ইংরেজি সাহিত্য: সুপাত্রের সন্ধানে বাঙালি
২৯ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:৪৫
মিরাজুল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সম্ভাবত প্রথম বাঙালি লেখকদের মধ্যে কালের যাত্রা ধ্বনি ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন। সে কারণে তাঁর সাহিত্য কর্মকে ইংরেজি অনুবাদে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এবং ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল অর্জন করে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব মানচিত্রে অন্যভাবে আলোচনায় আনলেন।
ধরে নেওয়া যায়, আজ এত বছর পরেও বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী ধারায় অনুবাদ শাখা রুগ্ণ হয়ে আছে স্রেফ সংযোগহীনতায় কিংবা অনূদিত না হবার দুর্বলতায়।
অন্যদিকে, উপমহাদেশের অবাঙালি লেখকরা বিশেষ করে ভারতীয়রা খোদ ইংরেজি ভাষাকে উপজীব্য করে এগিয়ে যেতে থাকলেন। তবে মোটেও কক্ষচ্যূত হয়ে নয়। বরঞ্চ পরম স্বাদেশিকতার দৃঢ়ভূমে দাঁড়িয়ে।
এই ধারার সাহিত্যিকগণ ঐকান্তিক সাধনায় মগ্ন থাকলেন পূর্ব পশ্চিম’কে এক সূতোয় জড়াবার প্রচেষ্টায়; ইংরেজি ভাষার সুতোয় প্রাচ্য-প্রতীচ্যের নাটাই হাতে আন্তর্জাতিক পাঠক মহলে উপমহাদেশীয় কথাসরিৎ রচনা করতে থাকলেন। নিজ সংস্কৃতিকে ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে আছড়ে ফেললেন আটলান্টিকের দুই পাড়ে। অক্ষরের সাগরে ডুব সাঁতারে তুলে নিলেন হুইটব্রেড, বুকার, পুলিটজার, ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স অ্যাওয়ার্ডের মতো আঁকড়ে ধরা পাশ্চাত্য সাহিত্য-আভিজাত্য।
বাংলাদেশের তুলনায় পুঁজি ও প্রযুক্তির বাজারে যেমন ভারত এগিয়ে, তেমনি সাহিত্যের এই ধারাতেও তাদের ‘আগ্রাসন’ বেশি মাত্রায় উচ্চকিত। এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বিশেষ করে বাজারভিত্তিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় লেখকদের এই সক্ষমতা বেড়েই চলেছে। অথচ মেধার বিচারে অপার সম্ভাবনার হিসেব-নিকেশে আমাদের প্রতিভার চৌহদ্দি যথেষ্ট বর্ণময়। হয়তো সময় এর উত্তর দেবে। হয়তো এই প্রতিভার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামিল হতে আমাদের আগ্রহ কম। কলোনিয়াল ভাষায় দুর্বলতা এর একটি কারণ হতে পারে। বা একে এড়িয়ে এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভোগার দ্বান্দ্বিকতা বলা যায় একে। তারপরও ভেতর ভেতর অস্বস্তির সংশয় কি আমাদের ভাবায় না?
কেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অভারতীয় ভাষায় লেখালেখি করে টিকে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা? উত্তরটা এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। কেন না এই লেখালেখির ইচ্ছাটা এবং প্রক্রিয়াটা এসেছে মূলত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার প্রেক্ষাপট হতে। বিশাল সংখ্যক অভিবাসীদের কয়েক প্রজন্ম এই স্তরকে নির্মাণ করেছে। স্পষ্ট করে বললে, মুখ্যত অভিবাসী ভারতীয় লেখকরাই ইংরেজিতে নিজস্ব বুৎপত্তি অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছেন। এ জন্য বেশ বন্ধুর পথ তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের।
ধরা যাক চিত্রকলার কথা। এর নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। রয়েছে বিশিষ্ট অবয়ব। সেই অবয়বের মধ্যেই ফুটে ওঠে স্বাদেশিকতার ছাপ। সেই অব্যক্ত অথচ দৃশ্যমান ভাষাতেই একজন শিল্পী তার নিজস্ব আন্তর্জাতিকতার তত্ত্ব গড়েন। শিল্পী সহজেই হয়ে ওঠেন সর্বদেশীয়। কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি মাত্র ভাষার চল নেই। আবার, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে এই রকম কোনো ভাষা আন্তর্জাতিকতার সুনির্দিষ্ট মাত্রা অর্জন করতে পারেনি। যদি তাই হতো, তবে আমাদের দল বেঁধে চীনা ম্যান্ডারিন হরফের তালিম নিতে হতো।
কোনো দেশের ভাষা বিশ্ব-সাহিত্য শাসন করবে তা নির্ভর করছে সেই ভাষার ছড়িয়ে পড়া ও প্রভাব-সৃষ্টির ক্ষমতার ওপর। সেই সাথে বাজার অর্থনীতিও ভাষার কৌলীন্য নির্ধারণ করছে। আর এখানেই ইংরেজি ভাষার আধিপত্য। ঔপনিবেশিক বলয় হতে মুক্তি পেলেও এর রেশ যেন অটুট। বরঞ্চ এর প্রভাব সর্বগ্রাসী। সাইনবোর্ড হতে কম্পিউটারের কি-বোর্ডে। পায়ের জুতোর ট্রেড মার্ক হতে মস্তিষ্কের নিউরনে। কোথায় নয়? মানে ও গুণে কতটুকু তা ভাববার বিষয়।
ফলে, যতই গর্ব করি মাতৃভাষায় রচনাসম্ভার নিয়ে, বিশ্বায়নের যুগে মূল্যায়িত হতে চাইলে ঐ ভারতীয় অ-ভারতীয় রচনাকারদের মধ্যেই প্রথমে স্থান করে নিতে হবে। স্থূল মনে হলেও এটা বাস্তবতা। কারণ সাহিত্য এখন বিপণনের পণ্য। প্রতিভা যার পুঁজি। স্বীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কারিশমা তুলে ধরতে চাইলে আপাতত এর বিকল্প নেই।
একজন নীরদ সি চৌধুরী এই আলোকে মোক্ষম উদাহরণ হতে পারেন। দ্বন্দ্ব বিতর্ক থাকতেই পারে তার অর্পিত মতাদর্শকে ঘিরে। সাহিত্য রচনা বাংলা কি ইংরেজিতে হওয়া উত্তম এমন কূটর্তকে যাবার উদ্দেশ্যে এই লেখাটির অবতারণা নয়। কেবল ভেবে অবাক লাগে, কতটুকু শ্রমে সাধনায় উপমহাদেশীয় প্রজন্মের কিছু সাহিত্যিক ইংরেজি ভাষাকে এতটা রপ্ত করে কীভাবে নিজস্ব শিকড়ের রসে জারিত করে জব্দ করলেন খোদ ইংলিশভাষী লেখকদের।
শুধু তারা নন। এশীয় ল্যাটিন আমেরিকান কিংবা আফ্রিকার সাহিত্য অঙ্গনের দিকপালরাও ইংরেজি ভাষাকে দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যে অন্যতম অবলম্বনের মর্যাদা। ঔপনিবেশিকতার অন্তর্হিত শক্তি কি এতই বেশি? অ্যাংলো-স্যাক্সনদের এমনই সৌভাগ্য? জিম মরিসন, ডেরেল ওয়ালকট কিংবা একজন সিমাস হিনির চাইতে আমাদের শামসুর রাহমান, আবুল হাসানেরা কি কম প্রতিভাবান? আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ বা শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ কি গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ বা নাদিয়া গর্দিমারের ‘লা মাদ্রে’ হতে কোনো অংশে কম সংবেদনশীল রচনা? জানি বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন হয়তো অবাস্তর। কারণ মহত্তর কিংবা শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াই হতে আমরা অনেক দূরে। কালের যাত্রার ধ্বনি আমাদের এখনো শোনাতে পারিনি। মাতৃভাষায় মন ঠিকই তৃপ্তি পায় আবার দুঃখ হয় মধ্যযুগের আব্দুল হাকিমের মতো দেশপ্রেমী কবিকেই আমরা বিশ্বের কাছে পরিচয় করাতে পারিনি। অথচ অ্যাংলো-স্যাক্সন আমলের জনৈক অ্যালফ্রিক (৯৫৫-১০২০) মহোদয়ের রচনা মুখস্থ করে শ্লাঘা বোধ করি। এই হল আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আসক্তি ও কতর্ব্যের নমুনা।
বহির্বিশ্বে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল নির্যাস বহন করার অন্যতম কৃতিত্বের দাবিদার মূলত ইউরোপিয়ান বোদ্ধারা। তাদের ফিরিস্তি বেশ লম্বা। এ’ প্রসঙ্গে বলতে হয় প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অধ্যাপক মরিংস ইউনটারনিৎস (১৮৬৩-১৯৩৭)-এর কথা। তিনি রবীন্দ্র সান্নিধ্যে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন। যিনি সংস্কৃত নাটক ‘উত্তররাম রচিত’ চাক্ষুষ অভিনীত দেখে পরমতৃপ্তিতে বলেছিলেন, ‘আমার বারংবার রোমহর্ষণ হচ্ছিল’। এই ইউরোপিয়ান পণ্ডিতের অক্ষয় কীর্তি হচ্ছে তিন খণ্ডে ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস রচনা ‘Geschichte der indischen Literature’ জার্মান ভাষা ছাড়াও ইংরেজিতে দুই খণ্ডে পুরো ইউরোপে প্রসিদ্ধ।
সুতরাং এক হিসেবে ভারতীয় সাহিত্যের মূলসূত্রটুকু ইংরেজি-ভাষীদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার অবকাশ পড়ে না। অন্যতম আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে এরা সবাই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। বাংলা ভাষায় কাব্য রচনায় উৎকর্ষতার নিরিখে এদের অবস্থান শীর্ষে কিন্তু তা কোনো ভিন্নভাষীর ‘রোমহর্ষণ’ করে না। তবে আশার কথা উত্তর প্রজন্মের নব্য লেখকেরা সাহিত্যে প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে নিজেদের উন্মোচিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিশ্বসাহিত্য তথা ওর্য়াল্ড লিটারেচার শব্দটি সর্বপ্রথম করে নাগাদ চালু হয়েছিল তা তর্কসাপেক্ষ। সম্ভবত গ্যাটে এ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন। এই তথ্যের পেছনে সুনির্দিষ্ট যুক্তি দর্শাতে হলে সর্বাগ্রে বুঝতে হবে গ্যাটের সর্বজনগ্রাহ্যতাকে। জার্মান সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে দাঁড় করবার নেপথ্যে রয়েছে গ্যাটের সর্বগ্রাসী দর্শন।
পাশাপাশি এটাও সত্যি, মডার্নিজমের পরিক্রমায় বিশেষ করে পোস্ট মডার্নিজমের ছায়ায় এই ধারাটি ক্রমশ পুষ্ট হয়েছে। পুঁজিবাদ আর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতে ধর্ম-বর্ণের দ্বন্দ্বে লেখক সত্তা কখনো হয়েছে নন্দিত কিংবা নিন্দিত। এর অভিঘাতে নিজ মাতৃভাষার পরিবর্তে তাকে আশ্রয় নিতে হয় ভিন্নদেশি ভাষায়। ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায়। প্রশ্রয় লাভ করতে হয়েছে পরবাসী আবহাওয়ায় অভিবাসী সূত্রে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বয়নের প্রক্রিয়াটি। এই অঞ্চলের অভিবাসী প্রবাসী লেখকেরা মূলত আশ্রয় নিয়ে থাকেন আটলান্টিকের দুই পাড়ে। যেখানে ইংরেজি ভাষাই সর্বেসর্বা।
আজ হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস, সোয়াংকার পাশাপাশি এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হয় নইপল, রুশদি, শেঠ, অরুন্ধতি’র নাম। এই পরম্পরায় এসেছেন হালের ঝুম্পা লাহিড়ী, পংকজ মিশরা, অখিল শর্মা, রাজকমল ঝা, অমিতাভ ঘোষ। এরা চসারের (১৩৪০-১৪০০) গদ্যরীতিকে আমূল বদলে ইংরেজি ভাষার কৌলিন্যকে ভেঙে-চুরে স্বতন্ত্র পরিচয়ে যুথবদ্ধ করেছেন। অরূদ্ধতী রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস’ ১৯৯৮ সালে বিক্রি হয়েছিল ৫ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩৮৬ কপি। যার মোট আয় ৪১,৮২,৭১৮ পাউণ্ড। বেস্ট কিংবা ফাস্ট উভয় সেলারের তালিকাতেই ভারতীয় নব্য ইংরেজি সাহিত্যিকদের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। মরগ্যান ফস্টারের ‘এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’র কাহিনী যেন সফল হতে চলেছে। সালমান রুশদি এবং তার ইংরেজ লেখিকা প্রকাশক স্ত্রী একই মলাটে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। সেই নিরিখে এটা চিন্তাই করা যায় না আমাদের হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ কিংবা সৈয়দ শামসুল হক’রা বিশ্বব্যাপী পরিচিত পাচ্ছেন না। বুকার, পুলিটজার কিংবা নোবেলপ্রাপ্তি তো দূরের কথা।
ইউরোপ ও এশিয়ানদের সংকরে আবিভূর্ত হয়েছে ইউরেশিয়ান পদবিধারী নব্য লেখকশ্রেণী । এদের সারিতে ভারতীয় লেখকদের স্থান করে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরও পূর্বের সীমানায় দৃষ্টি ঠেকে। এসে পড়ে জাপানি সাহিত্যিকদের প্রসঙ্গ। ভারতীয় লেখদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে অনূদিত হয়েছে জাপানি সাহিত্যিকদের রচনা। ইংরেজি ভাষায় জাপানিরা চর্চা শুরু করেছে খুব বেশি দিন হয়নি। তুলনায় ভারতীয়রা ইংরেজিতে লেখালেখি করে যথেষ্ট প্রচার আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। তবে জাপানি লেখকদের মৌলিকত্বের সুর অনেক বেশি নিভৃত। জাপানি হাইকু তো বহু আগেই বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছিল। প্রথম ছত্রে পাঁচ, দ্বিতীয় ছত্রে সাত ও তৃতীয় ছত্রে পাঁচ অর্থাৎ ৫+৭+৫ মাত্রার এই ক্ষুদ্রতম কবিতা ইতোমধ্যে অনুপ্রাণিত করেছে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের কবিতাপ্রেমীদের। তার স্ফূরণ হিসেবে এজরা পাউন্ড, এমি লোয়েন, ওয়ালেস স্টিফেন্স, উইলিয়াম কালোর্স প্রমুখের কাব্যে হাইকুর প্রভাব লক্ষ্যণীয় ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রচুর হাইকু ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে। যার মধ্যে modern Haiku, Byways, Tweed এবং New world Haiku উল্লেখ্য। প্রখ্যাত জাপানি হাইকু রচয়িতা মাতসু বাসো (১৬৪৪-১৬৯৪) হাইকু সম্রাট হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। এই মর্যাদা জাপানি সাহিত্যের ঐতিহ্যকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে। হাইকুর নির্যাস অভিস্রবিত হয়েছে অন্যান্য ইংরেজি লেখকদের রচনায়। সেই নিরিখে বলতে হয় হাইকুর হাত ধরে জাপানি সাহিত্যের অনুপ্রবেশ ঘটে ইংরেজি সাহিত্যের আসরে। এই পরম্পরায় আধুনিক জাপানি সাহিত্যের দিকপালরা ক্রমশ উচ্চকিত হয়ে ওঠেন ইংরেজি লেখালেখির জগতে। বিশেষ করে ১৯১৪ সালে সোসেকি নাতসুমি যখন তার অমর উপন্যাস ‘দি হার্ট’ (কোকোরা) নিয়ে আর্বিভূত হলেন বিশ্ববাসী অনুধাবন করল জাপানি গদ্যসাহিত্যের অসাধারণ গতিময়তাকে। একই সঙ্গে ওগাই মোরি এলেন নান্দনিকতায়র পশরা নিয়ে। বিশ্বসাহিত্যে হাইকু’র পর নতুন বেশে উদয় হলেন প্রথম সূযোর্দয়ের দেশের সৃজনশীল লেখকেরা। পরবর্তীপ্রজন্মে চমক দেখালেন ইয়াসুনারি কোয়াবাতা (১৮৯৯-১৯৭২), যাকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের ধ্রূপদী ঔপন্যাসিক। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়তে খুব দেরি হল না তার।
১৯৬৮ সালে পেলেন দ্বিতীয় এশিয়ান হিসেবে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কার। এর আগে কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে প্রথম এশিয়ান হিসেবে এই সাহিত্যকীর্তি অর্জন করেন। The old capital রচনাটির জন্যই মূলত কোয়াবাতা নোবেল লাভ করেছিলেন। তৎকালীন সুইডিশ একাডেমির এর্ন্ডাস উইস্টারলিং বলেছিলেন, কোয়াবাতা’র রচনায় পুরনো জাপানের সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সযত্ন প্রয়াসী হবার ইঙ্গিত ছিল যুদ্ধোত্তর প্রজন্মের প্রতি। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের পর ইয়াসুনারি কোয়াবাতা জানান, তিনি চেয়েছেন তার কর্মে মৃত্যুকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সায্যুতা অনুসন্ধানই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। বাস্তবিক এটাই জাপানি সাহিত্যিকদের মৌলিকত্ব। শিকড়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। এই ধারা মিসিমা ইউকি (১৯২৫-১৯৭০) হতে বর্তমান প্রজন্মের কাজু ইশিগুরু অব্দি ধাবমান। কোয়াবাতা সাফল্য পেয়েছেন। ইশিগুরুও পেলেন ২০১৭ সালে। যদিও ত্রিশ বছরের কোটা না পেরোতেই তিনি ১৯৮৯ সালে করায়ত্ত্ব করে নিয়েছিলেন বুকার পুরস্কার অসাধারণ ‘দি রিমেইনস অব দ্য ডে’ উপন্যাসটির জন্য। বুকারের জন্য র্সটলিস্টেড হবার পরপরই ইশিগুরুর প্রকাশক ফ্যাবার এন্ড ফ্যাবার পুরস্কার পাওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে দ্বিতীয় সংস্করণে পঞ্চাশ হাজার কপি ছাপিয়ে ফেলেছিল।
অথচ একই সাথে মার্গারেট এটউডের সর্ট লিস্টেড উপন্যাস ‘ক্যাটস আই’ রিপ্রিন্ট হয়েছিল আটাশ হাজার কপি। শুধুমাত্র প্রাচ্য দেশীয় আবেগ ইশিগুরুর জনপ্রিয়তার একমাত্র সূচক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এই প্রথম একজন জাপানি লেখক সরাসরি লিখলেন ব্রিটিশদের সমাজ জীবনের হালচাল নিয়ে। সমালোচকরা একে অভিহিত করলেন ইংরেজি সাহিত্যে এক তাৎপর্যমণি্ডত ঘটনা হিসেবে । অবশ্য ইশিগুরু পুরোপুরি জাপানি সংস্কৃতির মূলসুর ও প্রভাব বর্জন করেননি। জন্মসূত্রে জাপানি শিক্ষাসূত্রে ব্রিটেনের অধিবাসী এই তরুণ লেখক দুই সংস্কৃতির আবহ ফুটিয়ে তুলেছেন। নিজেকে করেছেন সর্বদেশীয়। আন্তর্জাতিকতার ফ্রেমে প্রাচ্যদেশীয় অর্ন্তনিহিত উপলদ্ধিজাত নিজস্ব ভাষা প্রতিস্থাপন করে যুক্ত করেছেন স্বতন্ত্র শৈলী। এই শৈলীর বুনট রুশদি কিংবা নইপল, শেঠদের তুলনায় ভিন্নতর। আলাদা মেজাজের। এ যেন জাপানি ইকেবানার সাথে ইউরোপিয়ান গিমিকের মিশ্রণ।
তারও আগে ১৯৮৬ সালে সর্টলিস্টেড হলেও বুকার জিততে পারেনি। ইশিশুরু কিন্তু এই জন্য যথেষ্ট মন খারাপ করেছিলেন। পরবর্তীকালে আবার তার বুকার প্রাপ্তিতে কট্টর ব্রিটিশরা মন খারাপ করেছিল। কেননা এতদিন পর্যন্ত মোটরগাড়ি, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তিতে জাপানিরা একচেটিয়াভাবে বাজার দখল করে রেখেছিল, সেই সাথে বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ইংরেজি সাহিত্যের তকমাটাও বুঝি তাদের দখলে চলে গেল। যদিও ‘ওয়ান সোয়ালো ডাজ নট মেক এ সামার’ প্রবাদটি সত্য না মিথ্যা সময় এর উত্তর দেবে।
ভারতীয় ইংরেজি লেখকদের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে জাপানি লেখকদের জের টানার লক্ষ্যই ছিল প্রাচ্যদেশীয় জাপানের ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত সর্ম্পকে আভাস দেওয়া। সর্বভারতীয় সাহিত্যের মতোই শুধুমাত্র জাপান নয় সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাহিত্যধারার কৌলিন্য নিয়ে অধ্যায়ের পর অধ্যায় আলোচনা করা যায়। আপাতত তা প্রাসঙ্গিক হবে না। যেহেতু এর ঘনত্ব-উচ্চতা-আধুনিকতা বিশ্বসাহিত্যে সাহিত্য উৎপাদনের পরিমাণে আপেক্ষিক। যেমন ইন্দোনেশিয়ার প্রমোদোয়া অনন্ত ত্যুর, ভিয়েতনামের নথ লীন অথবা গণচীনের মাও সে তুং এর রচনাও যথেষ্ট পরিমাণে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
যদিও এর রাজনৈতিক গুরুত্বই মুখ্য হয়ে পড়েছে। তবে কথাসাহিত্যের ধারায় ভারতীয় লেখকদের মতো একচেটিয়া রাজত্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো এখনো করে উঠতে পারেনি। চল্লিশ দশকের পর হতেই যেন ভারতীয়রা বেশি বেশি উচ্চকিত। জাতিগতভাবে ভারতীয়দের মধ্যে আন্তঃধর্ম-বর্ণ বিভেদ থাকলেও নিজস্ব স্বরাজ ও স্বজাতির অভিজ্ঞতা ইংরেজি ভাষার আশ্রয়েই ধারণ করতে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। ইউরেশিয়ান সত্তা ধারণ করে তারা আঘাত করে তৃপ্তি পান নিজস্ব জাতিসত্তার তৃণমূল প্রেরণাকে। কখনো প্ররোচিত করে নেতিবাচক ভূমিকাকে। আবার পরিবর্ধিত করেন। শুধু শিকড়ের তিক্তরস আস্বাদনে এরা সন্তুষ্ট নন। প্রতিনিয়িত পূর্ব-পশ্চিমের অন্তর্ঘাতে পরিবর্তিত হতে থাকেন।
এই গোত্রভুক্ত লেখকদের মধ্যে ভি.এস. নইপল অন্যতম। ভারতীয় বংশোদ্ভুত এই ক্ষণজন্মা লেখকের জন্ম ত্রিনিদানে। শিক্ষাস্থল অক্সফোর্ডে । তাঁকে বলা হয়ে থাকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সৃজনশীল রচনাকার । এই বিশেষণ কিন্তু পাশ্চাত্যের দেওয়া। প্রথম সাহিত্য জীবনে উপন্যাস লিখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ‘এ হাউস অব মিস্টার বিশ্বাস’ তাঁকে এনে দেয় প্রভূত সম্মান। কিন্তু ধীরে ধীরে নইপল উপন্যাসের উপর আস্থা হারাতে থাকলেন। ক্রমে চলে গেলেন প্রবন্ধ গবেষণামূলক লেখালেখিতে।
সেই সাথে প্রচার করতে থাকলেন, আধুনিক সাহিত্যের মাপকাঠিতে উপন্যাস হচ্ছে স্রেফ একটি বাণিজ্যিক উপাদান। পায়ের জুতার মতোই যে কেউ একে নিজ ইচ্ছেমতো মর্জিমাফিক বানাতে পারেন। এখানেই থেমে থাকলেন না নইপল। এর ব্যাখ্যায় জানালেন, আমাদের সময়ে উপন্যাস মোটেও মেধা যাচাই এর মাধ্যম হতে পারে না। বালজাক কিংবা ডিকেন্সের আমলেই উপন্যাস ছিল সমাজ পরিবর্তনের আঙ্গিকে এক শক্তিশালী অবলম্বন। ঠিক তেমনভাবে বর্তমান কালে নতুন সমাজ ব্যবস্থায় উপন্যাস তেমন জোরাল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। যা লেখা হচ্ছে তা অনেকটা সস্তা পরিচিতি পাবার জন্য। নতুনত্ব কিছুই নেই। স্বাভাবিকভাবেই নইপলের এই চরমপত্র সবাই একবাক্যে মেনে নেননি।
নইপলের আরও ধারণা, ইংরেজরা লিও তলস্তয়ের জন্য যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করবে (সৃজনশীল অনুবাদে শ্রম দেবার ক্ষেত্রে)। সেই সাথে ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করে ভারতীয় লেখকদের সাম্প্রতিক সাফল্যজনিত আত্মতুষ্টি লাভের ঢালাও সমালোচনা নইপল বহুবার করেছেন। তিনি নিজেই উপন্যাসের ক্ষেত্র হতে বেরিয়ে মনোনিবেশ করেন প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনায়। তার ভারত সম্পর্কিত তিনটি গ্রন্থ ‘এন এরিয়া অব ডার্কনেস’, ‘আ উইনডেড সিভিলাইজেশন’, এবং ‘ইন্ডিয়া আ মিলিয়ন মিউটিনিস’ নতুন চিন্তার খোরাক যোগায়।
ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির নানা বৈরিতা সাম্যতার বিশ্লেষণ করতে নিয়ে নইপল পুরা পৃথিবীর সামনে ভারত চেতনা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। নইপল মুক্তকণ্ঠে যেমন ভারতীয় সম্ভাবনাকে আলোকপাত করেছেন, তেমনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর ঋণাত্মক অধ্যায়কে তুলে ধরেছেন। চমকে দেবার অভিপ্রায়ে নয়। নিমোর্হ দৃষ্টিতে। ইতোমধ্যে ২৩টির বেশি গ্রন্থ লিখেছেন। অবশ্যই ইংরেজিতে। পেয়েছেন অজস্র স্বীকৃতি। তাঁর ‘বিয়ণ্ড বিলিফ ইসলামিক এক্সারশনস এমাং দ্য কনভারটেড পিপলস’ বইটির তের বছর আগে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত ‘এমাং দ্য বিলিভারস’ গ্রন্থটি বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিল। নইপলকে বলা হয় এই যুগের নীতিবান ইতিহাসবেত্তা। সাহিত্যেক মূল্যবোধের বিচারে যিনি কিছুটা রক্ষণশীল। কিন্তু নইপল নীতির প্রশ্নে আপসহীন হলে রক্ষণশীলতার নিরিখে কোনো নতুন রীতি-নীতি গ্রহণে রাজি নন। সমারসেট মমে’র ভক্ত নইপল নিজেই আজ সমসাময়িক ইংরেজি লেখকদের আদর্শ। নইপলের দৃঢ় বিশ্বাস ইদানীংকালের সাহিত্যে বিশেষত উপন্যাসে কোনো অনুপ্রেরণা-উত্তেজনা নেই। সিনেমা পরিচালকদের কাজে ঢের বেশি সৃজনশীলতা দৃশ্যমান। মেধার বিচারে হালের উপন্যাসিকরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন।
এই তাত্ত্বিক দর্শন সেই ১৯৬৪ সাল হতেই নইপল আঁকড়ে আছেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন পশ্চিমা সাহিত্যের নিরিখে ভারতীয় সাহিত্যকদের পশ্চাৎপদতার বিভিন্ন যোগসূত্র। এই যুক্তি যারা মোটেও মানতে পারেন নি তাদের মধ্যে সালমান রুশদি ছিলেন অন্যতম। যিনি নিজেই প্রমাণ করেছেন সাহিত্যের উপন্যাসের চলতি ধারাকে বদলে ফেলা অসম্ভব নয়। তবে একটি বিষয়ে নইপল ও রুশদি এই দুই শ্মশ্রুমণি্ডত ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক একমত হয়ে স্বীকার করেছেন, ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের মূল গতিধারা মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অতি রহস্যময়তার কারণে। আর এই উপলব্ধিজাত ঐকমত্যকে ভিত্তি দেওয়ার জন্যই অন্যান্য ভারতীয় লেখকেরা যেন এক জোট হয়েছেন। ক্রমশ সক্রিয়হয়ে এগিয়ে এসেছেন ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যরীতি আমূল বদলে দেওয়ার প্রত্যয়ে।