টুসুর পরেই নাম আসে ভাদুর
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:২৬
শেখ সাদী ।।
আদরের কন্যা ভাদু। বিয়ের পর সে এখন শ্বশুর বাড়ি।
এদিকে এসেছে ভাদ্র মাস। এ মাসে ভাদু আসবে বাবার বাড়ি। মুশকিলটা হলো পথে পড়বে দামোদর নদী। এই নদী পার হয়ে আসতে হবে।
নদীর এখন ভরা যৌবন। প্রবল স্রোতে নৌকা চলছে না। তাই স্রোত কমাতে মিনতি করছে বারবার। শেষ পর্যন্ত ভাদু আসতে পারে। অনেকদিন ভাদুকে দেখতে পায়নি মা।
মা বলছেন, ‘ভাদু বল্ মোরে
ভুলেছিলি কেমন করে
পথের দিকে থাকতাম চেয়ে,
চাঁদমুখ দেখবার তরে।’
এরকম গানের ভরপুর আয়োজন ভাদু গানে।
কুমারী মেয়েরা বাড়ীতে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। মানে একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর মূর্তরূপ কল্পনা করা হয়।
এরপর সমবেত কন্ঠে গাওয়া হয় ভাদুগান।
২.
ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে নিয়ে আসা হয় মূর্তি। এরপর সংক্রান্তির আগের রাতটি ভাদু জাগরণের। রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘর তৈরী করে মূর্তি স্থাপন করা হয়। সামনে সাজিয়ে রাখা হয় মিষ্টান্ন। রাত নয়টা বা দশটা থেকে শুরু হয় ভাদুগান।
কুমারী ও বিবাহিত নারীরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি যান ভাদুকে দেখতে। পরদিন সকালে বিসর্জন হয় ভাদুর।
আগের দিনে ভাদুর মূর্তরূপ ছিল না।
একটি পাত্রে ফুল রেখে বা গোবরের ওপর ধান ছড়িয়ে ভাদুর রূপ কল্পনা করে হতো। পরে বিভিন্ন রকমের মূর্তির প্রচলন হয়।
হংস বা মযূর বাহিনী বা পদ্মের ওপর বসে থাকা মূর্তি। মূর্তির গায়ের দেয়া হয় হলুদ রঙ, মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুল, গলায় পদ্মের মালা ও হাতের তলায় আলপনা।
কোন কোন এলাকায় মূর্তির কোলে কৃষ্ণ বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি দেখেছি। বেশিরভাগ এলাকায় মূর্তির নাম ভদ্রেশ্বরী। যাকে জননীরূপে পূজা করা হয়।
ভদ্রেশ্বরীর ভাসান উপলক্ষে নদীর ধারে হাজির হতেন আশেপাশের গ্রামের লোকজন।
নারীরা আদরের ভাদুকে নদীতে বিসর্জন দেওয়ার সময় কাঁদতে কাঁদতে গাইছে, ‘আজিকে কেমন করে বিদায় দেব বল না ভাদু। যাচ্ছ তুমি যাও ভাদু, আসছে ভাদ্রে আবার তুমি আইসো ফিরে।’
এদিন মেলা বসে নদীর ধারে।
ভাদ্রেশ্বরীর প্রতিমার সামনে সারা মাস ধরে নারীরা যে গান করেন সেটিই ভাদুর গান বা ভাদু উৎসব।
এই রাতে স্থাপন করা হয় ভাদু মূর্তি।
পরের দিন সকালে মূল গায়েনকে অনুসরণে একদল পুরুষ ঢোল, হারমোনিয়াম, তবলা ও কাঁসি নিয়ে ভাদু গাইতে গাইতে মূর্তি বিসর্জন করেন।
এরকম বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে গাওয়া হয় ভাদু।
এখন উঁকি দিচ্ছে একটি প্রশ্ন, কবে জন্ম ভাদুর?
জন্মস্থান কোথায়?
উত্তর অজানা।
ভাদুর সাথে পূজা যোগ হয়ে গেল কেন? এই উত্তরটিও নেই।
পূজা বলতে যা বুঝি তার সাথে কোথাও মিল নেই ভাদুর। নেই ধূপ, নেই চন্দন, নেই কোন মন্ত্রপাঠ। দরকার হয় না কোন পুরোহিতের। ভাদুর মোকামে কেবল গান, যে গান ছড়িয়ে যায় মনের অন্দরে। বেশিরভাগ লোকগানের জন্মদাতা ও জন্মস্থানের খবর জানা যায় না।
লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে ভক্তের প্রাণে।
ভাদ্র মাসের প্রথম দিন ভাদু গানের শুরু। মানে আগমনী।
তাই ভাদু বা ভদ্রেশ্বরীর মূর্তির সামনে আগমনী গান গেয়ে শুরু করা হয় ভাদু উৎসব। ভদ্রেশ্বরী ছিলেন বিবাহিতা, সে কারণে ভাদুর গানে বিয়ের কথা বেশি গুরুত্ব পায়। ভাদুকে নিয়ে একটি চালু আছে। গল্পটি হলো একসময়ের কাশীপুরের রাজা নীলমণির এক কন্যার নাম ভাদ্রেশ্বরী। বাবার নির্বাচিত রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে না করে ভদ্রেশ্বরী আত্মহত্যা করেন।
কন্যার শোকে রাজা শয্যা নিলে প্রজারা রাজকন্যাকে চিরদিন মনে রাখার জন্য ভাদুর নামে ‘ব্রত’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ভাদু উৎসবের শুরু। গল্পটি এখন কিংবদন্তি হয়ে গেছে। যদিও একদল প্রামাণ্য উৎস হিসেবে গল্পটি গ্রহণ করেছেন।
এদিকে কাশীপুরের মহারাজা নীলমনি সিং দেও পরিবারের যে বংশলতিকা পাওয়া যায় সেখানে ভদ্রেশ্বরী নামের কাউকে পাওয়া যায়নি।
আসলে চালু গল্পটির সাথে ভাদুর কোন সম্পর্ক নেই।
সারাবাংলা/পিএম