রম্যগল্প : দেশ বিক্রি বেশ ডিক্রি
৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:৩৫
অরুণ কুমার বিশ্বাস
সাত সকালে দেশ বিক্রির ধুয়ো শুনে বেচারা যোগেনের নাভিশ^াস ওঠার জোগাড়। নিঃশ^াস একবার নাভিতে প্রবিষ্ট হলে কী হয় জানেন তো! তখন বাঁচা-মরা দুইই সমান। প্রাণপাখি প্রাণপণ ডানা ঝাপটে বলে, আমি এবার যাই যাই। পালাই।
আমাদের এত প্রিয় স্বদেশভূমি, সেটা নাকি কারো কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, মানে পণের বিনিময়ে হাতবদল। এমন না-শুনছি কথা কাঁহাতক সহ্য হয় বলুন! কিন্তু বেচারা যোগেন মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, তার অত বেশি জ্ঞান-গরিমা নেই। তার ভাবনা একটাই- দেশ গেলে খাবে কী, থাকবে কোথায়! মেলা ধারকর্জ করে গেল বছর এক টুকরো জমি কিনে সবে চাষবাস শুরু করেছে যোগেন, এরই মধ্যে দেশ বিক্রির ধুয়ো! মাইরি বলছি, সাধের দেশ অন্যের হাতে গেলে যোগেনরা আর বাঁচবে না। ¯্রফে ধনেপ্রাণে মারা পড়বে।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী। বাংলা তর্জমা করলে, মা ও মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও গৌরবের। সেই দেশ যদি হাতছাড়া হয় তাহলে আমাদের সব আয়োজন-অর্জন বিসর্জনে পরিণত হবে। মাকে নিয়ে দেন-দরবার একদম সঠিক কাজ নয়। এমত ধারণা পোষণ করেন কেউকেটা ধরনের কেউ কেউ। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশ কি আদৌ বিক্রয়যোগ্য! তাও আবার হালের এই কূটনৈতিক উৎকর্ষের যুগে!
নেতাগোছের একজন যোগেনকে কিঞ্চিত আশ^স্ত করেন। তিনি বলেন, আরে রাখো তোমার দেশ বিক্রি! আজকালকার যুগে এই বিশাল জনগোষ্ঠির দায়িত্ব বেহুদা কে নেবে! খালি দেশের মালিকানা চাইলে তো হবে না, পাবলিকের খাওয়ানো পরানোর সুবন্দোবস্ত করা চাই! এসব ছেঁদো কথার কোন মানে নেই, বুঝলে হে যোগেন। সব হল গিয়ে পলিটিক্যাল স্টান্টবাজি। এসব কথা শুনে চুপ থাকবে, মগজে ঠাঁই দেবে না। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেডিসেন্ট জন এফ কেনেডি কী বলেছেন শোনোনি- দেশ তোমাকে কী দিয়েছে তা নিয়ে মোটেও ভাববে না। শুধু ভাববে তুমি দেশের জন্য কী করেছ- আর কী করতে পারো। কেউ একজন বলল চিলে কান নিয়েছে, আর তুমিও অমনি কানের খোঁজে চিলের পিছে ছুটলে, এমনটি করো না যেন। লোকে তোমাকে বোকা ঠাওরাবে।
যোগেন একটু দম ফেলার ফুরসত পেল বটে, তবে তার পুরোপুরি নিশ্চিন্তি এলো না। নেতা যদিও বলেন, আরে বেকুব, দেশ কি ক্ষেতের মুলো না পুকুরের মাছ, যে খদ্দের ডেকে এনে বেচে দিলাম! দেশ মানে মাটি, একবুক ভালবাসা। এই দেশের জন্য একাত্তরে আমরা কি না করেছি! বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছি। শত কষ্টের মাঝেও যোগেন ফিক করে হেসে ফেলল। ব্যাটা কয় কী! একাত্তরে তার জন্মই হয়নি বা হলেও তার বয়স তখন খুব জোর চার বা পাঁচ। সে কিনা শোনাচ্ছে দেশপ্রেমের কাহিনী! যোগেন টিভি দেখছে। সে কান খাড়া করে শোনে- ওই যে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরাও বলছেন, এবারকার চুক্তি-টুক্তিগুলো একটু কেমন যেন। দেশবিক্রির নামান্তর নয় কি!
নেতা সরস মন্তব্য করলেন। আরে যোগেন, তুমি চাষের মানুষ, হালের বলদ নিয়ে থাকো। বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতে যেও না। বুদ্ধি বেচে যারা খায়, তাদের নানা রঙে নানা ঢঙে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে হয়। নইলে লোকে তাদের ডাকবে কেন! ভুলে যেও না, ওটা তাদের জীবিকা। বুদ্ধি বেচে খাওয়া অত সহজ কাজ নয়। হাওয়া বুঝে চলতে হয় তাদের। টক শোতে গিয়ে টকাটক অম্ল-মধুর কথা বলতে হয়। বুঝেও না বোঝার ভান করতে হয়। এক শ্রেণি আছে, উনারা আবার খানিক দলকানা। দল কী চায় তাই বুঝে জিভ নাড়তে হয়। নইলে দলে ও সমাজে হুঁকোপানি বন্ধ। তাঁবেদারি করে টুপাইস কামানোর ধান্ধা শেষ।
বস্তুত দেশ নিয়ে মধ্যবিত্তের ভাবনা খানিক বেশি। উচ্চবিত্তরা এ নিয়ে খুব একটা সময় ক্ষেপণ করে না। কেন কেন, ওদের কি দেশের দরকার নাই! নাকি দেশ গেলে ওরা চাঁদে গিয়ে ডুপ্লেক্স তুলবে!
কথা মিথ্যে নয়, এই শ্রেণির মালদারদের দেশের প্রতি দরদ একটু কমই। নানান দেশে ওদের সেকেন্ড হোম থার্ডহোম তৈরি আছে। কেউ কেউ শুনেছি ভিন্ন গোলার্ধে তামাম দ্বীপ কিনে বসে আছে। সুইস ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমিয়েছে। এদের অতীত-ভবিষ্যত দুটোই ঝরঝরে, তাই দেশ নিয়ে আদৌ কোনও ভাবালুতা নেই।
হরিপদ মামুলি কেরানি। সরকারি অফিসে কাজ করতে করতে দেশটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছে। সে জানে এদেশে মেলা আতান্তর, অনেক কিছুই নেই এখানে। কিন্তু তাও নিজের মা তো! মা যেমনই হোক, ভাল না বেসে উপায় কী! দেশবিক্রির হিড়িক শুনে সে বড্ড মুষড়ে পড়লো। বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেমাটি এবার চাটি হবার উপক্রম। হরিপদ ভেবে পায় না, যারা এ দেশ কিনবে বলে গুজব, তাদের কিসের অভাব! বা এমন অভিসন্ধি থাকলে সেই একাত্তরেই হাতিয়ে নিতে পারত! পাশে এসে না দাঁড়ালেই হত। তখন নেয়নি, আর এখন সতের কোটি লোকের দায়-দায়িত্ব তারা নিতে যাবে কোন দুঃখে! আর চাইলেই বা দিচ্ছে কে!
ঘরে বউয়ের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে হরিপদ। মিয়ানো গলায় বলল, দেশ গেলে যাবো কোথায়! খাবো কী! ভাবছো কিছু? ছেলেপুলে নিয়ে এই বয়সে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে যে!
বউ খানিক সমঝদার। স্বামীকে আশ^স্ত করে সে বলল, আরে রাখো তোমার দেশ বিক্রি! কথাটা কারা রটাচ্ছে ভাবো একটু! এদেশে তুমি যত ভালই করো, বিরোধীপক্ষ তার কোন না কোন খুঁত বের করবেই। নিছক নিন্দেমন্দ, অকারণ সমালোচনা। যদি কোন দোষ খুঁজে নাও পায়, তখন কাষ্ঠ হেসে বলবে, আরে ভায়া, এত ভাল কিন্তু ভাল না। ভেতরে অন্য গোমর আছে। এই হল আমাদের স্বভাব। পরশ্রীকাতরতা ও পরস্ত্রীকাতরতা যেন আমাদের চরিত্রে সেঁটে আছে।
হরিপদ বউকে বেশ মানে। তাই আপাতত সে চুপ থাকলো। ওদিকে তাড়িণী খুড়ো, যে কিনা তিনখানা আমলের নীরব সাক্ষী- ইংরেজ, পাকিস্তান আর হালে বাংলাদেশ। তাকে ভূষ-ির কাকও বলা চলে। চাঁদিতে অবশিষ্ট চুল সব পেকে কাশফুল। চুল তো আর এমনি পাকেনি, যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান আমাদের তাড়িণী খুড়ো। তিনি শুষ্ক জিভ বের করে খটখটে হেসে বললেন, যারা দেশবিক্রির ক্যানভাসিং করছে তারা হয় সত্যের অপলাপ, নয়তো ‘ইয়ের’ প্রলাপ বকছে। দাদাদের খেয়েবসে কাজ নেই, এই আকালের কালে অযথা বাড়তি চাপ নেবে! ব্রিটিশদের কথা ভাবো, ওরা আমাদের ধন-দৌলত হিরে-জহরত (দুষ্প্রাপ্য কোহিনূর) চুরি করেছে সত্যি, কিন্তু দেশ নিয়ে কোন ঠাট্টা-মশকরা করেনি। ওসব কল্প-কাহিনীর যুগ আর এখন আছে নাকি!
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে শোনা যায়, ডিক্রি জারির মাধ্যমে সরকারি খাস বা যে সকল জমির বৈধ মালিক খুঁজে পাওয়া যেত না, তা জবরদখল করে অন্যে ছিনিয়ে নিত। ওটা ছিল নেহাতই গায়ের জোরে গুরুগিরির শামিল, যা কি না দুদিন বাদেই উল্টে যেত, ধোপে টিকতো না।
শেষে উকিলি প্যাঁচ কষলেন একজন। দেশ হাতছাড়া হয়েছে শুনলুম, কিন্তু কীভাবে একটু খুলে বলবেন! না না, পাতলুন-জামা খুলতে হবে না, মগজটা একটু ঘেঁটে নিয়ে তারপর বলুন। গুজব তো শুধু ছড়ালেই হবে না, আমজনতাকে খাওয়াতেও হবে। নইলে ওরা ভাববে, গ্রীষ্মের প্রচ- তাপদাহে আপনার ইয়ে মানে হেডঅফিসের নাট-বল্টু সব খসে পড়েছে। দেশ হলো মায়ের মতো, মোটেও মামুলি বিষয় নয়। মা যেমন আমাদের পেলেপুষে বড় করে, দেশও তেমনি আমাদের খাদ্য, আশ্রয় ও পরিচিতি দেয়। তাই বলি কি, ওসব আবোলতাবোল ছেড়ে একটু থিতু হয়ে বসুন তো। ক্ষমতা নেই তো কী হয়েছে, আবার আসবে! কিন্তু ভাবের ঘোরে দেশটাকেই যদি বেচে দেন, তাহলে মসনদ পাবেন কোথায়! বাকি জীবন পরের গোলামি করে কাটাতে হবে যে!