চায়ের আসরে না― মানুষ
২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:৪৬
শেখ সাদী ||
চা পান খুব একটা পছন্দের ছিল না। তবে বেশি পছন্দের ছিল অন্যদের চা―পান করানো। প্রতিদিন সকালে ভৃত্য বনমালি চা তৈরি করে। এরপর কেটলিভরা চা সামনে নিয়ে বসে থাকতেন ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ।
একজন একজন করে আসতেন স্নেহভাজনরা। এরপর প্রত্যেকের পেয়ালায় চা ঢেলে দিয়ে তবেই নিজে চায়ের কাপে ঠোঁট লাগাতেন।
এই ছিল প্রতিদিনের রুটিন। শান্তিনিকেতনের সকালটা শুরু হতো এভাবে। কেউ না এলে চা―পান না করে বসে থাকতেন। শুরু হতো লেখালেখি। এদিন চা পান করা আর হতো না।
ভৃত্য বনমালি ছাড়াও কবি নিজেও চা তৈরি করতেন। সেটা কেবলমাত্র নামেই ‘চা’।
ফুটন্ত পানিতে দু’চারটা চায়ের পাতা ফেলে দিতেন। দ্রুত পানিতে রং ধরতো। আর তখনি নামিয়ে নিতেন চায়ের কেটলি। ছেঁকে সবার পেয়ালার আর্ধেকটা ভরে দিতেন। এরপর বাকি অর্ধেকটা ভরে দিতেন গরম দুধে। সাথে দুই টেবিল চামচ চিনি। ব্যস! হয়ে গেল বিশেষ চা।
আর এক ধরনের চা ছিল পছন্দের। ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিতেন শুকনো বেল টুকরো আর শুকিয়ে রাখা জুঁই ফুল। একটু পর নামিয়ে ছেঁকে নিতেন। এই বিশেষ চা খেতেন মাঝেমধ্যেই। আসলে চা-প্রীতি খুব একটা ছিল না। গরম পানীয় খেতে হবে এইটাই আসল কথা। সকালে চায়ের পর নয়টার দিকে এক পেয়ালা ‘স্যানটোজেন’ বা ‘হরলিকস’। বিকেলে এক পেয়ালা চায়ের সাথে নোনতা বা মিষ্টি বিস্কুট।
কখনো কেবল শুধুই চা।
চা―পান করার চেয়ে চায়ের আসরের আড্ডা ও অতিথিদের নিয়ে আগ্রহটাই বেশি। এই দলে মানুষের পাশাপাশি ছিল বেশ কিছু না―মানুষ। ময়ূর, শালিক, বাবুই আর লাল রঙের লালু।
কে লালু?
কী তার পরিচয়?
সেসব পরে বলবো। আজ অন্যদের কথাই হোক।
একদিন কবির মা―মণি মানে পূত্রবধু প্রতিমা ঠাকুর একজোড়া ময়ূর কিনে এনে ছেড়ে দিলেন শান্তিনিকেতনে। বাসভবনের পাশের ফুলের বাগানে। ময়ূর দুটি ঘুরে বেড়ালে বাবামশায়ের মন ভালো হবে। এই ইচ্ছায় ময়ূর কিনেছেন প্রতিমা।
কিনে আনার প্রথম দিন থেকেই তৈরি হলো এক মস্ত সমস্যা। যাকে দেখছে তার দিকে তেড়ে যাচ্ছে ময়ূর দুটি। ধারালো ঠোঁটের ভয়ে কেউ এখন বাগানে প্রবেশ করতে পারছে না। আর ছোটদের জন্য জারি করতে হলো বাগানে ‘প্রবেশ নিষেধ’ বার্তাটি।
ময়ূর নাকি চোখ উপড়ে ফেলে এই ভয়ে কেউ এখন এদের কাছে আসতে চায় না। মজার বিষয় ঋষিকবির কাছে এলেই আবার ময়ূর দুটি নরম―কাদা হয়ে যায়। এতটাই নরম হয়ে যায় দেখে মনে হবে ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। এমন ভাব ধরে থাকে।
এরা ঠিক বুঝতে পেরেছিল এই সৌম্য―সুন্দর মানুষটি ওদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। কেউ ধরতে এলে কবি বলতেন― ‘রেহাই দে তোরা পাখিটকে। ও―নিজের মনে ঘুরে বেড়ায়। আমার দেখতে ভালো লাগে। কেন তোরা বেচারাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াস?’
এখানেই শেষ নয়।
কবিগুরুর সামনে ছাড়া ময়ূর পেখম মেলে না। আনন্দের চোখে ময়ূরের পেখমের দিকে তাকিয়ে থাকেন কবি। তখন পড়ে থাকে লেখার কলম, কাগজ।
এমনি করে গড়িয়ে যায় অনেকটা সময়। ঋষিকবি দেখছেন ময়ূর। ময়ূর দেখছেন কবিকে । বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে এই অপূর্ব দশ্যটি দেখতেন প্রতিমাঠাকুর ও অন্যরা।
এমনও হয়েছে যে ময়ূর এসে পেখম মেলেছে, কিন্তু কবি লেখায় এতটাই মগ্ন যে চোখ তুলছেন না। ময়ূরটি অনেকটা সময় নেচে―নেচে যখন দেখলো যে তার দিকে নিরাপদ মানুষটি তাকাচ্ছেন না তখন বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
উচ্চস্বরে ক্যাঁ―ক্যাঁ করতে করতে সরে যায়।
২.
সকালে চায়ের আড্ডার অন্যতম সদস্য অনেকগুলো পাখি। কবি নিজে এদের নিয়মিত আপ্যায়ন করতেন মুড়ি ও ভেজানো মুগ বা ছোলা দিয়ে।
বারান্দার পাশে রাখা থাকতো মাটির সরা। সারাতে পানিভরা কাজটি কবি নিজেই করতেন। পানিভরে তবেই শান্তি।
পাখিরা চলে আসে একেবারে লেখার টেবিলের কাছে। এসে খুঁটে খুঁটে খায়।
বলতেন―‘এই অবোধ জীবগুলো কেমন করে যেন টের পায় যে তাদের কোন অনিষ্ট হবে না। তাই নির্ভয়ে আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করে।’
পাখিদের দলে ভিড়েছে কয়েকটা কাক। কাক একদম পছন্দ করতেন না কবি, তবু এদের প্রতি নির্দয় হননি কোনোদিন।
―‘কাকগুলো আমার দেখতে ভালো লাগে না। তবুও মনে মনে ভাবি ওরা দেখতে যেমনটিই হোক, ও বেচারাদের তো কিছু দাবি আছে এই ভোজের সভায়। তাই, আর তাড়া দিতে ইচ্ছে করে না।’
সারাবাংলা/পিএম