Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কথোপকথন : দক্ষিণ এশিয়ার ৫ ডায়াসপোরা লেখক


৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:৫৫

অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন ।।

[ডায়াসপোরা শব্দটি গ্রিক। dia মানে দূরে, ‘speirein’ অর্থ ছড়িয়ে পড়া। ডায়াসপোরা পরিস্থিতিতে বাস করছেন অর্থাৎ কোনো কারণে নির্বাসনে থেকে বা জীবিকার অন্বেষণে নিজ দেশ ছেড়ে ভিনদেশে বাস করছেন এমন পরিস্থিতিতে কোনো লেখক যে সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করেন সেটিই ডায়াসপোরা সাহিত্য। এই মুহূর্তে চীনের পর ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তর ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে আমাদের সামনে আছে। ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখক হাইব্রিড আইডেনটিটি নিয়ে তাদের সৃজনশীলতার ভেতর দিয়ে ডায়াসপোরা জীবনের নানা বাস্তবতাকে উঠিয়ে আনছেন। নিন্মোক্ত আড্ডায় দক্ষিণ এশিয়ার ৫জন তরুণ ডায়াসপোরা লেখক পূজা মাখিজানির সঙ্গে ডায়াসপোরা লেখক হিসেবে নানাসংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রত্যেকের ২০১৮ সালে একটি করে উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আড্ডায় অংশ নিয়েছেন সন্ধ্যা মেনন (প্রকাশিত উপন্যাস ‘টুইঙ্কেল, উইথ লাভ’), শেবা করিম (প্রকাশিত উপন্যাস ‘মরিয়াম শর্মা হিটস দ্য রোড’), তানাজ ভাথেনা (প্রকাশিত উপন্যাস ‘এ গার্ল লাইক দ্যাট’), সায়ন্তনী দাশগুপ্ত (প্রকাশিত উপন্যাস ‘দ্য সার্পেন্ট’স সিক্রেট’) এবং নিশা শর্মা (প্রকাশিত উপন্যাস ‘মাই সো-কলড বলিউড লাইফ’)।]

পূজা মাখিজানি : দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য বলতে তোমরা আসলে কি বোঝো?
সায়ন্তনী দাশগুপ্ত : দক্ষিণ এশিয়া একটা ভৌগোলিক ধারণা যেখানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান আছে। যখন আমি ‘দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য’ কথাটা শুনি তখন এসব অঞ্চলের স্বদেশি লেখকদের কথা আমার মনে আসে। এই অঞ্চলের ডায়াসপোরা লেখকদের কথা মনে আসে না। এক্ষেত্রে অনেকে দেখি ‘দেশি’ শব্দটা ব্যবহার করেন। আমার ‘দেশি’ শব্দটা পছন্দ, কারণ এ শব্দ থেকে এই অঞ্চলের বসবাসকারী লেখকদের পাশাপাশি ডায়াসপোরা লেখকদের কথা মনে আসে।

বিজ্ঞাপন

শেবা করিম : আমিও সায়ানতানির মতো বলবো দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য বলতে আমি সার্ক অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর দেশিয় সাহিত্য বুঝি। দেশিয় সাহিত্যের পরিসরটা এই অঞ্চলে অনেক বিস্তৃত; যেমন ভাষা তেমন আইডেন্টিটির দিক থেকেও অনেক বৈচিত্র্য আছে।

নিশা শর্মা : আমার কাছে বিক্রম সেথের উপন্যাস ‘এ সুইটেবল বয়’, যেটা ১৯৫০-এর দশকের ভারতকে উপজীব্য করে লেখা, আবার তনুজা দেশাই হিদিয়ারের ‘বর্ন কনফিউজড’, যেটা নিউ জার্সির প্রেক্ষাপটে লেখা, উভয় উপন্যাসই দক্ষিণ এশীয় সাহিত্যভাণ্ডারের সম্পদ বলে মনে হয়। উপন্যাস দুটির সেটিং ভিন্ন, লেখকও ভিন্ন দুটি মহাদেশের কিন্তু দুটি উপন্যাসের গল্পের শিকড়টা গেঁথে আছে দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠী এবং সংস্কৃতির ভেতর।

পূজা : তোমরা দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য থেকে কোন বইটা প্রথম পড়েছ? লেখক হিসেবে সেই পাঠ থেকে তোমাদের উপলব্ধি কেমন ছিল?

তানাজ ভাথেনা : আমি সৌদি আরবে ভারতীয় স্কুলে পড়েছি। আমার সৌভাগ্য বলতে হবে, সে স্কুল লাইব্রেরিতে দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য পেয়েছি। শিশু হিসেবে ছোটগল্প, বিশেষ করে টিঙ্কেল ডাইজেস্ট নামের কমিক সিরিজ পড়ে খুব মজা পেয়েছি। সুপান্ধি, শিকারি, শম্ভু এবং কালিয়া আমাদের কাছে আর্কি, ভেরোনিকা এবং বেটির মতোই জনপ্রিয় ছিল। কিশোর বয়সে আমি নিজেও লিখতে শুরু করি। আমি নিজে রাসকিন বন্ড এবং আরকে নারায়ণের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। সেসব বইয়ে নিশ্চয় কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন জরথুস্ট্রপন্থা হিসেবে আমি সেসব সাহিত্যে আমার সম্প্রদায়ের কোনো বিষয়আশয় দেখিনি। পরে বাপসি সিধোয়া, রহিনটন মিস্ত্রির লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সৌদিতে দক্ষিণ এশিয়া থেকে পড়তে আশা কিশোরীদের নিয়ে আমি কিছু গল্প লিখি, সেখান থেকে একটি গল্পকে আরও বিস্তৃত করে উপন্যাসে দাঁড় করাই।

বিজ্ঞাপন

শেবা : আমি যুক্তরাষ্ট্রে বড় হয়েছি। মনে পড়ে খুব অল্পবয়সে ‘সিক্রেট গার্ডেন’ (হডসন বার্নেট রচিত উপন্যাস) পড়ে খুব আপ্লুত হয়েছি সেখানে শুরুর দিকে হিন্দি/উর্দু শব্দ ‘আয়া’ আছে দেখে। শব্দটা পেয়ে দৌড়ে গিয়ে মাকে দেখাই। কিন্তু সেখানেও দুঃখের বিষয় হলো ভারতের কথা মাত্র শুরুর কয়েকপৃষ্ঠায় আছে তাও আবার মৃত্যু ও মহামারির দেশ হিসেবে। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো চরিত্রকে কেন্দ্র করে লিখিত একমাত্র বই আমি পড়ি ‘দ্য জাঙ্গল বুক’। ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব ডুম’-এ ভারতীয়দের ‘ব্রেইন-ইটিং স্যাভেজ’ হিসেবে উপস্থাপন দেখে একইসঙ্গে আপ্লুত এবং লজ্জিত হয়েছি। আর দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যের ভেতর রুশদির ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ এবং বাপসি সিধোয়ার ‘ক্র্যাকিং ইন্ডিয়া’ পড়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি।

নিশা : শেবা, আমার মনে পড়ে, শিশুরা আমাকে জিজ্ঞেস করতো ভারতীয়রা কেমন এবং ভারতীয়তা সত্যি সত্যি ইন্ডিয়ানা জোনস-এ যেভাবে দেখানো হয়েছে তেমন কিনা জানতে চাইত। মুভিটা যখন দেখি তখন মনে হয়েছিল, কি ছাইপাশ তৈরি করেছে! আবার একইসঙ্গে হলিউড মুভিতে অমরেশ পুরিকে অভিনয় করতে দেখে গর্বও হচ্ছিলো। কখনো কখনো বাজেভাবে উপস্থাপন দেখেও মনে হয়, বেশ; আমরা সেখানে আছি তো!

সন্ধ্যা : আমি ভারতে বেড়ে উঠেছি, দেখেছি সেখানেও একটা শ্রেণিপ্রভাব গড়ে তোলা হয়েছে। স্টিফেন কিং এবং রবিন কুকের বইগুলো সবখানে পাওয়া যেত। ভারতীয় লেখকদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক দামে সেগুলো বিক্রি হতো। আমার মাসি যেদিন আমার হাতে অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ তুলে দিলেন, বইটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল, আমার মনে হলো পৃথিবী এখন ভারতীয় নারীদের লেখা পড়তে চায়। তখন নিজের কণ্ঠস্বরকে যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে মূল্যবান বলে মনে হল।

সায়ন্তনী: ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ পড়ে আমারও ভালো লেগেছিল। আমি বেড়ে উঠেছি যুক্তরাষ্ট্রে। তখন যে বইগুলো পড়ে আমার ভালো লাগতো সেখানে আমার নিজস্ব পরিচিতির সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। আমি সেখানে অনুপুস্থিত। সেখানে কোনো শ্যামলা মেয়েকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করার কথা ভাবা হতো না। যে কারণে ‘স্টার ওয়ারস’ এবং ‘স্টার ট্রেক’-এর মতো কল্পকাহিনিভিত্তিক সিনেমা দেখতো আমার ভালো লাগত, কারণ সেখানে দূর ভিনগ্রহে অন্তত আমার মতো কাউকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এরপর আমি এলিস ওয়াকার, পাওল মার্শাল, হুলিয়া আলভারেস এবং এসাবেল অ্যালেন্দ-এর মতো লেখকদের বই পড়তে শুরু করি। তাঁদের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। সালমান রুশদি আমার প্রথম দিকে পড়া দক্ষিণ এশিয়ার প্রিয় লেখক। তাঁর লেখায় প্রচুর অব্যাখ্যাত হিন্দি ও উর্দু শব্দ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক উপাদান থাকে। রুশদির বই পাঠক হিসেবে কেবল আমার ভেতরের সম্ভাবনাগুলো জাগিয়ে তোলে না, পাশাপাশি লেখক হলে আমি কেমন হতে চাই তার একটা আদর্শিক পথও দেখিয়ে দেয়।

নিশা : যেহেতু আমি ভারতীয় কত্থক নৃত্যে প্রশিক্ষিত হচ্ছিলাম, তখন শ্রেণিকক্ষে ভারতীয় পুরাণ পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেব-দেবী, লোকসংস্কৃতি এবং রাজা-রানিদের প্রেমকাহিনি পড়তে হয়। বিশ বছর বয়সে এসে আমি সাহিত্যে আধুনিক প্রেমকাহিনিনির্ভর গল্প খুঁজি যেখানে দক্ষিণ এশিয়াকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তখন আমি লেখক হিসেবে এই শিল্পের একটা অসম্পূর্ণতা টের পাই। এই অসম্পূর্ণতা ছিল বলেই হয়ত আমি নিজে এই বিভাগে লিখতে শুরু করি।
পূজা : দক্ষিণ এশিয়া বা দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরাভিত্তিক কোনো আখ্যান লেখার তাগাদা তোমরা অনুভব করেছ কিনা?

সায়ন্তনী : একক গল্পের বিপজ্জনক দিক নিয়ে চিমামানদা আদিচির বক্তব্য আমার ভালো লেগেছে। আমি মনে করি, দেশিদের নিয়ে, বিশেষ করে দেশি নারীদের নিয়ে একক গল্প হলো, মানুষ যেটা মনে করে, তাদের নির্যাতনের শিকার জীবন এবং সামাজিক অবদমন। আমি বলছি না এটা দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ বাস্তবতার অংশ না। কিন্তু আমি মনে করি আমাকে যেভাবে বলা হয়েছে তার ভিতর একটা সমস্যা আছে। আমি যখন শ্যামলা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প লিখছি তখন আমাকে বলা হচ্ছে বাস্তবধর্মী গল্প লিখতে যেখানে গল্পের নায়িকা তার স্বাধীনতার প্রশ্নে নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আমি এমন নিষ্ঠুর বাবা-মা এবং সন্তানের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের কথা লিখতে চাই না। কারণ আমার অভিজ্ঞতায় সেটা নেইও।

তানাজ : আমি প্রথম প্রজন্মের কানাডীয় অভিবাসী। সৌদি আরবে দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের অবস্থা নিয়ে উপন্যাস লিখেছি। আমাকেও সায়ানতানির মতো একটা ঘরানায় বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার উপন্যাসের প্রেক্ষাপট সৌদি আরব শুনে এজেন্টরা খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু ওরাই আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো যখন জানল আমি সৌদি নই, কিংবা আমি মুসলমান না। আমি জেদ্দা এবং রিয়াদে ১৫ বছর বসবাস করলেও ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে এক প্রকাশক বললেন বইটির সেটিং মুম্বাই করে দিতে। এই কারণে আমার পাঁচ বছর লেগেছে বইটির প্রকাশক পেতে। কিন্তু আমি আমার গল্পে বিশ্বাস রেখেছি বলে শেষ পর্যন্ত যেভাবে লিখেছি সেভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় বলে নিজেকে আমি কোনো নির্দিষ্ট গ-ির ভেতর বেঁধে ফেলিনি।

শেবা : যখন আমার এজেন্ট এক প্রকাশকের কাছে ‘দ্যাট থিং উই কল এ হার্ট’-এর পা-ুলিপি পাঠালেন, তিনি দেখে লিখলেন, ‘আমি পড়ে খুব আপ্লুত হয়েছি কারণ আমি মুসলিম বুক প্রকাশ করতে চাই।’ ‘মুসলিম বুক’ শব্দবন্ধনীটা আমি নিতে পারিনি, এমন করে তিনি বললেন যেন ‘মুসলিম’ বুক বলে সাহিত্যে আলাদা জন্রা আছে। সমস্যা হলো প্রকাশকদের অধিকাংশ শে^তাঙ্গ এবং ওঁদের অনেকের ধারণা জাতিগত সাহিত্য বলে কিছু একটা আছে, যা আমি নিজে কল্পনাও করতে পারি না।

সন্ধ্যা : এটা খুব হাস্যকর যে বিশ্বায়নের এই পর্যায়ে এসেও লোকজন আমাদের কাছ থেকে আমাদের জীবনের সেই একই পুরানো গল্প শুনতে চান। আমি চাই লোকজন দেখুন আমরা হাসছি, ভালোবাসছি, স্বপ্ন দেখছি, স্বপ্নের পেছনে তাড়া করে চলেছি। আমি চাই গল্পে ভ্যাম্পায়ার এবং নেকড়েরা হোক ভারতীয় আমেরিকান। এবং আমি চাই গল্পের (এবং বাস্তবেও) মার্কিন রাষ্ট্রপতি হোক ভারতীয় আমেরিকান কেউ। অথবা নারী। অথবা সমকামি। আমি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে চাই না যতক্ষণ না তার বাস্তবায়ন ঘটে।

নিশা : একবার এক সম্পাদক আমাকে বললেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য বিক্রি হতে পারে যদি সেটা বাস্তবতার বিশ্বস্ত বয়ান হয়। একটা সম্মেলনে এক এজেন্ট বললেন, দক্ষিণ এশিয়ার লেখকদের জন্য ইয়াং অ্যাডাল্ট ফিকশন লেখা মানে হলো সময় নষ্ট করা। কারণ তার ধারণা দক্ষিণ এশিয়ার কিশোর-কিশোরীরা কিংবা তরুণ-তরুণীরা উপন্যাস-গল্প পড়ে না। আমার বইয়ের প্রথম এজেন্ট শুরুতে আমার গল্পটি পছন্দ করেছিলেন, এরপর তিনি বললেন, তিনি উপন্যাসটি ছাপতে পারবেন তখনই যখন আমি গল্পের নায়ককে শেতাঙ্গ করে দেবো। বিপরীত চরিত্রে ভারতীয় মেয়েটি বাবা-মার সঙ্গে নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় থেকে বের হওয়ার জন্য যুদ্ধ করবে। শে^তাঙ্গ নায়ক তাকে উদ্ধার করে আনবে। এরপর তাদের মিলন হবে। এভাবে আমার কাছ থেকে বিশেষ ধরনের আখ্যান লেখার প্রত্যাশা আমি টের পাই। এই কারণে বেশ কয়েকবছর আমি কিছু লিখতে পারিনি। আমাকে সচেতনভাবে অন্যের প্রত্যাশা থেকে বের হতে হয়েছে। নিজের জন্য যে প্রত্যাশা আমি নিজের কাছে রাখি, সেটাই শেষপর্যন্ত বাস্তবায়ন করার জন্য লিখেছি।

সায়ন্তনী : আমি একইসঙ্গে বিস্মিত এবং দুঃখিত হচ্ছি যেনে যে, দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যকে একটা নির্দিষ্ট ছকে ফেলে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ধরনের গল্প আমাদের কাছে চাওয়া মানেই হলো ঔপনিবেশিক সেই অবস্থার এখনো পরিবর্তন হয়নি, তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক যেমনটি বলছেনÑ ‘সাদা চামড়ার নায়ক শ্যামলা বর্ণের নায়িকাকে শ্যামলা বর্ণের লোকের হাত থেকে উদ্ধার করবে’। কিন্তু আমাদের উদ্ধার করার জন্য কারও দরকার নেই। আমরা নিজেদের উদ্ধার করতে পারলেই খুশি।

নিশা : ‘মাই সো-কল্ড বলিউড লাইফ’ উপন্যাসে আমার নায়িকা বলে, আমাকে কোনো নায়কের উদ্ধার করার দরকার নেই। আমিই আমার নায়ক। দেশি মেয়েরা শক্তিশালী, দৃঢ়চেতা। আমি প্রেমের বই পড়ি, আবার আমি রাজনৈতিক কর্মীদের মতো মাঠে নেমে ধর্ষণ-ঘটনার প্রতিবাদ করি। কেন আমি বা আমাদের কেউ এখান থেকে বা বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলে থেকে সেই পুরানো গল্প লিখব, যেটা থেকে আমরা বের হওয়ার চেষ্টা করছি!

পূজা : তোমরা তোমাদের উপন্যাসের গল্পটা পেলে কিভাবে? কেন এই গল্পটাই বলতে চাইলে?

তানাজ : লেখালেখি আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে নিজের আবেগ ও চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম। আমি যখন লিখতে শুরু করেছি তখন বাজারে কোনটা চলে, কোনটা আগে থেকে আছে, এজেন্টরা কোন ধরনের গল্প চায়Ñ এসব ভেবে লিখিনি। আমি যে ধরনের বিষয় নিয়ে লিখি, তাতে সৌদি আরবে আমাকে সবসময় সতর্র্ক থাকতে হয়েছে। আমার কখনো মনে হয়নি আমি আমার গল্পের প্রতি পরিপূর্ণ সৎ থাকতে পারব। আমি চেয়েছি সেন্সর না করে যেভাবে গল্পটা বলা প্রয়োজন সেভাবে লিখতে। লিখতে হলে ঝুঁকি নিতে শেখাটা গুরুত্বপূর্ণ।

শেবা : আমি প্রথম উপন্যাসে আমেরিকায় নিজের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছি। উপন্যাসের গল্পটা আমি নিয়েছি আমার লেখা একটা ছোটগল্প থেকে। গল্পটি আমি ভারতীয় এক সংকলনের জন্য লিখি, যেখানে গল্পের কথক উর্দু কবিতার ভেতর আশ্রয় গ্রহণ করে শান্তি খুঁজে পান।

সন্ধ্যা : তানাজ, তোমার নিজের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করা এবং ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়টি আমার ভালো লেগেছে। আমি যখন ‘হোয়েন ডিম্পল মেট রিশি’ লিখি, তখন আতঙ্কে ছিলাম। আমি ইয়াং এডাল্ট রোমান্স কমিডির বরাবরই খুব ভক্ত। কিন্তু কখনো ভাবিনি নিজেই একদিন লিখবো। আমি ভারতীয় আমেরিকান সংস্কৃতি নিয়ে এত খোলামেলাভাবে আগে কিছু লিখিনি। বিভিন্নভাবে এটা আঁৎতে ওঠার মতো। ভেবেছিলাম আমার মিউমর এবং স্বরটা অনেকে বুঝতে পারবেন না। পাঠকের ইতিবাচক সাড়া পেয়ে আশাবাদী হয়েছি।

সায়ন্তনী : ‘দ্য সারপেন্ট’স সিক্রেট’ উপন্যাসটি ছোটবেলায় শোনা বাংলা লোককথা অবলম্বনে লেখা। মেয়ে হিসেবে আমি যে ধরনের মজা এবং দুঃসাহসিকতা চেয়েছি কিন্তু পাইনি, সেগুলো এখানে আছে। এখানে শ্যামলা বর্ণের নায়িকা দুষ্টু এলিয়েনদের সাথে যুদ্ধ করছে। বাংলা লোকগল্পের মহৎ দিকটা হলো এগুলো কোনো নির্দিষ্ট জাতীগোষ্ঠী বা ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না। ভারতীয় বাঙালি, বাংলাদেশি বাঙালি, ডায়াসপোরা বাঙালি আবার হিন্দু-মুসলিম-অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সকলে যে কারণে এই লোককথা, উপকথাগুলো জানে এবং উপভোগ করে। আমি দক্ষিণ এশিয়ার এই ঐক্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে উপন্যাসটা লিখেছি।

সন্ধ্যা : আমি ভীষণভাবে বিশ্বাস করি, শিল্প থেকে শিল্প সৃষ্টি হয়। নিজে শিল্পের সবধরনের মাধ্যম থেকে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা গ্রহণ করি। আমি ভাগ্যবান যে দুই সংস্কৃতিরÑ দক্ষিণ এশিয়া এবং আমেরিকা, শিল্প বোঝার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি সবখানেই ভালোবাসা আছে।

সারাবাংলা/পিএম

ডায়াসপোরা লেখক তানাজ ভাথেনা নিশা শর্মা পূজা মাখিজানি শেবা করিম সন্ধ্যা মেনন সায়ন্তনী দাশগুপ্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর