Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একটি আম কাঠের চৌকি


২০ আগস্ট ২০১৮ ১১:১৯

সুমন্ত আসলাম ।।

থমকে দাঁড়াই আমি। চমকে যায় আমার ভেতরটাও। এতো দিন পর! এতো দিন পর চোখে পড়ল জিনিসটা। অথচ ভুলে গিয়েছিলাম। কী অবলীলায় হারিয়ে গিয়েছিল আমার মন থেকে।
লোপা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল একটু। থমকানোর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল সেও। আলতো ঘুরে তাকাল। পেছনে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল ভ্রু কুঁচকিয়ে। তার আগেই হাত ইশারা করলাম আমি। কাছে এলো ও।
‘দাঁড়ালে কেন!’ অসহিষ্ণু গলা লোপার।
‘একটি জিনিস দেখছি।’
‘কী দেখছো!’ আশপাশটা দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় লোপা, ‘মাটির পটারি, পুরনো বই, নার্সারির গাছ-।’ লোপা আরো একটু ডান পাশে তাকায়, ‘টিয়া পাখি নিয়ে একজন জ্যেতিষিকেও দেখছি।’
‘এসব দেখছি না আমি।’
‘তাহলে?’ অসহিষ্ণুতা বেড়ে যায় লোপার।
পাশ ফিরে লোপার চোখের দিকে তাকাই আমি। ভ্রু স্থির করে তাকিয়ে আছে ও আমার দিকে। সায়েন্স ল্যাবের ফুটপাতে শত শত মানুষ। নিউ মার্কেট পেরিয়ে ব্যস্ত সবাই। নাগরিক যন্ত্রণায় কেমন ক্লান্ত মুখ সবার।
কাঁধে হাত রাখি আমি লোপার। বায়িং হাউজের সাদা লম্বা দেয়ালের দিকে নিয়ে যাই ওকে। জায়গাটা একটু নিরিবিলি। ওর হাতের বড় শপিং ব্যাগটা নিজের হাতে নেই। মুখটা হাসি হাসি করে বলি, ‘পাঁচ মিনিট সময় দেবে আমাকে?’
গলাটা কি একটু কেঁপে উঠল আমার? খুব দুঃখী দুঃখী শোনাল কথাটা? লোপার চোখ দুটো হঠাৎ ছলছলিয়ে উঠল কেন তাহলে? শঙ্খের মতো সাদা একটা হাত রাখল ও আমার বাম কানের নিচে, চিবুকের একটু উপরে। গলার পাশটা ছুঁতে ছুঁতে মুচকি একটা হাসি দিল ও। প্রশ্রয়ের হাসি, আশ্রয়েরও, ‘দিলাম।’
‘লঞ্চ চেনো তুমি?’
‘নাম শুনেছি, দেখিনি কখনো।’
‘অনেকটা জাহাজের মতো, কিন্তু ছোট। ছোট মানে অনেক ছোট।’ ওর হাতটা আমি নিজের মুঠোয় নেই, ‘যমুনা ব্রিজ হওয়ার আগে যমুনা নদীতে চলত ওগুলো।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কী একটা কথা প্রসঙ্গে এর আগে ওগুলোর কথা বলেছো তুমি।’ বেশ উৎফুল্ল দেখায় লোপাকে।
‘নিজ শহর ছেড়ে এই শহরে আসার প্রথমেই ওই যমুনা। শ্মশান ঘাট পেরিয়ে, জেলখানার পাশ ঘেঁষে, খালি পায়ে থাকা ঘাটের মেয়েদের চঞ্চল চোখ এড়িয়ে, বাঁশের টুকরিতে জেলেদের লাফানো ছোট ছোট মাছ দেখতে দেখতে লঞ্চে উঠতে হতো আমাদের।’
‘একবার তুমি লঞ্চে উঠতে ছিলে, লঞ্চ ছেড়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। লাফ দাও তুমি। কিন্তু কাঁধের ব্যাগটা পড়ে যায় পানিতে।’
‘ওই ব্যাগে তেমন কিছু ছিল না। কয়েকটা চিতই পিঠা বানিয়ে দিয়েছিল মা। আট ঘণ্টার জার্নিতে রাস্তায় খেতে বলেছিল। ব্যাগটার জন্য তেমন মায়া লাগেনি, কেবল ওই পিঠার জন্য। মায়ের হাতে পিঠা! সেই ফজরের নামাজ পড়ে বানাতে বসতেন।’
‘প্রসঙ্গ এলেই তুমি এই কথাটা প্রায়ই বলো। চোখ ছলছল হয়ে ওঠে তোমার তখন।’ লোপা হাসতে হাসতে বলে, ‘সংক্রমিত হয়ে আমারও।’
‘তুমি যদি দেখতে, যদি দেখাতে পারতাম তোমাকে! মা কী যে যত্ন করে পিঠা বানাতেন!’ গলাটা কেমন বুজে আসে আমার। লোপা আবার আমার কানের পাশে হাত রাখে। আমি ওর ওই হাতে হাত রেখে বলি, ‘লঞ্চগুলো এতো নিচু ছিল।’
‘তুমি ছিলে লম্বা।’
‘কেবিনে আঠারটা সিট ছিল। সিট ছিল মানে কাঠের বেঞ্চের মতো আর কী। প্রতিজনের ভাড়া ছয় টাকা। বাইরে খোলা জায়গাটায় কেউ চাদর বিছিয়ে বসতেন, কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেন। ওখানে প্রতিজনের ভাড়া ছিল চার টাকা। আমি অধিকাংশ সময় বাইরেই থাকতাম।’
‘এবং খুব মজা করে লঞ্চের মুড়ি বানানো খেতে।’
‘সত্যি কী মজা ছিল ওই মুড়িগুলোতে!’
‘একবার ওই মুড়িতে একটা পোকা পেয়েছিলে।’ লোপা হাসতে থাকে আবার, ‘আমি কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। ভাতে ছোট একটা পাথর থাকলে সেটা তোমার প্লেটে যায়, তরকারিতে কোনো চুল থাকলে সেটাও তোমার পাতে পড়ে, গ্লাসের পানিতে ছোট্ট ভাসমান কিছু থাকলে সেটাও তোমার ভাগ্যে থাকে।’
হাসলে লোপার বাঁ গালে টোল পড়ে। ওর প্রতি আমার প্রথম মুগ্ধতা। আমি সেই টোল দেখতে দেখতে বলি, ‘জানো, এপারের ঘাটে এসে আমরা যে বাসে উঠতাম, সেগুলোকে বলা হতো মুড়ির টিন।’
‘কেন!’
‘একেবারে ভাঙাচোরা দেখাত বাসগুলো। কিন্তু মুড়ির টিন কেন বলা হতো, তা জানি না।’
‘তাহলে তো খুব বোরিং জার্নি ছিল।’
‘খুব। প্রায় আটঘণ্টা লেগে যেত ঢাকায় পৌঁছতে।’ লোপার দিকে হাত বাড়িয়েই ওটা ফিরে আনি আবার। নাগরিক বিহ্বলতায় গুটিয়ে নেই একটু, ‘একবার বেশ বড়-সড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। কালিয়াকৈর নামে একটা জায়গা আছে না, ওখানে একটা বুড়ো মতো মানুষ কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে দৌড় দিয়েছিলেন রাস্তার মাঝ বরাবর। ধাক্কা লাগে আমাাদের বাসের সঙ্গে। পড়ে যান তিনি। বেশ কেটে গিয়েছিল শরীরের কয়েকটা জায়গায়। আশপাশের লোকজন এসে থামিয়ে ফেলেন আমাদের বাসটা। তিন ঘণ্টা পর পুলিশ এসে মিটমাট করে ফেলেন সবকিছু।’
‘ওই সময় একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তোমার।’ লোপার চোখে দুষ্টমির হাসি।
‘পরিচয় মানে গল্প আর কী।’
‘তুমি তো তাকে তোমার ঠিকানাও দিয়েছিলে।’
‘চেয়েছিল তো, তাই।’
‘বেশ কয়েকটা চিঠিও দিয়েছিল তোমাকে।’ লোপা চোখ দুটো সরু করে বিশেষ ভঙ্গিমায় আমার দিকে তাকায়, ‘তুমিও।’
কোনো কোনো কথার মাঝে লোপা আমাকে এ কথাটা প্রায়ই বলে। কোনো অনুযোগ নয়, কেবল প্রচ্ছন্ন একটা ঠাট্টা। আমার তখন বলতে ইচ্ছে করে-প্রায় প্রতিটি মানুষের জীবনেই অমোচনীয় একটা অতীত থাকে। অধিকাংশ পুরুষ সেটা নিদ্বির্ধায় বলে ফেলে এক সময়, কেবল মেয়েরা বুকে চেপে রাখে চিরকাল। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে লোপা একদিন বলেছিল, ‘মেয়েরা সহ্য করতে পারেই বলেই ছেলেরা সব বলে দেয় অকপটে।’ একটু থেমে ও বলেছিল, ‘ছেলেরা অসহিষ্ণু, অনেকটা আত্মবিভোর, অন্যেরটা মেনে নিতে চায় না তারা। মেয়েদের তাই কিছু বলা হয় না।’
‘ঢাকায় এসে কোন জিনিসটা সবচেয়ে অবাক করেছিল আমাকে, জানো?’ লোপার মনোযোগটা অন্য দিকে সরিয়ে নেই আমি।
‘কী?’ আনমোনা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে লোপা।
‘কাক।’
‘কাক!’
‘আমার মনে হয় সারা দেশে যত কাক আছে, তার কয়েক গুণ বেশি আছে এই ঢাকা শহরে। কোনো কোনো দিন কাক দেখতে দেখতে সারাটা দুপুর কাটিয়ে দিতাম আমি।’
‘তুমি যে চিলেকাঠায় থাকতে সেখানে প্রতিদিন একটা কাক আসতো।’
‘কাকটার পা ছিল একা।’
‘তুমি তাকে মুড়ি দিতে, বিস্কিটের টুকরো দিতে।’
‘ওটা খেত আর একটু পর পর ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখত।’
‘তোমার ওই চিলেকোঠাটা ছিল একটা পানির ট্যংকির নিচে। দোতালা একটা পরিত্যক্ত বিল্ডিয়ের ছাদে।’
‘ওই ট্যাংকির চারটি পিলারে ঘিরেই এবড়োথেবড়ো ইট গাথা একটা রুম। জানালা ছিল না সেটার। প্রতি সকালে ঘুম ভেঙে দেখতাম ভিজে একেবারে নেয়ে উঠেছি।’
‘একবার একটা বিস্কিটের টুকরো রেখেছিলে তোমার পড়ার টেবিলে।’
‘রাতে ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। লাইট জ্বালিয়ে দেখি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটা চেলা ওই বিস্কিট ঘিরে আছে গোল হয়ে। আলো চোখে পড়তেই সবগুলো দ্রুত পালিয়ে যায় ওই এবড়োথেবড়ো দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে।’
‘একবার মশারীর উপরেও অনেকগুলো ছিল।’
‘অনেক। কিন্তু কোনো দিন কোনো চেলা কামড় দেয়নি আমাকে।’
‘ছাদের ওই পরিত্যক্ত ঘরে তোমাকে পেয়ে ওরা বেশ আনন্দিতই হয়েছিল। নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ পেয়ে বন্ধু ভেবেছিল তোমাকে।’ লোপা আবার হাসে, ‘তাই হয়তো কখনো কামড়ায়নি।’ লোপা শাড়ীর আঁচলটা একটু টেনে বলে, ‘আরো কেউ কেউ তো তোমার সঙ্গ পছন্দ করতো।’
‘কিন্তু কখনো সামনে আসেনি সে। একটুও দেখিনি তাকে। কেবল পায়ের শব্দ শুনতাম।’
‘তোমার এই কথাটা শুনলে ভয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার শরীর।’
‘বাড়িওয়ালা বলতেন, যুদ্ধের সময় নাকি ওই ছাদে বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ওই পায়ের শব্দ তাদেরই কারো হবে।’
‘তোমার সত্যি তখন ভয় করত না?’
‘না।’ হাসার চেষ্টা করি আমি, ‘মফস্বল থেকে আসা স্বপ্নালু যুবক, বেঁচে থাকার তাগিদে, বড় হওয়ার তাড়নায়, পিছলে পড়ার আশংকায় সব সময় এমনিতেই ভয়ে থাকত সে। ওই ভয়ের কাছে ওই পায়ের শব্দের ভয় বড় তুচ্ছ ছিল।’ মুখটা আরো একটু হাসি হাসি করে ফেলি আমি, ‘কোনো কোনো রাতে আমার ঘুম আসত না। ছাদের ছোট্ট দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম অনেকক্ষণ। পূর্ণ চাঁদ দেখতাম, কোনো ছিটকে আসা উল্কা দেখতাম, কোনো কোনো রাতে কেবল আকাশ দেখেই কাটিয়ে দিতাম। মায়ের মুখটা ভেসে উঠত তখন। আপনা-আপনি চোখ ভরে যেত জলে। আমি না-।’
আমার দু ঠোঁট ঠেসে ধরে লোপা তার তর্জনি দিয়ে। এক রাতের একটা ঘটনা বলেছিলাম ওকে একদিন। ও শুনে এমন কান্না শুরু করেছিল, তারপর থেকে ওই ঘটনাটা আর শুনতে চায় না ও। বলতে গেলেই থামিয়ে দেয়।
ঠোঁট দুটো থেকে আঙ্গুল সরিয়ে লোপা কিছুটা অস্থির ভঙ্গিতে বলল, ‘পাঁচ মিনিট তো শেষ হয়ে গেছে তোমার। কী যেন দেখছ বলছিলে?’
‘ওই ধুসর টি-শার্ট পরা ছেলেটাকে দেখো।’
সম্পূর্ণ স্থির থেকেই মাথা একটু কাত করল লোপা। টান টান চোখে সামনের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড ছেলেটাকে দেখে কিছুটা নির্ভার স্বরে বলল, ‘দেখলাম।’
‘রক্তাক্ত একটা ইতিহাস আছে তার, রক্তপাতেরও।’
‘তুমি তাকে চেনো?’
‘শুধু চিনি না, জানিও।’ ছেলেটার দিকে একটু ঘুরে দাঁড়াই আমি, ‘স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের যৌথ মহড়াও আছে তার মধ্যে। খুবই স্বাভাবিক-স্বপ্ন আছে বলেই তো স্বপ্নভঙ্গও থাকে। তার সাথে আছে মধ্যবিত্তের শংকিত রক্ত। ঘাম হয়ে যা প্রতিদিন ঝরে।’
‘তোমাদের এলাকার কেউ ওই ছেলেটা?’ লোপা খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে। গলায় আন্তরিকতা।
‘না। তবে স্বজন। ওই যে বললাম-শুধু চিনি না, জানিও। আমি জানি-বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আয়াতুলকুরসী পড়ে হাত বুলাতে বুলাতে তার মা ফুঁ দিয়েছেন তার সারা শরীরে। তার আগে সপ্তাহ ধরে ধরে নফল নামাজ পড়েছেন আর কেঁদেছেন। একটি তাবিজও বেঁধে দিয়েছেন ডান হাতের বাহুতে। ফাঙ্গাস পরা প্রায় অব্যবহৃত ব্যাগটায় কাপড় গুছিয়ে দিতে দিতে মা আচমকা জড়িয়ে ধরেছেন তাকে। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছেড়েছেন। অনেক কথা বলতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু পারেননি। শেষমেশ মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছেন, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো বাপ। অথচ তিনি নিজেই ছেলের চিন্তায় আধা পেট খেয়েছেন কখনো, কখনো খেতেই পারেননি। চোখের আড়াল হওয়ার কষ্টে গলা দিয়ে ভাত নামেনি তার।’
‘এসব কী বলছো তুমি!’ হাত খামচে ধরার মতো একটা হাত ধরে আমার লোপা।
‘এই শহরে এসেই তাকে সবচেয়ে অবাক করেছে এই শহরের মানুষ। সবাই কেমন চঞ্চল। স্থিরতা নেই কোথাও। কারো সঙ্গে কারো গল্পও নেই। সবাই একা। যার যার মতো ব্যস্ত।’
‘তারপর?’ গল্পেমুগ্ধ লোপার অস্ফুট স্বর।
‘তারপর দুদিন যেতেই সেও টের পায় তার নিঃসঙ্গতা। কখনো একা একা রাস্তায় ঘুরেছে, শপিংব্যাগ বহুল কোনো মেয়েকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে, থেমে থাকা ঝকঝকে কারো গাড়ির কাচে নিজের মাথার চুলে হাত বুলিয়েছে, আকাশ ঢেকে রাখা বড় বড় হোরিংবোর্ডের পলিশ করা নির্জীব মানুষগুলোর সঙ্গে নিজেকে মিলিয়েছে, ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত হয়ে ফুটপাত থেকে এক প্লেট চটপটি খেয়ে আবার ভ্রমণ বিলাসে পা বাড়িয়েছে।’
চোখে আরো মুগ্ধতা বেড়ে যায় লোপার। কিছু বলে না। কেবল মুখ দিয়ে ‘উ’ জাতীয় একটা শব্দ করে।
‘এরই মধ্যে সে তার ওজনটাও মাপিয়ে নিয়েছে ফুটপাতের কোনো ওজন মাপার যন্ত্র থেকে। পকেট থকে দু টাকার একটা নোট বের করে বাড়িয়ে দিতেই চোখ যায় তার পাশের লোকটার দিকে। টিয়া পাখি আর কতগুলো মলিন ইনভেলপ নিয়ে বসে আছেন তিনি। পাখিটির সম্ভবত জন্ডিস হয়েছে, নাহলে ওমন দেখাচ্ছে কেন তাকে। পাখা এবড়োথেবড়ো, চেহরাটাও কেমন পানশে।’
‘ওই রাস্তার জ্যোতিষি?’ লোপা জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ। পাঁচ টাকা খরচ করে সে তার ভাগ্যটাও পরীক্ষা করে ফেলে। অতি কৌতুহল নিয়ে টিয়ার ঠোঁট থেকে ইনভেলাপটা নিজেই হাতে নেয়। দ্রুত খুলতে গিয়ে কিছুটা ছিঁড়ে ফেলে ভেতরের কাগজটা। যদিও ওটা আগে থেকেই কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া ছিল। আরো দ্রুত ভাঁজ খুলে কাগজটা মেলে ধরে চোখের সামনে। সমস্ত নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়তে থাকে লেখাটা-চমৎকার ভাগ্য আপনার। ভালো করিয়া সৎ কর্ম করিয়া যান, একদিন উন্নতি করিতে করিতে অনেক টাকাওয়ালা হইবেন।’
ফিক করে হেসে ফেলে লোপা, ‘ভালো করিয়া সৎ কর্ম করিতে হইবে, তারপর উন্নতি করিতে করিতে অনেক টাকাওয়ালা!’
‘তারপর বড় কোনো শপিং মলের কাচ ঠেলে কাঁপা কাঁপা পায়ে ভেতরে ঢুকেই তার মনে হয়েছে-না, সত্যি সত্যি তার টাকাওয়ালা হওয়া দরকার। না হলে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড়াতে থাকবে সারাক্ষণ।’
লোপা আরো একটু ঘুরে দাঁড়ায়, ‘দেখো দেখো, ছেলেটা কী কিনছে?’
‘এতক্ষণ ওটাই দেখছিলাম আমি।’
‘ওটা কিনছে কেন?’
‘ওটা তার দরকার যে।’
‘ওটাতে ঘুমানো যায় নাকি!’
‘যায়।’ হাতের শপিং ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে চেপে ধরি লোপার দু কাঁধ, ‘মাটির গন্ধ মেখে স্বপ্নগাঁথা যে ছেলেগুলো প্রথম এই শহরে আসে, যাদের জন্য কেউ নেই এখানে, তাদের আধো ঘুমের প্রথম রাতগুলো ওই আম কাঠের চৌকিতেই কাটে। এবং কোনো একদিন ওই চৌকি থেকে অযাচিতভাবে একটা পেরেক উঠে যাবে। অসাবধনাবশত ওখানে শুতে নিতেই পিঠে গেঁথে যাবে তা। এক সময় রক্তাক্ত জায়গাটা শুকিয়েও যাবে। কিন্তু স্মৃতিচিহ্নের মতো ছোট্ট করে ফুলে থাকবে জায়গাটা। কোনো কোনো স্বর্গছোঁয়া সময়ে স্ত্রী তার মোদিত গলায় বলবে, এখানে এমন ফোলা কেন তোমার? জবাব পাবে না সে। আরো একদিন, তারও পরে আরেকদিন, দিন দিন সেই মোদিত গলার প্রশ্ন, কিন্তু অ-পাওয়া উত্তর।’
লোপা আলতো করে হাত রাখে আমার পিঠে। আঙ্গুল দিয়ে চেনা জায়গাটা স্পর্শ করে। ছোট্ট ফুলোটা বুলাতে বুলাতে বলে, ‘এখনো একটু একটু ব্যথা করে?’
‘না। কিন্তু ওটা মনে করে দেয়-আমার গায়ে একদিন মাটির গন্ধ ছিল।’ চোখ দুটো বুজে ফেলি আমি।

বিজ্ঞাপন


গাড়ির ডোর হ্যান্ডেলে হাত দিয়ে লোপা একবার পেছন ফিরে তাকায়, তারপর উঠে পড়ে গাড়িতে। ভেতরের ঠাণ্ডা আবেশে আরাম করে বসে ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর মাথাটা আমার কাঁধে এলিয়ে দেয়, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় চেনো ছেলেটাকে।’
ঠাণ্ডাটা আরো একটু বাড়িয়ে দিতে বলি আমি ড্রাইভারকে। গাড়ির উইন্ডো গ্লাস ভেদ করে চোখ রাখি রাইরে। তিন চাকার ভ্যানের উপর সিঙ্গেল একটা আম কাঠের চৌকি। পাশে বসা ওই ছেলেটা। মুখে প্রশান্তির হাসি। ঝুলানো পা দুটো আস্তে আস্তে দুলছে তার।
কাঁধে রাখা লোপার মাথাটা আলতো ছুঁয়ে বলি, ‘চিনি তো। নিজেকে চিনব না!’

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/পিএম

গল্প সুমন্ত আসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর