এই হাসি এই কান্না
২০ আগস্ট ২০১৮ ১২:০৫
আহসান হাবীব ।।
তারা চার ভাই। বড় ভাই, মেঝো ভাই, সেঝো ভাই আর ছোট ভাই ( তাদের প্রত্যেকের একটা করে নাম অবশ্য আছে, তবে এই গল্পে নাম মনে হয় অত জরুরী না ) । যত সমস্যা চার ভাইয়ের মধ্যে ওই সেজো ভাইকে নিয়েই। তার কারণে ওই পরিবারে কেউ শান্তিতে ঈদ করতে পারে না। বিষয়টা আরেকটু পরিস্কার হওয়া দরকার। গত ঈদের কথাই ধরা যাক। গত ঈদের ঠিক আগের দিন সবাই যখন ঈদের কেনাকাটা খাওয়া-খাদ্য কি হবে না হবে কোথায় নামাজ পরা হবে বা কোন টিভি চ্যানেলে কোন নাটক বা টেলি নাটক দেখবে কোন কোন ঈদ সংখ্যা কিনবে… এসব নিয়ে ব্যস্ত। তখন হঠাৎ ওই পরিবারের সেজো ভাই ঠিক ঈদের আগের দিন রিক্সা থেকে পরে পা ভেঙে ফেলল। ব্যাস সবার ঈদ মাথায় উঠল সবাই তাকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালে, ঈদের আগের দিন কী আর হাসপাতালে ডাক্তার থাকে! না ডাক্তার থাকা উচিত? তাদেরওতো ঈদ আছে নাকি? তো শেষ পর্যন্ত এই হাসপাতাল ঐ হাসপাতাল প্রাইভেট পাবলিক… দৌড়ে কোনরকমে একটা ব্যাবস্থা হল। ততদিনে ঈদের কম্ম সাবার। মানে ঈদ শেষ!
এরপর আসা যাক তার আগের বছরের ঈদের আগের দিনের ঘটনাটায়। সেটা ছিল কোরবানী ঈদ। চার ভাই মিলে কোরবানীর গরু কিনতে যাবে। গরুর হাটে গিয়ে দল বেঁধে গরু কেনার মজাই আলাদা। এবারও সবাই প্রস্তুত হচ্ছে, সিদ্ধান্ত হয়েছে ঠিক ঈদের আগের দিনই গরু কেনা হবে। কারণ ঢাকার বাসা-বাড়িতে গরু রাখাও এক ঝকমারী । কিন্তু বের হওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ দেখে সেজো ভাই নেই ! কই সে? তার আবার সিগারেট টানার অভ্যেস, হয়ত একফাঁকে টানতেই গেছে। কিন্তু একটু পর খবর এল সেজো ভাইকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। ঘটনা কি? সিগারেট টানতেই গিয়েছিল। পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যে সিগারেট টানা নিয়ে এক কথা দুই কথায় তর্ক বিতর্ক… এক লোকের সাথে, তারপর এক পর্যায়ে হাতাহাতি… কিন্তু সেই লোক যে সিভিল ড্রেসে পুলিশ তা কে জানত। ‘সরকারী কাজে বাঁধা প্রদান মামলায়’ সোজা থানা হাজতে। তারপর আর কি কোরবানীর গরু কেনা মাথায় উঠল। তিন ভাইয়ের থানায় দৌড়াদৌড়ি। কোনও লাভ হল না। সোজা কোর্টে চালান হয়ে গেল সেজো…। ঈদে কোর্ট বন্ধ ফলে সাত দিনের ফ্যাকরায় পরে গেল। যথারীতি আবার ঈদ মাথায় উঠলো। পরে অবশ্য জামিনে ছাড়া পেল। ততদিনে ঈদ গিয়ে… দুর্গা পূজার ঢোল বাজতে শুরু করেছে।
এবার আসা যাক তারও আগের বছরের ঈদের ঘটনায়। সেবারও আরেক কাহিনী। হঠাৎ ঈদের আগের দিন সেজো ভাই নিখোঁজ। সে নাই, নাইতো নাই। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। থানা-পুলিশ, পীর-ফকির বাটিচালান কোনটাই বাদ নেই… কিন্তু কোথাও তার হদিস নাই। শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া গেল। কল্যানপুর বিআরটিসি বাস ডিপোতে এক বাসের শেষ সীটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাও ঈদের তিনদিন পরে সন্ধান মিললো। অজ্ঞান পার্টির কান্ড।
তাই শেষ পর্যন্ত তিতিবিরক্ত হয়ে অন্য তিন ভাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিল। এবারের ঈদটা তাদের ঠিকমত পালন করতেই হবে বাই হুক অর ক্রুক। এর জন্য কি করা? তারা যুক্তি করে ঈদের ঠিক তিনদিন আগে সেজো ভাইয়ের রুমের দরজায় তালা মেরে দিল। সেজো ভাই ঘুম থেকে উঠে বাথরুম সেরে বেরুতে যাবে। দেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ঘটনা কি? চিৎকার চেঁচামেচি করল কিছুক্ষন। বড় ভাবী এসে জানাল (একমাত্র বড় ভাই বিয়ে করেছে) ‘চেঁচিয়ে লাভ নেই, প্রতিবার তোমার জন্য কেউ শান্তিতে ঈদ করতে পারে না । ঈদের আগের দিন তুমি একটা না একটা কাণ্ড কর। তাই এই ব্যাবস্থা। ঈদের দিন নামাজের আগে আগে তোমার দরজা খোলা হবে। এই নাও জানালার পাল্লাটা খোল নাস্তা নাও …’
– হোয়াট? এসবের মানে কী? ভাবী ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। দরজা খুলে দাও।
– ভাই আমার সাথে চেঁচিয়ে লাভ নেই। তোমার ঘরের চাবি ওদের কাছে। ওরা গেছে গরু কিনতে।
– গরুর নিকুচি করি। ভেবেছ কি তোমরা? দরজা খোল বলছি…
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মা বের হয়ে এলেন। ‘কিরে ষাঁড়ের মত চেচাচ্ছিস কেন?’
– চেঁচাবো না মানে? দেখছ না আমাকে তালা মেরে রেখেছে।
– ভালইতো প্রতিবছর ঈদের সময় তোর একটা না একটা অঘটন ঘটে। থাক না কটা দিন নিজের ঘরে । একটু আরাম কর।
– কভি নেহি । তুমিও দেখছি ওদের দলে। দাঁড়াও আমি দরজা ভেঙে বের হব। তারপর তিন ভাইয়ের নামে কেস করব। সব কটাাকে জেলের ভাত খাওয়াব আমি।
‘আচ্ছা তুই যে একবার ঈদের আগের দিন জেলে ঢুকলি, সাত দিন ছিলি জেলে । তখন তোদের কি চাল খাওয়াতরে? তোর মনে আছে? মোটা চালের লাল ভাত নাকি? জেলের রান্না-বান্না কেমন? আচ্ছা, ঈদের দিন নাকি পোলাও-কোরমা দেয়, তোকে দিয়েছিল? ’ আচমকা বৃদ্ধা মায়ের এই কৌতুহোলে সেজোপুত্র ‘হতস্তম্ভিতমুঢ়’ ( হতভম্ব + স্তম্ভিত + বিমুঢ় ) হয়ে যায় যেন… ভাষা হারিয়ে ফেলে।
গরু কিনে তিন ভাই ফিরে এল। সেজোর জানালার কাছে গরু এনে দেখানো হল। বড় ভাই বললো-
– দেখতো সেজো গরুটা কেমন হল ?
– গরুর নিকুচি করি। দরজা খুলবে কিনা বল?
– আহ খামোকা চেঁচাসনাতো খুলবতো ঈদের দিন সকালে খুলব একসাথে নামাজে যাব। তোর ভালোর জন্যইতো তিন ভাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিলাম।
এই সময় ছোট ভাই একটা পাঞ্জাবী নিয়ে এসে জানালার সামনে মেলে ধরল ‘ ভাইয়া পছন্দ হয়? ’ সেজো ভাই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল ছোট ভাইয়ের দিকে। কিছু বলল না। মানে ভাব দেখে বোঝা গেল বলার ভাষা খুঁজে পেল না।
দ্বিতীয় দিনে খাওয়া বন্ধ করে দিল সোজো ভাই। যাকে বলে অনশন। রুদ্ধদার অনশনও বলা যেতে পারে। আর সে দিনই হঠাৎ করে এসে হাজির হল তার বান্ধবী মিস লুনা (সেজোর একটা চাকরী-বাকরি হলেই এর সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া হবে এমনটাই সিদ্ধান্ত পরিবারের) । মিস লুনাকে সেজোর জানালার পাশে একটা চেয়ার দেয়া হল। মিস লুনা যারপরনাই বিস্মিত হলো বলে মনে হলো! যদিও মুখে তা প্রকাশ করল না। ফিস ফিস করে বলল-
– তোমাকে আটকে রেখেছে কেন?
– সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? আমার গুনধর ভাইদের জিজ্ঞেস করো গিয়ে।
– তোমার কি হঠাৎ কোন মানসিক সমস্যা? মেন্টাল ব্রেক ডাউন? ভায়োলেন্ট নাাকি?
– হোয়াট? কি বলছ এসব… আমাকে মেন্টাল ভাবছ ?
– না মানে চাকরি হচ্ছে না এসব ভেবে মাথা গরম হতেই পারে… তার উপর এমনিতে যে গরম… সুস্থ মানুষই পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা!
সত্যি কথা বলতে কি মিস লুনা একটা ক্ষিন সন্দেহ নিয়ে ফিরে গেল।
তবে ঈদের দিন। সাতটায় তালা খোলা হল। নামাজ আটটায়। সেজো গম্ভীর হয়ে বের হল। সবাই ভেবেছিল রেগে মেগে অন্য ভাইদের উপর হয়ত ঝাঁপিয়ে পড়বে। তেমনটা হল না। গোসল করল। নতুন পাঞ্জাবী পাজামা পড়ে ভাইদের সঙ্গে নামাজ পড়তে গেল। ভাইরা অবশ্য সতর্ক থাকল।
ফিরে এসে চারভাই মিলে গরু ফেলে দিল। পায়ের কাছের প্যাচ দেওয়া দড়িটা টেনে ধরে রেখেছে সেজো ভাই। পাশের ফ্ল্যাটের কোরবানী দিয়ে ঈমাম সাহেব ছুরি হাতে এলেন বলে, আর ঠিক তখনই আচমকা ঝটকা দিয়ে লাফিয়ে উঠল তেজি ষাঁড়টা। পায়ের কাছের দঁড়িটা ছিল সেজ ভাইয়ের হাতে সেটা ছুটে গেল কারণ ততক্ষনে গরুর ব্যাক ফুট এ্যাটাক সোজা সেজোর কপাল বরাবর। ‘ও বাবাগো’ বলে ছিটকে পড়ল সে তিন হাত দূরে! ষাঁড় মুহুর্তে উধাও। ষাঁড়ের পিছনে ছুটলো একভাই আর দুই সেজোকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালে। ঈদের দিন কী আর হাসপাতালে ডাক্তার থাকে! না ডাক্তার থাকা উচিত? তাদেরওতো ঈদ আছে নাকি? তো শেষ পর্যন্ত এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল প্রাইভেট পাবলিক …দৌড়ে কোনরকমে একটা ব্যাবস্থা হল। সেজোর কপালে সাতটা সেলাই দিয়ে রক্ত বন্ধ করা গেল। তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ায় এক হাতেও ফ্রাকচার হয়েছে। সেখানেও টানা ব্যান্ডেজ, কনুই পর্যন্ত।
বাসায় ফিরে জানা গেল গরু ধরা যায় নি, ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সে উসান বোল্ট স্টাইলে দৌড় দিয়েছে, ধরা সম্ভব ছিল না। কোরবানীর গরু ছুটে গেলে বা মরে গেলে নাকি ওই একই দামে দুটো গরু দিতে হয়। বড় ভাই বিমর্ষ মুখে মেঝো আর ছোট ভাইয়ের দিকে তাকায়, তারা দুজন তাকায় সেজোর দিকে। সেজো তখন চিঁ চিঁ করে বলছে ‘ গরু হারানো গেছে… থানায় জিডি করলে কেমন হয়?’ তার প্রশ্নের কেউ কোন উত্তর দিল না। তারা অবশ্য কেউ জানেও না এই মর্মে থানায় আদৌ জিডি করা যায় কিনা। তবে একজনের মুখটা বেশ হাসি হাসি। সে হচ্ছে বাড়ির বড় বউ, এ বাড়িতে বউ অবশ্য একটাই। সে সেজেগুজে সবার জন্য টেবিল গোছাচ্ছে। সেমাই হালুয়া মিষ্টি পরোটা ভাজি … ‘ এই তোমরা খেয়ে নাও। মাংস কাটাকাটির ঝামেলাতো আর নেই!’ বলে ফিক করে হেসেও ফেলে। তার হাসি অবশ্য কেউ খেয়াল করেনা। তার কিন্তু বেশ ভালোই লাগছে। আহা গরুটার উপর মায়া পড়ে গিয়েছিল, কী সুন্দর টকটকে লাল একটা তেজি গরু ছিল সে। সে কি আর মানুষের ধর্মীয় আত্মত্যাগের মহিমা-টহিমা বোঝে? সে নিজের জীবনটাকে নিজেই রক্ষা করেছে… এখন হয়ত দূরে কোন প্রান্তরে সবুজ মাঠে মাথা নিচু করে ঘাস খাচ্ছে… আহা খাক! কেন যেন বড় বউয়ের চোখ দুটো ভিজে উঠে। এই হাসি, এই কান্না… মানুষ সত্যিই বিচিত্র!
তবে তিনভাই সিদ্ধান্ত নেয় এর পরের ঈদগুলোতে সেজোর ঘরের তালা খোলা হবে ঈদের পরের দিন! আর কোনো ঝুঁকি নেয়া যাবে না। সেটা তাকে অফিসিয়ালি জানিয়েও দেয়া হল। সেজো অবশ্য চিঁ চিঁ করে মামলা করার হুমকি দিল!
সারাবাংলা/পিএম