক্রেতাদের আদর করে সেগুলোই আগে-ভাগে দেওয়া হয়। খাসির মাংসে জবাই করার পরপরই গলার দিকটা উচু করে পানি ঢালা হয়, তাতে ওজন বাড়ে। পরিচিত কাষ্টমারকে দেশি মুরগি দেওয়ার কথা বলে মুরগি হাতে তুলে দোকানি মুরগির পশ্চাৎদেশে ফু দিয়ে কী যেন টেষ্ট করেন, কিন্তু বাস্তবে হাড্ডিপাকা মুরগিটাই উচ্চমূল্য পরিশোধের পর হাতবদল হয়। আগের দিনের মাছটা ডিপে ঢুকিয়ে ভালো করে শক্ত করে বাজারের প্রথম ক্রেতাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তাজা চিংড়ির সঙ্গে পঁচা-গলা চিংড়ি মিক্স করা হয়, খুব তলিয়ে না দেখলে ধরাই যায় না। আপেল কমলার বেলায় পঁচা ফলগুলো বিক্রেতা তার কাছাকাছি রাখেন। ফলে ক্রেতা বেছে বেছে চারটা দিলে দোকান দেখে দেখে নিশ্চিত হয়ে পচন ধরা পাঁচটি দেয়।

ইচ্ছে করলে ‘বাজার করার হাজার কৌশল’ নামে বই লিখে ফেলতেও পারি অনায়াসে। কিন্তু লিখি না, পাছে তরিতরকারির মতো ওটাও যদি গিন্নির অপছন্দ হয়! সমস্যা কমানো বুদ্ধিমানের কাজ, আমিও অন্তত এই একটা জায়গায় বুদ্ধির পরিচয় দেখাতে সক্ষম হয়েছি-ওই বইখানা এখনও লিখতে শুরু করিনি।

সেদিন দেখে দেখে পাঁচ কেজি গোলআলু নিয়ে সাহস করে ঘরে ঢুকলাম,‘দেখো, বাজারের সেরা গোলআলু নিয়ে এসেছি।’ গিন্নি ব্যাগ থেকে আলু বের করতে গেলেন আর আমি গেলাম চেঞ্জ হতে। কেবল জামাটা খুলেছি, ঠিক সেই মুহুর্তে ঘর্মাক্ত ভুড়ির ওপর তিনটা লম্বাটে আলু এসে পড়ল, আলু তো নয় যেন মোস্তাফিজের কাটার, ‘এগুলোকে গোল আলু বলে? আজ পর্যন্ত গোলআলুও চিনলা না?’

বন্ধুরা আমাকে গোলআলু বলে ডাকে। ‘রতনে রতন চেনে’ এই বাণী-চিরন্তণী মোতাবেক আমার গোলআলু ভালো চেনার কথা, বাস্তবেও অন্যদের চেয়ে আলু ভালো চিনি। কিন্তু অগ্নিশর্মা গিন্নির সাফ কথা, ‘গোলআলুর আকার লম্বা হবে কেন?’ অতঃপর গিন্নি বিড়বিড় করতে করতে বিরক্তি প্রকাশ করলেন, ‘নিজে একটা আলু অথচ আলু চেনে না।’ আমি সুযোগ পেলাম, ‘এই যে আমাকে আলু বললে তার মানে তোমার কথায়ই প্রমাণ হচ্ছে, আলু লম্বাও হয়।’
‘তার মানে?’
‘আমার প্রস্থের চেয়ে আমার দৈর্ঘ্য বেশি। অর্থাৎ আমি লম্বা আলু।’ কিন্তু গিন্নি জলজ্যন্ত গোল আলুকে গুরুত্ব দেন না, তার সকল প্রেম ভূ-গর্ভে জন্ম নেওয়া গোলআলুতে। তিনি বলেন, ‘আলুর আকার গোল বলেই আলুর উদ্ভাবকরা এটাকে গোলআলু নাম দিয়েছে।’
‘সব আলু তো আর গোল হয় না,’ আমি যুক্তি খোজার চেষ্টা করি, ‘স্কুলে যখন বাচ্চাদের পৃথিবীর আকার পড়ানো হয়, তখন তো গোলাকারই বলা হয়, বাস্তবে কী পৃথিবী পুরোপুরি গোল? পৃথিবীর আকার হলো কমলালেবুর মতো।’
‘এত লম্বা-গোলের ইতিহাস আমাকে বোঝানোর দরকার নেই’, গিন্নী প্রসঙ্গ বদলান, ‘এরপর থেকে আমি বাজারে যাব।’ বিনাবাক্য ব্যয়ে গিন্নির কথায় সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলাম।

সেদিন রাতে খাবার টেবিলে দেখি মলা মাছের চচ্চড়ি। খেতে খেতে বললাম, ‘বাহ! দারুন হয়েছে? তা কতটুকু কিনলে?’ ‘বেশ সস্তা! বিশ হালি মলা কিনেছি পাঁচশ টাকায়, হালি মাত্র পঁচিশ টাকা’। হাসি এলেও হাসলাম না, হাসি পেটে চাপতে গিয়ে আমার পেটটা দুইবার ফুলে উঠল, কিন্তু একটি দাঁতও আলোর মুখ দেখেনি। আমি জানি, দাঁত বের হয়ে গেলে নতুন কেনা কাচের লবনদানিটা অথবা পানি খাওয়ার গ্লাসটা আমার দাঁতের দিকে ছুটে আসা বিচিত্র কিছু হবে না, সেই ভেবে হাসলাম না। অবশ্য আমার দাঁতের চেয়ে ঘরের তৈজসপত্রের গুরুত্ব আমার কাছে বেশি, সেটাও না হাসার অন্যতম কারণ!

গেল শুক্রবার গিন্নির নির্দেশ এল তার সঙ্গে বাজারে যেতে হবে। গিন্নির মতে, বাজার করা সোজা, তবে বাজারের ব্যাগ টানা সমস্যা। এই সমস্যা যে এতদিন আমারও ছিল সেটা আর বললাম না বা বলার সাহসই হয়নি।
প্রথমেই পাকা কলার দোকান পড়ল। গিন্নি দাম জানতে চাইলেন, ‘সাগর কলার কেজি কত?’ দোকানদার স্ত্রীর উদ্ভাবনী ক্ষমতায় অবাক হলেন। তবে মূলক্রেতার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাগ বাহকের দিকে তাচ্ছিল্যের চোখে তাকালেন। দোকানদারের ভাবখানা এমন যে, ‘শালা, এতদিনেও বউকে শেখাতে পারোনি যে, কোনটা কোন পরিমাপে বাজারে কেনা-বেচা হয়?’
মনে মনে বললাম, কই যাও গোপাল সঙ্গে যায় কপাল…।

সারাবাংলা/পিএম

বাজার করার হাজার কৌশল রম্যগল্প শরীফ শহীদুল্লাহ

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর