এবার টুসুর কথা
৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৫:২৯
শেখ সাদী ।।
উৎসবের নাম টুসু। আর, টুসুর প্রাণভ্রমরা ‘গান’।
একদল বলেন ‘টুসু পূজা’।
টুসু নামে কোন দেবতা নেই। টুসু আসলে জনজীবনের এক অতি আপনজন।
দেবতা না হলেও অনেক বাড়িতে টুসুর মূর্তি দেখেছি। যদিও সাথে ধর্মের কোন যোগসূত্র নেই টুসুর।
সম্পর্ক নেই পুরাণের সঙ্গেও। টুসু অপৌরাণিক। অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য গানের উৎসব, যে গান কেবল নারীদের। এখন পর্যন্ত কোন পুরুষকে দেখিনি টুসু গাইতে।
সম্প্রতি শুনছি পুরুষরাও নাকি টুসুর দল গড়েছেন।
২
টুমু নামের জন্ম ঊষা বা ওষা ব্রত থেকে।
উড়িষ্যার পাহাড়ি অঞ্চলে এখনো এই ব্রত পালন করা হয়। ধরা হয় ‘ঊষা’ বা ‘ওষা’ শব্দটি এই অঞ্চলের কথ্যভাষার হয়ে যায় টুসু। নামকরণে নিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য কোন মত নেই। একদল মনে করেন, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে।
নানা জনের নানা মত। তর্ক চলছেই।
একদল বলেন তোষলা ব্রতর নাম হয়েছে টুসু। একদল বলেন তুষার শব্দ থেকে এসেছে টুসু।
টুসুর শুরুটা কবে সেকথা জানা যায় না। লিখিত প্রথা বা মন্ত্রও নেই।
কেবল গানের মধ্য দিয়ে চলে টুসুর আরাধনা। দেবী নয় বরং রাঢ় বাংলার ঘরের মেয়ে টুসু।
তাই নিজের জীবন যাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে টুসু আরাধনার নিয়ম কানুনও ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। তবে সবক্ষেত্রেই মিল রয়েছে মন্ত্রে তন্ত্রে নয়। খালি গলায় সুরেলা গানেই খুশি রাঢ় বাংলা।
টুসু গান কোন লিখিত গান নয়। পুরনো শ্যামা গানের মতোই শুনে শুনে মনে রাখতে হয়। আর সেভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম পার হয়ে এখন হাজার বছরেরও বেশি বয়স হয়েছে টুসুর। তবে সময়ের সাথে পাল্টেছে গানের কথা। পাল্টেছে সুর।
৩
এখন মনে পড়ছে অবন ঠাকুরের তোষলা ব্রত নিয়ে একটি লেখার কথা।
লিখেছেন ‘অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি থেকে পৌষের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি সকালে স্নান সেরে গোবরের ছ গন্ডা বা একশ চুয়াল্লিশটি গুলি পাকিয়ে কালো দাগশূন্য নূতন সরাতে বেগুন পাতা বিছিয়ে উপরে গুটি কয়টি রাখতে হয়। প্রতি গুটিতে একটি করে সিঁদুরের ফোঁটা এবং পাঁচখানি করে দূর্বাঘাস গুঁজে দিতে হয়। তার উপরে আলোচালের তুষ ও কুড়ো ছড়িয়ে সরিষা, শিম, মুলো ইত্যাদি ফুল দিয়ে ছড়া বলা হয়।’
অবন ঠাকুর আরো বলেছেন, ‘ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের যে দশা-বিপর্যয় ঘটত সেইগুলোকে ঠেকাবার ইচ্ছা ও চেষ্টা থেকেই ব্রতক্রিয়ার উৎপত্তি। বিচিত্র অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মানুষ বিচিত্র কামনা সফল করতে চাইছে। এই হল ব্রত। পুরাণের চেয়ে নিশ্চয়ই পুরোনো, বেদের সমসমায়িক কিম্বা তারও পূর্বেকার মানুষের অনুষ্ঠান।’
এখানে একটা প্রশ্ন মাথা তোলে। সেটা হলো তোষলা ব্রতের সঙ্গে টুসুর সম্পর্ক নেই। সাধারণত ব্রত হয় সকালে। গোসল সেরে। শুদ্ধাচারে। আর টুসু হয় রাতে।
টুসুর গান আগে থেকে লেখা থাকে না। তাৎক্ষণিকভাবে নারীরা মুখে মুখে গান রচনা করেন।
কথার মধ্যে জমে থাকা ব্যথা বেদনা পারস্পরিক ঝড়গা বিবাদের কথাও শোনা যায়। অন্যসব লোকগানের মতো নিরক্ষর লোকজনের মুখে মুখে রচনা করা ও গাওয়া বলে এতে নান্দনিকতার খুব একটা পরিচয় না পাওয়া গেলেও সুরের মাদকতা মন ভরিয়ে দেয়।
নবান্ন উৎসবের সঙ্গে টুসুর আত্মিয়ের সম্পর্ক। বিশেষ করে ভাদ্র মাসে ফসলের ক্ষেতে গাছগুলি ধানের ভারে নুয়ে পড়ে। ওই সময় সকালে গোসল করে নতুন বা ধুয়ে পরিষ্কার করা কাপড় পরে যেতে হয় ধান ক্ষেতে। নিয়ে যান একটি শাঁখ। হলুদ রঙের কাপড় আর একটি মাটিতে তৈরি পানির পাত্র বা কলস। ধান ক্ষেতে পৌছে আড়াই মুঠি ধান গাছ কেটে হলুদ কাপড়ে বেঁধে নেন। এর নাম ‘মুঠ আনা’।
এই সময় ধান গাছের গোড়ায় জমে থাকা পানি ভরে নেয়া হয় সাথে নিয়ে আসা পানির পাত্রটি। ধানের গাছ বাঁধা পুটলি ও পানিভরা পাত্রটি মাথায় নিয়ে চলে আসেন টুসুর দল। আসার সময় মৌন থাকতে হয়। সোজা চলে আসেন গৃহস্তের সদর দরজায়। এসে শঙ্খধ্বনি দেন। এটি আসলে আহবান। শঙ্খধ্বনী শুনতে পেয়ে যেন গৃহিনী বের হয়ে আসনে বাড়ির বাইরে। ধানগাছ বাঁধা পুটলি ও পানির পাত্র ঘরে নিয়ে যেয়ে লক্ষ্মী দেবীর বেদীর ওপরে রাখেন।
এই মুঠির ধানেই অগ্রহায়ণ মাসের কোন একদিন হবে নবান্ন। এই ধানের তুষগুলিই হলো টুসু। এমন কথাও চালু আছে।
৪
এসেছে পৌষ মাস।
গৃহকর্তী তার আশেপাশের বাড়ির নারীদের সঙ্গে নিয়ে একটি নতুন মাটির পাত্র নিয়ে বসেন। গ্রামে পাত্রটির নাম ‘মালসা’।
পাত্রটি সাদা রঙ করা হয়। সাদা রঙ শুকিয়ে গেলে এর উপরে অসংখ্য লাল ও সবুজ রঙের দেয়া হয় ফোঁটা।
এই মালসায় ‘মুট আনা’ ধানের তুষ ভরে এর উপরে রাখেন আকন্দ ও গাঁধা ফুল।
কোন কোন এলাকায় মাটির ভাঁড়ের মধ্যে রাখা হয় পাঁচটি গোবরের ঢেলা। আবার কোন এলাকায় টিনের কৌটোর মধ্যে একটি প্রদীপ রাখার চল আছে। এ-ও দেখা গেছে কোন কোন এলাকায় প্রায় দেড় ফুট উচ্চতার একটি মাটির প্রতিমা। এর সারা অঙ্গে থাকে হলুদ রঙ।
গৃহকর্তী তুষ আর ফুল দিয়ে সাজানো মালসা নিয়ে বসেন।
পাশে থাকে খৈ, মুড়ি, নাড়ু ভরা বড় একটি-দুটি পাত্র।
আশেপাশের বাড়ির নারীরা সাথে আনেন অন্তত একটি করে পাত্র। থাকে খৈ, মুড়ি, চিড়া, নারিকেল বা তিলের নাড়ু। চলে প্রাক সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত।
এরপর সংক্রান্তির রাতটি টুসুর। জাগরণের রাত। উৎসবের রাত। রাতভর নারীরা গান করেন। গানের সুরে আর কথায় সারাগ্রাম মুখর হয়ে ওঠে।
রাত শেষে মানে প্রথম প্রভাতে কোন পুরুষ মাথায় করে মালসা নিয়ে যান। নদী বা জলাশয়ে বিসর্জন দিতে। কোন কোন এলাকায় চৌদলে করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে শুনেছি। দেখিনি।
আরার ফিরে যাই টুসু ও তোষলা ব্রতের কথায়।
তোষলা ব্রত একটি প্রার্থনার। একটি কামনার। শষ্য নয়তো ধন।
টুসুতে প্রার্থনা নেই। আছে আশা পূরণের আনন্দ। উচ্ছ্বাস।
যারা টুসুর গান করেন তারাই সুর বসিয়ে দেন কথায়।
একসাথে এক দল নারীর গাওয়া গান। কোন বাদ্যযন্ত্র থাকে না। মনের আনন্দে মিয়ে যায়। আনন্দ উপচে ওঠে কষ্টের ফসল তোলার সময়ে।
এই আনন্দ ধরা থাকে টুসুর কথায়। টুসুর সুরে। এলাকা ভেদে কথার রূপ বদলে যায়।
সারাবাংলা/পিএম