উড়াও শতাবতী (১৪) || মূল: জর্জ অরওয়েল || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
২ নভেম্বর ২০১৮ ২০:৫৭
রুমটা এখন বেশ উষ্ণ বলেই বোধ হচ্ছে গর্ডনের। চা আর সিগারেট তাদের স্বল্পায়ুর জাদু দেখিয়েছে বটে। বিরক্তি আর ক্রোধেরও কিছুটা উপসম ঘটেছে। একটু কাজে বসা উচিত? হ্যাঁ কাজই তো বটে! আর তা করতেও হবে। ইচ্ছা-অনিচ্ছার দোলাচলে চেয়ারটি টেবিলের কাছে টেনে বসলো সে। কাগজের এই ভয়াবহ দঙ্গল সরিয়ে কাজে বসাটাও আজকাল একটা মেহনতের কাজ। কয়েক টুকরো কোচকানো কাগজ নিজের দিকে টেনে আনলো গর্ডন। ওগুলো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে কড়া দৃষ্টি ফেললো। হা ইশ্বর! এমন অগোছালোও হতে পারে কারো লেখালেখি! একবার লিখে তা কেটেছে, ফের লিখেছে, আবার কেটেছে, আবার লিখে আবারও কেটেছে। বিশবার ছুরির নিচে কাঁটাছেঁড়ার পর বেচারা বুড়ো ক্যান্সার রোগীটির যেমন দশা হয়, ঠিক তেমনই তার এক কাব্যায়বব। তবে যেসব জায়গায় কাটা পড়েনি, সেখানে সেখানে হাতের লেখাগুলো বেশ সুন্দর, সুস্পষ্ট। বিদ্যানের ছাপ বিদ্যমান। সকল বেদনা আর ঝুট-ঝঞ্ঝাট মোকাবেলা করতে করতে হস্তলেখার এই বিদ্যাপতির হাতটি রপ্ত করেছে গর্ডন। স্কুলে কপার-প্লেটের ওপর ছেলেবেলায় যে লিখতে শিখেছে তার চেয়ে অনেক অন্নরকম কিছু। কিছুটা কাজ হয়তো গর্ডন করতোই কিন্তু গতরাতে লিখে রাখা কবিতার চরণ ক’টি সমেত কাগজটি টেবিলজুড়ে হাতড়িয়ে ঠিক হদিস করতে পারলো না।
বেশ বড়সড় একটি কবিতাই সে লিখতে বসেছে। হাজার দুয়েক শব্দ লিখেও ফেলেছে। রাজকীয় ছন্দে লন্ডনের একটি দিনের বর্ণনা। নাম দিয়েছে লন্ডনানন্দ। উচ্চাভিলাসী প্রকল্প বটে এক! অফুরান অবসর না থাকলে এমন কাজে হাত দেওয়া কঠিন। কাজটা শুরু করার সময় বিষয়টি গর্ডনের বোধে ধরেনি। কেমন একটা হালকা মনে শুরু করেছিলো, তাও বছর দুয়েক আগে। ওই সময়টিতে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ভীষণ দারিদ্রের মাঝে পতিত সে। অতএব তার নিজের ভাবগতিকটাই হয়ে গেলো কবিতার প্রতিপাদ্য। একসময়তো নিশ্চিত করেই মনে হতে লাগলো তারই প্রতিচিত্র এই কবিতা। কি করে যেনো প্রথম দিকেই লন্ডনানন্দ তাকে পেয়ে বসলো। ধীরে ধীরে কবিতার লেজ এত বাড়াতে লাগলো যে তার পক্ষে সামলানোই মুশকিল হয়ে পড়লো। সেটাই সত্য। কখনোই একটি তালে টানা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাতে লন্ডনানন্দ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়লো। প্রতিটি টুকরো আবার নিজে যে সম্পূর্ণ কিছু তাও নয়, আর সেগুলো জোড়া লাগানোও এক কঠিন ব্রত। এইসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা কাগজগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই কিছু না কিছু ছিন্নভিন্ন কাব্যচরণ রয়েছে যা হয়তো একবার লিখে, ফের কেটে মাসের পর মাস কাটিয়ে ফের লেখা হয়েছে। এর মধ্যে শ’পাঁচেক পঙ্ক্তিও মিলবে না যেগুলোকে চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া যাবে। আর এখন তার সেটুকু শক্তিও নেই যে, ওগুলোকে খুঁজে-পেতে ফের শব্দ জোড়া লাগাবে। এখন কোনও একটি অনুচ্ছেদ নিয়েই হয়তো কিছুটা কাজ করা সম্ভব, এটি কিংবা অন্যটি, যেগুলো হয় এখানে নয়তো অন্যখানে পড়ে রয়েছে সকল দ্বিধাগ্রস্ততা নিয়ে। এটি তার কাছে আর কোনও সৃষ্টি হিসাবে টিকে নেই, এগুলো এখন বরং এক দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে যা নিয়ে তার সংগ্রাম চলছে নিরন্তর। আর অন্যদের জন্য বিষয়টা এমনই- পুরো দুই বছরে সে আসলে এক গাদা ছোট কবিতা ছাড়া আর কিছুই রচনা করতে পারেনি। এই যা কিছু লিখেছে তার মধ্যে কোনোটিতে যে মনে পূর্ণ শান্তি মিলেছে তাও নয়। যখন পারতো না তখন কাজগুলো তার নিজের কাছেই সাধারণ থেকে আরও সাধারণ হয়ে উঠতে লাগলো। মানবকূলে একমাত্র শিল্পীরই সেই বোধটি থাকে যে সে ঠিক ধরতে পারে- যা কিছু সৃষ্টি তার হাতে হয়েছে তা এমন কিছু নয়। তবে এও সত্য কিছু কিছু সময় থাকে যখন কাজ করা যায় না, সম্ভবই হয়ে ওঠে না। পকেটে কড়ি নেই মানে মনে স্বস্তি নেই, তার মানেই হচ্ছে উদ্বেগটা বাড়বে, আর উদ্বেগ বাড়লে তামাকে টান পড়বে- আর তামাকে টান পড়া মানেই হচ্ছে নিজে এক ব্যর্থ মানব-সেই বোধটা স্থায়ী হয়ে মনের মাঝে গেড়ে বসা। আর সবশেষে এই বোধের মানে হচ্ছে-একাকীত্ব, স্রেফ একা হয়ে যাওয়া। সপ্তায় মোটে দুই কুইড (পাউন্ড) কামিয়ে একাকীত্ব ছাড়া আর কী ই আশা করা যায়! আর একাকীত্বের দিনে ভদ্রচিত কোনো পুস্তক কেউ কস্মিনকালেও রচনা করতে পেরেছে বলে তার জানা নেই। যে কবিতাখানি সে গর্ভে ধারণ করেছিলো সেটি আর যাই হোক এই লন্ডনানন্দ ছিলো না। আর এতেও সে নিশ্চিত বটে এই কাব্য কোনোদিন শেষ হবার নয়। যে সব মূহূর্তে গর্ডন কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, সে সময় সে এ ব্যাপারে যথার্থই উপলব্দি করতে পারে।
আবার ঠিক এসব কারণেই সে কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে চলে। এটা যেন তার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। তার এই দারিদ্রদশা আর একাকীত্বের দিনগুলোর ওপর কষাঘাতসম এই কাব্য রচনা। তবে এরই মধ্যে কখনও কখনও সৃষ্টিশীল কিছু করার মুড চলে আসে কিংবা আসার উপক্রম হয়। আজ রাতে এসেছিলো, খানিকটা সময়ের জন্য হলেও এসেছিলো সেই মুড। তবে দুটো সিগারেট ফু্ঁকে শেষ করতে যতটা সময় লাগে ততক্ষণই ছিলো তার স্থায়ীত্ব।
সারাবাংলা/এমএম