বাড়ি চাই নিত্য নতুন
১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:০৬
শেখ সাদী ।।
আজ যে বাড়িটি অনেক পছন্দের, কাল সেই বাড়িটিই বিরক্তির কারণ।
মন বসতো না। বিরক্ত হতেন, ‘নাহ্! এখানে আর বাস করা যায় না।’
এক এক করে উদয়নের এর সবগুলো ঘরেই থাকলেন। এরপর তৈরি হলো বড়ই শখের বাড়ি কোণার্ক। বেশ উঁচু জায়গায়। চারপাশে খোলা জায়গা। কবি চলে এলেন কোণার্কে।
মনে ভরপুর আনন্দ। পুরোদমে চলছে লেখালেখি। জন্ম নিচ্ছে গান, কবিতা। মঞ্চের মত তৈরি ঘরে বসে কবি বসে থাকেন। তাকিয়ে দেখেন চারপাশ।
কিছু দিন পরেই গন্ডগোল।
‘নাহ্! একটুও ভালো লাগছে না, বড় একঘেয়ে লাগছে বাড়িটি।’
বাড়ির আসবাব ওলোট-পালোট করা হলো।
শোবার খাট গেল খাবার ঘরে। খাবার চেয়ার টেবিল এলো শোবার ঘরে।
শোবার ঘরটি করা হলো অতিথিদের জন্য। লেখার কাগজ-কলম; আর ছবি আঁকার রঙ-তুলি চলে এলো বারান্দায়।
এভাবে চললো কিছুদিন।
মনে আনন্দ ফিরছে না। এবার কোণার্ক থাকার একঘেয়েমি কিছুতেই যাচ্ছে না।
নাহ্!
নাহ্!
‘এ বাড়িতে আর থাকা যায় না।’
এদিকে নতুন বাড়ি করার টাকাও নেই। কাউকে কিছু বলতে যেয়েও পারছেন না। কারণ, সমস্যা একটাই আশ্রমের তহবিল প্রায় শূণ্য। আবার না-বলেও পারছেন না। শেষমেষ ডাকলেন বাড়ি তৈরির কর্তাবাবু সুরেন্দ্রনাথকে।
বললেন, ‘এ-বাড়িতে আর মন বসছে না। লিখতে-পড়তে পারছি না।’
সুরেন্দ্রনাথ কর অনেক ভেবেচিন্তে কোর্ণাকের পশ্চিম বারান্দায় তৈরি করলেন একটি কাঁচের ঘর।
এবার খুব খুশি কবি।
কাঁচের ঘরে এসে শিশুর মত হয়ে গেলেন কবি। আনন্দ যেন মনে আঁটছে না। এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়তে থাকে গানে-কবিতায়।
এককথায় কবি এখন আহ্লাদে আটখানা।
কয়েকটা দিন যেতে না-যেতেই বললেন, ‘রোদে ঘরটা বড়ই বেয়াড়া রকমের গরম হয়ে যাচ্ছে। এমন ঘরে থাকা যায় না।’
একথা শুনে সুরেন্দ্রনাথ কর পশ্চিমে তৈরি করলেন একটি বারান্দা। ছাদওয়ালা বারান্দা।
এই বারান্দা তৈরি হওয়ার পর খুশি কবি। কয়দিন পর সমস্যা বেরিয়ে এলো। কেউ এলে তাঁকে নিয়ে বসতে হয় পুবের বারান্দায়। কাগজ-কলম ফেলে কবিকে যেতে হয় ওখানে।
এ বড় ঝামেলা।
এই ঝামেলা মুক্ত করতে বারান্দায় বসানো হলো ইট।
ইটের ওপর বসলো ইট। উঁচু দেয়াল গাঁথা হয়ে গেলো। এখানে বসার জায়গা তৈরির পর খুব খুশি হলেন কবি। খুশি মনটা বেশিক্ষণ টিকে থাকলো না। কারণ এখানে বসে আগের মত আকাশ দেখা যাচ্ছে না, ‘এখানে বসে সূর্যাস্ত দেখবো কী করে?’
এবার বারান্দায় একটা খাট পাতা হলো।
খাটের ওপর রাখা হলো চেয়ার। আর, খাটের পাশে বসানো হলো জলচৌকি।
এতে পা রেখে উঠবেন খাটে। এরপর এর উপরে রাখা চেয়ারে বসে খুব খুশি, ‘বাহ্! এবার সবকিছু সুন্দর দেখতে পাচ্ছি। যতদূর ইচ্ছা চোখ মেলে তাকাও। বড়দা এমনি করে দোতলার ছাদে তক্তা পেতে তার উপরে ইজি চেয়ার রেখে বসে সমুদ্র দেখতেন, পুরিতে। এখন এখানে বসে আমি-ও সূর্যাস্ত দেখবো।’
এভাবে চললো মাত্র কদিন। তৈরি হলো সমস্যা। জলচৌকি বেয়ে খাটে ওঠার ধকল বেশিদিন সইল না, ‘নাহ্! কোণার্ক আর একটুও ভালো লাগছে না’।
ডাকলেন সুরেন্দ্রনাথকে।
তৈরি করা হলো ইংরেজি ‘এল’ আকারের একটা লম্বা ঘর।
এই ঘরটির দুই প্রান্তে রাখা হলো দুটি দরজা। আর কোন দরজা রাখা হলো না। তৈরির আগে বলেছেন, ‘বেশি দরজা থাকার মনেই ঝামেলা। খোলা-বন্ধ করার বেশ হাঙ্গামা। এ ছাড়া যে কেউ যখন খুশি এসে পড়বে। তখন শান্ত মনে লেখা যায় না।’
দুটি দরজার ‘এল’ আকারের নতুন বাড়ি পেয়ে খুশি কবি, ‘এ হলো বেশ। দুটি দরজা বন্ধ করলে আর কেউ আসতে পারবে না।’
এই বাড়ির জন্য কাঠের আসবাবের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো।
শোবার খাট, বসার চেয়ার, লেখার টেবিল বানানো হলো সিমেন্ট দিয়ে। এমনকি ছবি আঁকার ঢালু টেবিলটিও সিমেন্টে করা হলো। কবি নকশা করে দিলেন। আর ঘরটি সাজিয়ে দিলেন নন্দলাল বসু।
এক সপ্তাহ যেতে না-যেতেই হোঁচট খেলেন কবি।
সিমেন্টের জলচৌকিতে ওঠার সময় বেশ ব্যথা পেলেন। পরদিন সকালে লোক ডেকে জলচৌকি ভাঙা হলো। এদিন নন্দলাল বসুকে বললেন, ‘সিমেন্টের খাটে অসুবিধাও বেশ। ইচ্ছা করলে এদিক-ওদিক সরানো যায় না।’
ইচ্ছা মত কাজ।
ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হলো সিমেন্টের খাট। এবার নিয়ে আসা হলো কাঠের তৈরি খাট।
২
কবির ইচ্ছা হলো এবার মাটির ঘরে থাকবেন, ‘এই দেহ তো একদিন মাটির সাথে মিশে যাবে। কাজেই এখন থেকে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক থাকাই তো ভালো।’
বললেন, ‘ঘরটা হতে হবে মাটির। ছাদটাও করতে হবে মাটি দিয়ে। আর দেয়াল করতে হবে মাটির হাঁড়ি দিয়ে। ছাদে উপুড় করে রাখতে হবে মাটির হাঁড়ি। এতে ঘরটি হবে তাপানুকুল।’
তৈরি হলো মাটির ঘর।
নাম রাখলেন ‘শ্যামলী’।
খুশি কবি, ‘এই ঘরটিই হবে আমার শেষ আশ্রয়।’
মহাত্মা গান্ধি বেড়াতে এলেন শান্তিনিকেতন।
তাঁকে থাকতে দিলেন এখানে।
গান্ধিকে বললেন, ‘এই রইল বাড়ি। যখনই ইচ্ছা হবে এখানে চলে আসবে। আমি যখন থাকবো না, তখনও এসো।’
কিছুদিন পর এলো বর্ষাকাল।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি চললো। বৃষ্টিতে শ্যামলীর মাটির তৈরি ছাদের পড়ি-পড়ি অবস্থা। এদিকে কিছুতেই এখান থেকে কবিকে সরানো গেলো না। রাতে বৃষ্টি আরো বাড়লো। বাড়লো সবার দুশ্চিন্তা। সকালে হয়তো দেখা যাবে মাটির ছাদ ভেঙে চাপা পড়েছেন কবি।
সকাল হতে না হতেই শান্তিনিকেতনের সবাই ছুটে এলেন শ্যামলীতে।
এদের দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘কাল রাতে ছাদ-চাপা পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এত বড় খবরটা কাগজে উঠতে-উঠতে ফসকে গেল! কী দুঃখের কথা বল্ দেখি!’
৩
এবার শ্যামলীর কাছে তৈরি হলো নতুন বাড়ি। নাম রাখা হলো ‘পুনশ্চ’।
বললেন, এই বাড়ির পুবদিকে কাঁচ দিয়ে ঘিরে দিলে বই রাখা যাবে। আবার সব দেখাও যাবে।’
কথামতো পুবে কাঁচ দেয়া হলো।
দক্ষিণের বৃষ্টির ঝাপটা ঠেকাতেও দেয়া হলো কাঁচ।
পশ্চিমের বারান্দায় বাতাস ধাক্কা দেয় কাজেই এখানেও দেয়া হলো কাঁচের বেড়া।
এই বাড়িটি দারুন পছন্দ হলো।
কয়েকদিন যেতে না যেতেই বিদ্রোহ করে কবিমন, ‘এই বাড়ি কি আমি চেয়েছিলুম! খোলামেলা আকাশ দেখতে ভালবাসি। এখন আমাকে এভাবে আটকে দেয়া হলো।’
ছেলে রথীন্দ্রনাথকে ডেকে বললেন, ‘এবার এক কাজ কর। চারটা থামের উপর একটা ঘর তোল। এর উপরে বসে আমি চারদিকটা ভালো করে দেখবো।’
তৈরি হলো উঁচু থামের উপর বাড়ি।
নাম রাখলেন ‘সেঁজুতি’।
একটা বইয়ের নাম রাখলেন পুনশ্চ।
একটা বইয়ের নাম সেঁজুতি।
পরে সেঁজুতির নাম বদলে দিলেন। নতুন নাম পেল বাড়িটি।
পুবের বাড়ি সেজন্য নতুন নাম হলো ‘উদীচি’।
সারাবাংলা/পিএম