Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বামী কেন আসামি!


১৯ আগস্ট ২০১৮ ১৯:০৩

খায়রুল বাবুই ।।

ঘটনা ভয়াবহর চেয়েও কিঞ্চিৎ বেশি জটিল। পুলিশ অফিসার সদরুদ্দিন খুবই শান্ত স্বভাবের মানুষ। শামুকের মতো। উপরে শক্ত, ভেতরে কোমলমতি! চোর ধরলে চিমটি কাটেন। ডাকাত ধরলে বড়জোর কান মলে দেন। ছিনতাইকারীর জন্য বরাদ্দ কাতুকুতু। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি বরাদ্দ ইভটিজারদের জন্য। নিজের পোষা ছাগল দিয়ে ইভটিজারের দুই গাল চাটিয়ে দেন।

এ রকম নিরীহ, নির্বিবাদী, নির্ভেজাল এবং সরল মানুষটিকে চুপ থাকতে দেখে সিতারা বেগম কইয়ের তেলে কই ভাজতে গিয়েও থমকালেন। রান্নাঘর থেকে হালকা ধমকের সুরে বললেন, ‘কী হলো আপনার টুম্পার বাপ? ভং ধরে আছেন কেন?’
টুম্পার বাপ ওরফে সদরুদ্দিন এগার ফুট দূরত্বে, বেতের চেয়ারে বসা। দু’চোখ হালকা লাল। দাঁত কিড়মিড় করছেন।
‘শাস্তি ভাবছি। তোমার কাছে কোনো বুদ্ধি আছে?’
‘মাইরের ওপর দাওয়াই নাই।’ চুলার আঁচ কমিয়ে খুন্তি হাতে স্বামীর সামনে দাঁড়ান সিতারা বেগম, ‘দুই গালে কষিয়ে চারটা থাপ্পর দিলেই সুইয়ের মতো সোজা আর ফোমের মতো নরম হয়ে যাবে।’
আগুনের কাছ থেকে ছুটে আসা স্ত্রীর অগ্নিমূর্তি দেখে আঁতকে ওঠেন সদরুদ্দিন, ‘এটা কী বলো টুম্পার মা! জীবনে আমি কাউকে চড়-থাপ্পর মারি নি। নিজের মেয়েকে…’
‘হুঁ। লাই দিয়ে মানুষ মানুষকে মাথায় তোলে। আপনি তাকে তুলছেন আসমানে। এখন কিভাবে নামাবেন আপনি জানেন।’
সদরুদ্দিন চুপসে যান। ছুটির দিনের সকাল। কোথায় একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠবেন, তা না। সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে বসার বদলে বসেছেন বিচারকের চেয়ারে। আসামী তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একমাত্র কন্যা টুম্পা!
গত কয়েক মাস ধরে মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। নানা কারণ দেখিয়ে টুম্পা সবাইকে বাদ দিয়েছে। আজ ঘুম থেকে উঠেই সিতারা বেগমকে টুম্পা জানিয়েছে, সে একটা ছেলেকে পছন্দ করে। ফেইসবুকে পরিচয়। মেসেঞ্জারে ভাব বিনিময়।
মেয়ের কথা শুনে সকাল সকাল চুলা জ্বালানোর বদলে সিতারা বেগমের মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। স্বামীকে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

টুম্পা বসে আছে সদরুদ্দিনের মুখোমুখি। নির্ভার। স্বাভাবিক। দুই হাতে মোবাইল টিপছে।
‘টুম্পা, শোন মা,’ সদরুদ্দিন কোমল গলায় বলেন, ‘ছেলে নিজে পছন্দ করেছিস ভালো কথা। তাই বলে লোকাল কাউকে পেলি না? একেবারে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিকমানের ছেলেকেই পছন্দ করতে হবে? কিভাবে তোর বিয়ে দেব বল তো?’
মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলল টুম্পা, ‘কেন বাবা? সমস্যা কী?’
সদরুদ্দিন অসহায়ের মতো বলেন, ‘আমার তো বিমানে উঠতেই ভয় করে? বমি বমি লাগে।’
‘রাখো তোমার বিমান।’ খেকিয়ে ওঠেন সিতারা বেগম, ‘আমরা বিমানে উঠব কেন? ওই ছেলের চৌদ্দগোষ্ঠী আসবে। আমরা যেতে পারব না।’
লাফিয়ে ওঠে টুম্পা, ‘মা, তার মানে তোমরা রাজি? ইয়াহু…’
‘কী বেয়াদব মেয়ে রে বাবা!’ বিস্ময়ে হাত থেকে খুন্তি পড়ে যায় সিতারা বেগমের। চোখ বড় বড় করে বলেন, ‘শোন, আমার যখন বিয়ের কথা-বার্তা হচ্ছিল তখন লজ্জায় মুখ থেকে কথাই বের হয়নি। মুরব্বিরা কথা বলেছে, আমি শুধু একবার ডানপন্থী, আরেকবার বামপন্থী, মাঝে মাঝে উপর-নিচপন্থী সেজে বসে ছিলাম।’
সদরুদ্দিন অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান, ‘ডানপন্থী-বামপন্থী আর উপর-নিচপন্থী মানে?’
‘মানে মুরব্বিদের কোনো কথায় ডানে-বামে মাথা নাড়িয়েছে, বেশিরভাগ কথায়ই সম্মতি দিয়ে মাথাটাকে উপর-নিচ করেছি। শোনোনি, বাঙালি নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।’
‘মা, যুগ পাল্টেছে। তোমাদের আমলে ফেইসবুক ছিল? ইউটিউব ছিল? মোবাইল ফোন এতটা অ্যাভেইলঅ্যাবল ছিল?’
সিতারা বেগম ডানপন্থী-বামপন্থী স্টাইলে মাথা নাড়ান।
টুম্পা উৎফুল্ল হয়ে বলে, ‘তাহলেই বোঝো, মানুষ দিন দিন কতটা আগাচ্ছে…।’
সদরুদ্দিন বলেন, ‘আচ্ছা, আগে ছবি দেখি ছেলেটার। আছে না?’
টুম্পা ইতস্তত হাতে মোবাইল এগিয়ে দেয় বাবার দিকে। সিতারা বেগম উঁকি দেন মোবাইলের স্ক্রিনে। দুজনের চেহারায়ই সন্তুষ্টির হাসি।
সদরুদ্দিন গম্ভীর মুখে বলেন, ‘ছেলে কী করে?’
‘বাবা, ও মডেল…’
‘মডেল?’ আঁতকে ওঠেন সিতারা বেগম, ‘না না, এইসব মডেল-ফডেল আমার মেয়ে জামাই হতে পারবে না।’
‘মা, ও মডেল না, ফটোগ্রাফি করে। মডেল-ফটোগ্রাফার।’
‘ও মাগো, এইটা তো আরও ভয়ঙ্কর। মাইয়াগো লগে ওঠা-বসা। এইসব ফেসবুক-টেইসবুক কে আবিস্কার করছে? তারে যদি একবার হাতের কাছে পাইতাম…’
‘ ফেসবুকের আবিস্কারকরে দিয়ে তোমার কি দরকার মা!

বিজ্ঞাপন

‘ফেসবুক আবিষ্কারের বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। কোথায় যেন পড়েছিলাম।
‘বলিস কি?’ সদরুদ্দিন লাফিয়ে ওঠেন, ‘বিষয়টা ইন্টারেস্টিং তো।’
‘থামোতো তুমি,’ সিতারা বেগম স্বামীর ওপর বিরক্ত হন, ‘আমরা আলোচনায় বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি।’
‘ও হ্যাঁ, তাই তো।’ বলে রাগী চোখে মেয়ের দিকে তাকান সদরুদ্দিন, ‘টুম্পা, তোকে নিজেই সঙ্গী পছন্দ করতে হবে? আমরা আছি কী করতে?’
‘বাবা, তোমরাও কিন্তু নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছ।’
মেয়ের কথা শুনে হালকা লজ্জা পান সদরুদ্দিন। আমতা আমতা করে বলেন, ‘আরে, আমি তো সিলেট থেকে বরিশাল গিয়েছিলাম। আর তুই? বর্ডার ক্রস করতে চাইছিস?’
অনেক বছর পর স্বামীর কথায় সায় দিলেন সিতারা বেগম, ‘হুঁ, তুই ওই ছেলেকে ভুলে যা মা। না হলে আমার মরা মুখ…’
‘থামো তো মা। বাংলা সিনেমার নায়িকার মায়েদের মতো কথা বোলো না।’ একটু থেমে টুম্পা বলল, ‘রুপম বাংলাদেশেরই ছেলে। খাঁটি ঢাকাইয়া। ঢাকার পোলা ভেরি ভেরি স্মার্ট…!’
‘কিন্তু তুই যে বললি সে আসামি। আসাম থাকে!’
‘না বাবা, সে ঢাকা থেকে অনার্স শেষ করে আসামের একটা ইউনিভার্সিটিতে ফটোগ্রাফির ওপর কোর্স করতে গেছে।’ মুচকি হাসল টুম্পা, ‘আমি আসলে তোমাদের একটু ভড়কে দিতে চেয়েছিলাম।’
এতক্ষণে সিতারা বেগমের মুখ উজ্জল হয়ে ওঠে। হাসিমুখে বলেন, ‘তাও ভালো। আমি তো কোনোভাবেই একটা আসামিকে মেয়েজামাই হিসেবে মেনে নিতে পারতাম না।’
‘ছেলেটা আসামি না হলেও স্বামী হওয়ার পর সংসারে আসামী হয়েই থাকতে হবে।’ সদরুদ্দিন বিড়বিড় করেন।
‘কী বললে তুমি?’ খেঁকিয়ে ওঠেন সিতারা বেগম।
‘তেমন কিছু না।’ বিব্রত ভঙ্গিতে হাসেন সদরুদ্দিন, ‘আমার হবু-মেয়েজামাইয়ের জন্য অন্তর থেকে সহমর্মিতা জানিয়ে রাখলাম।’
‘বাবা, শব্দটা সহমর্মিতা হবে না। হবে শুভকামনা।’ টুম্পা শুধরে দেয়।
‘হুঁ, বিয়েটা হোক, তার পরই ওই আসামি স্যরি ঢাকাইয়া পোলা বুঝবে, স্বামী কেন হয় আসামী!’
‘অ্যাই, তুমি কি আমার হবু-মেয়েজামাইকে নিয়ে মশকরা করছ?’ ভ্রু কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকান সিতারা বেগম। উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন সদরুদ্দিন, ঠিক তখনই ‘ম্যা-অ্যাঅ্যা…’ ডাক শোনা গেল।
সিতারা বেগম বিরক্ত হয়ে তাকান স্বামী সদরুদ্দিনের দিকে। সদরুদ্দিন তাকান বারান্দার দরজার দিকে। সেখানেই রয়েছে ছাগলটা। একমাত্র কন্যা টুম্পার ‘স্বামী হতে চাওয়া আসামি’কে ইভটিজার ক্যাটাগরিতে ফেলে পোষা ছাগলটাকে দিয়ে গাল চাটিয়ে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী কোনো ফন্দি আঁটছেন কি না, সদরুদ্দিনের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল না।

সারাবাংলা/পিএম

খায়রুল বাবুই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর