বৈচিত্রের রবি
৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:০৮
শেখ সাদী ।।
সবকিছুতেই বিচিত্র খেয়াল ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথের।
খাবার নিয়ে এই খেয়ালিপনার ঘটনাও খুব একটা কম নয়। সন্ধ্যায় খেতেন রাতের খাবার। ঘণ্টাখানেক কোনো বই বা পত্রিকার পাতা উল্টে লিখতে বসতেন। বিকেল চারটায় ছিল চাপর্ব।
সঙ্গে থাকতো নোনতা বিস্কুট। রাতের খাবারটা ঠিক সন্ধ্যা সাতটায়। রাতে বিদেশি খাবার বেশি পছন্দ করতেন। দুপুরে পছন্দ করতেন বাঙালি খাবার। কম মশলায় ঘরোয়া রান্নাই গুরুদেবের পছন্দ। রাতে খেয়েদেয়ে একটানা রাত ১২টা পর্যন্ত চলতো লেখা বা পড়া।
একবার এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত এলেন শান্তিনিকেতনে।
কথা হলো অনেকটা সময়। যাবার সময় তিনি বললেন, ‘শরীরের জন্য হবিষ্যান্ন একদম সঠিক খাবার। শাস্ত্রও এই খাবারের কথা-ই বলে।’ একথা বলে তিনি কয়েকটি আখ্যান ও উপমার গল্প শোনালেন।
সবকথা মন দিয়ে শুনলেন কবি।
ব্যস!
এতেই হয়ে গেল!
খেয়ালি রবির মাথায় প্রবেশ করলো হবিষ্যান্ন নামটি। রান্নার কাজে যুক্ত সবাইকে কাছে ডেকে বলে দিলেন, ‘এখন থেকে সব খাবার বাদ, শুধু চলবে হবিষ্যান্ন।’
পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে বললেন, ‘কিছুকাল থেকেই স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম যা খাচ্ছি তা আমার দেহ ঠিকমতো নিতে পারছে না। অথচ বুঝতে পারছিলাম না কি করা যেতে পারে। এবারে ঠিক আহার্য বস্তুটির সন্ধান পাওয়া গেল। কাল থেকে আমাকে হবিষ্যান্নই দিও।’
গুরুদেবের কথার নড়াচড়া করা যায় না। আবার উনার কথায় ‘না’ বলার ইচ্ছাও কারো নেই। একদল লোক ছুটলো কুমারের বাড়ি। নতুন লাল মাটির পোড়া মালসা আনা হলো এক ঝুড়ি। এবেলা ওবেলা হবিষ্যান্ন রান্না হচ্ছে। এসব নতুন মালসায় পেয়ে খুব খুশি। বললেন, ‘এই এতদিনে ঠিকটি হল। মাছ মাংস সাত-পাঁচ জিনিস খেতাম এতদিন। এতে পাকযন্ত্রের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছিল। এতে অপকারই ঘটে বেশি। এই খাবারে কাল হতে খুব ভালো বোধ করছি আমি।’
হবিষান্ন্য হলো আতপ চালের ভাত। এতে ‘ঘি’ দেয়া হয়।
এভাবে চললো কিছুদিন।
এবার শান্তিনিকেতনে এলেন এক বিদেশি বন্ধু। কথায় কথায় ওই বিদেশি বললেন, দিনে দুবেলা দুটো করে ডিম না খেলে শরীর ভালো থাকবে না, একমাত্র ডিম-ই আসল খাবার। এতে সব রকমের খাদ্যগুণ আছে।
বন্ধুটি চলে যাবার পর শুরু হলো ডিম খাওয়া। এই ডিম ভেজে বা সেদ্ধ করা যাবে না। একেবারে কাঁচা। বন্ধুর পরামর্শ ছিল ডিম কাঁচা খাওয়ার। দুটি ডিম ভেঙে পেয়ালায় রাখা হলো। এতে দিলেন একটু লবণ আর সামান্য গোলমরিচ-গুঁড়ো। হবিষ্যান্ন্ বিদায় নেয়ার পর এবার সমানে চলছে ডিম খাওয়।
ডিম নিয়ে কেউ কিছু বললেন না। কবির নির্দেশ, দিন রাতে শুধু ডিম চলবে।
ডিমপর্ব চলার সময় শান্তিনিকেতন এলেন একজন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ। তিনি কথায়-কথায় বললেন, নিম পাতার কোন জুড়ি নেই। শরীর-মন ঠিক রাখতে নিম-পাতার রস খেতেই হবে।
পরদিন খেয়ালি কবি বললেন, এতদিন বেশি-বেশি ডিম খাওয়া হলো, এটা ঠিক না, এবার স্বাভাবিক খাবারের সাথে দুবেলা নিম-পাতার রস দিও।
বিদায় নিল কাঁচা ডিমপর্ব। এবার শুরু হলো নিম-পাতার রস খাওয়া। এভাবেই চলছিল। এমন সময় কবিকে একজন জানালেন, মহাত্মা গান্ধি প্রতিদিন কাঁচা রসুন চিবিয়ে খাচ্ছেন। এতে শরীরে বাতের ব্যথা হয় না। সুতরাং শুরু হলো রসুন খাওয়া। কাঁচা রসুন চিবিয়ে খাওযার পাশাপাশি রসুন বেটে তৈরি করা হলো বড়ি।
বেশ চলছে রসুনপর্ব।
এমন সময় শান্তিনিকেতন এলেন জাপানি চিকিৎসক। তিনি বললেন, রান্নার আগুনে খাবারের মান নষ্ট হয়, এজন্য সব কিছু কাঁচা খাওয়া ভাল।
ব্যাস! এসে গেল কাঁচা খাওয়ার দিন। প্রতিমা দেবীকে বললেন, ‘এতদিন কী সব খাওয়াচ্ছে আমাকে! রান্নায় ঝামেলা বেশ। আবার এই খাবার শরীরের কাজেই লাগছে না। এর চেয়ে ঢের বেশি ভালো কাঁচা সবজি কুচিয়ে দিও। একটু লবণ, সাথে কয়েক ফোঁটা লেবুর-রস দিও। এখন থেকে আমি এটাই খাবো।’
এভাবে কাঁচা সবজি খেয়ে হজমের গন্ডগোল হয়ে গেল। চারদিন পর বিদায় নিল কাঁচা সবজিপর্ব।
এমন সময় শান্তিনিকেতনে হাজির হলেন একজন গুজরাটি বন্ধু। তিনি বললেন, ‘ক্যাস্টর ওয়েলের ময়ান দিয়ে ভাজা পরোটা খেলে শরীর তরতাজা থাকে।মনে থাকে ফুর্তি। এ জিনিস খেলে কখনো ডাক্তারের দরকার হবে না।’
ব্যস!
এবার শুরু হলো ক্যাস্টর ওয়েলের পরোটা খাওয়া।
এই পদ শুরুর পর নেয়াহেত খুব দরকার না হলে কেউ কবির কাছে আসতেন না।
কারণ, কাছে থাকলে তাকেও কবির প্রিয়-খাবার খেতেই হতো। কারো ‘না’ বলা চলতো না।
ক্যাস্টর ওয়েল অনেকটা আতংকের বিষয় হয়ে উঠলো শান্তিনিকেতনে।
চললো মাত্র তিন দিন।
এরপর বিদায় হলো এই অভিনব পদটি!
সারাবাংলা/পিএম