সুখলালের সুকতলা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৫:৩৮
অরুণ কুমার বিশ্বাস ।।
সুখলাল আদতে তেমন সুখীজন কেউ নয়, সুখের মানে কী সে বোধ করি ঠিক জানেও না, বরং তার মনে খুঁতখুঁতে ভাবখানা গদের আঠার মতো সারাক্ষণ সেঁটে থাকে। সে চারপাশে কোত্থাও এতটুকু সুখের আয়োজন খুঁজে পায় না। তার খালি খিদে পায়, আর সুখলালের সবচে পছন্দের খাবার হল গরম ভাতের সঙ্গে গাওয়া ঘি দিয়ে একটুখানি সুক্তো। কারণ ডাক্তারবাবু গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলেছেন, সুখুবাবু, তোমার শরীরে লোহার বড্ড কমতি পড়েছে। তাই নিয়মিত তোমাকে কচুর সুক্তো খেতে হবে, নইলে তুমি এই ধরাধামে বেশি দিন নেই কিন্তু।
ব্যস, সেই থেকে কচুর শাক আর মানকচু দেখলেই সসম্মানে মাথা নাড়ে সুখলাল। তার যত সুখের আকর এখন এই মানকচুতে আর কচুর সুক্তোয়। কচুতে প্রচুর লোহা মানে আয়রন আছে। নিয়মিত কচু ভক্ষণের মধ্য দিয়ে সুখলাল একদিন আয়রনম্যান হবার স্বপ্ন দেখে। মজার ব্যাপার কী জানেন তো, আমাদের সুখলাল কক্ষণো কেরানি হতে চায়নি, বরাবরই তার সওদাগরি জাহাজের মাঝি অর্থাৎ সুকানি হবার বাসনা ছিল। পানি তাকে বড্ড টানে। সুকানি হতে পারলে আর কোনো কষ্টই থাকতো না বেচারা সুখলালের জীবনে।
কেরানিগিরি মানেই ঘাড়গুঁজে কলম পেষা। কথা কম কাজ বেশি, যত বেশি কাজ করবে বসের কাছে সেই কেরানির কদর তত বেশি। অনর্গল চোপা চালানো কেরানিকে বসরা একদম দেখতে পারেন না। সেই অর্থে খুব উৎকৃষ্ট মানের কেরানি হতে পেরেছে সুখলাল। কারণ সে স্বভাবতই মিতভাষী। তার চিকন চেহারায় চেকনাই খুব একটা নেই। থাকবে কী করে! তার শরীরে যে লোহার বড্ড টানাটানি! এই নিয়ে সুখলাল মেলা ভাবনাচিন্তা করে। তবে শত ভেবেও থই পায় না খুব একটা। তাকে কচুমুখী হতে হয়।
সুখলালের একুনে দুজোড়া জুতো। একটি নাগরা, আর অন্যটি ফিতাবিহীন পাম্প শু। জুতোর ফিতা বাঁধায় ভয়ানক আপত্তি তার। জুতের মুখে পা নিলেই কপাত করে ভেতরে সেঁধিয়ে যাবে এমন জুতো চাই। শুধু জুতোর ফিতে নয়, সব রকম বন্ধনেই ঘোর আপত্তি সুখলালের। কারণ সে মেলা গবেষণা করে এইটুকু অন্তত বুঝেছে যে বন্ধন মানে দুঃখ।
এই যে তার বস, তার মেলা বন্ধন। কিন্তু তার মনে সুখ নেই। বড় বড় লোকের সাথে তার নিত্য ওঠাবসা। খানাদানার কমতি নেই। কিন্তু বস খেতে পারছেন কই! তার কোলনে কোলাইটিস। কিছু একটু মুখে দিলেই পাকস্থলী ত্রাহি ত্রহি করে ওঠে। বিশাল বপু তাই ছুটতে পারেন না। তার শরীর বাড়ে, কিন্তু মননের পরিসর আর বাড়ে না। তিনি রাতের অন্ধকারে হারিকেনবাতি জ্বেলে প্রাণান্ত হয়ে সুখের খোঁজ করেন, কিন্তু সুখের নাগাল তিনি পান না।
সেই তুলনায় সুখলাল বেশি সুখী। যদিও সুখ জিনিসটাই বড্ড আপেক্ষিক। বিচিত্র মানুষের ভিন্ন ভিন্ন কারণে সুখানুভূতি হয়। কেউ মদ বেচে দুধ কিনে খায়, আবার কেউ দুধের বদলে মদ কিনে আনে। সুখলালের পাশের পল্লীতে থাকেন এক জাঁদরেল মানুষ। কানাঘুষায় শোনা যায়, এই দুনিয়ায় তার কিছুর অভাব নেই। সবকিছু তার প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ তিনগুণ করে আছে। এমন কি, তার বউও তিনখানা। আর গোলমালটা বেঁধেছে সেখানেই। বউয়ের অত্যাচারে ভদ্রলোক বাসায় তিষ্ঠাতে পারেন না। তাদের ভালোবাসার বেগ এত বেশি যে, বেচারা প্রেমের তোড়ে কোথায় ভেসে যান কে জানে!
সুখলাল নিজেও খুব যে বেশি সুখী তা কিন্তু নয়, কারণ তার সংসারে টাকার টানাটানি। অনেকে অসুখী হয় টাকা না থাকার কারণে, আবার কারো অসুখ করে টাকা বেশি থাকার জন্য। ‘টাকার গরম’ বলে একটা কথা আছে। এই গরম যেমন জ্বালায়, তেমনি পোড়ায়ও। একেবারে কণ্ঠনালী অব্দি পুড়ে যায়, ফলে নারীসঙ্গ লাভ কিংবা সুস্বাদু খাবার- কিছুই আর গলধঃকরণ করা যায় না।
সুখলালের ইদানীং খুব দুঃখ হচ্ছে। যাকে বলে কষা দুঃখবোধ। কারণ তার জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে চৌপট হবার জোগাড়! সুকতলা ক্ষয়ে ক্ষয়ে তার মনে বেজায় দুঃখ পয়দা হয়। মামুলি কেরনি সে, শরীরে লোহার জোগান দিতে এত এত কচু আর কচুর শাক কিনতে হয় যে, জুতোর সুকতলা সারাবার টাকা আর জমে না সুখলালের।
যেই ভদ্রলোকের তিনটে বউ, তার একটু স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছে হয়। হোক না কুঁজো, তার বুঝি চিৎ হয়ে শোবার বাসনা জাগে না! তিন বউয়ের ছখানা হাতের দলাইমালাই তাকে নিত্য খেতে হয়। খিদে পাক বা না-পাক, এদের অখাদ্য রান্না তাকে গিলতে হয়। কারোটা না খেলেই সে অভিযোগের আঙুল তোলে যে সে অপেক্ষাকৃত পুরতান তাই তাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। এক্ষুনি সে কোর্টে যাবে, তার বিরুদ্ধে মানিস্যুট মামলা করবে! বোঝো ঠেলা!
সুখলালের দিন কাটে সুকতলার শোকে, আর বসের রাত কাটে টাকার ধান্ধায়। এমন নয় যে তার টাকার খুব অভাব, আসলে তার স্বভাবটাই গেছে বিগড়ে। নিত্যনতুন টাকার গন্ধ না শুঁকলে তার ঘুম আসে না। বা এলেও রাতে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন। বস দেখতে পান, কে যেন তার কলিজাটা ধরে হ্যাঁচকা টানে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বস যথাসময়ে তার উপরঅলার ‘খাই’ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ এই উপরি কামাই আর উপরঅলার ধস্তাধস্তিতে বেচারা বসের কাম তামাম। তার জীবন থেকে সুখ জিনিসটা বিসর্জিতপ্রায়।
ওদিকে যে ভদ্রলোকের তিনখানা বউ, তার প্রায় সকলেই ক্ষুধার্ত। তাই তাদের দাবিদাওয়া মেটাতে তিনি খাবি খান। মানিস্যুট মামলার পৌনঃপুনিক হুমকিতে চরম হতাশায় আর ভয়ের মধ্য দিয়ে তার দিন কাটে, বেশুমার নারীসঙ্গ পেলেও তার সুখ আর পাওয়া হয় না। আসলে তার জীবনখানা বাহুল্যদোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে। তিনি এসবের থেকে মুক্তি চান। অথচ তিনি মুক্তি পান না। নর্দমার ময়লা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে যে!
সুখলালের সুকতলার অভাব যেমন ঘোচে না, তেমনি বসের প্রতি নিদ্রাদেবী সদয় হন না। বস মুঠোভর্তি সিডেটিভ খান, খান না আসলে তিনি পানি দিয়ে গেলেন, তাতেও তার ঘুম ভাল হয় না, মাঝরাতে আচমকা উপরঅলার কাল্পনিক খাঁমচি খেয়ে হুড়মুড়িয়ে জেগে ওঠেন। আবার তার গলা শুকায়, তিনি জগ থেকে ঢক ঢক করে পানি গলায় ঢালেন। এতেই তার সুখের বাসনা আপাতত তিরোহিত হয়।
সুখ আসলে কী! কোথায় থাকে সে! কে সুখী হয়, আর কে হয় না! বস্তুত, এ এক জটিল প্রশ্ন। সুখের নাগাল যে পায় সেই পায়। প্রেমের যেমন নির্দিষ্ট কোনো ফরমুলা বা ধারাপাত নেই, সুখেরও নেই। মেলা মুলামুলি করেও অনেক সময় জেতা যায় না, আবার যারা দোকানির উপর নির্ভয়ে ভরসা রাখে, শেষত সে-ই জিতে যায়। আবার এমনও আছেন কেউ কেউ সুখে থাকতেও তারা শখ করে ভূতের কিল খায়। ছিল একখান বউ, জুড়লেন আরো দুখানা। তারপর তিনজনের সম্মিলিত চুলাচুলি কিলাকিলির ‘রেফারি’ হয়ে কাটিয়ে দিলেন বাকি জীবন।
আসলে সুখী হতে হয়, সুখ কারো উপর ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে এসে পড়ে না। সুখলাল জাহাজের সুকানি হতে চেয়েও পারেনি- এই তার দুঃখ। আবার তার জুতোর সুকতলা খসে গেছে, তাতে তার দুঃখের অবধি নেই। কত ছোট্ট কারণে আমরা অসুখী হয়ে যাই! অনেকের অনেক আছে, অনেকে আছে, তাও তারা সারাক্ষণ হা-পিত্যেশ করে। আহা, আরো কিছু বেশি থাকলে ক্ষতি কী ছিল!
স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বলেছেন, নেতা সেজো না নেতা হও, ঠিক তেমনি সুখের অভিনয় নয়, সুখী হতে শেখো। তাহলেই সুখলালের সুকতলা বা সুকানি হতে না পারার দুঃখ ঘুচবে। সে বাস্তবিক সুখের মুখ দেখবে।
সারাবাংলা/পিএম