১ সেপ্টেম্বর রাতের স্বপ্ন…
২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:১২
মালেকা পারভীন ।।
গতকাল রাতের স্বপ্নটার প্রভাব এখনো কাটেনি। স্বপ্ন মানে ঘোর। ঘোর মানেই এক অনিশ্চিত অস্থিরতার ভেতর ঘুরপাক খাওয়া।যা হয়, দীর্ঘ একটি স্বপ্নকাল পার করেছি বলে মনে হলো। স্বপ্নের আয়ুষ্কাল সবচেয়ে বেশি যতটা হতে পারে। বড়জোর দেড় সেকেন্ড!একটা চাপা ব্যথা বুকের ওপর। আর অপরিচিত একটা অনুভূতি যা এ ধরনের প্রতিটি স্বপ্ন দেখার পর অনুভূত হতে থাকে। ঠিক ব্যাখ্যা করা যায়না। কিন্তু এর অস্তিত্ব থেকে যায় বেশ কিছু সময়ের জন্য। হতে পারে একটা গোটা দিন অথবা টানা কয়েকটা দিন।
অনেক মানুষের আনাগোনা। বেশকিছু পরিচিত মুখ। একটা স্কুলের লাইব্রেরি অথবা শিক্ষকদের কমনরুমে বসে আছি। ভীষণ মন খারাপ করে। আমার স্বামীর সাথে সমস্যা চলছে। সমস্যাটা আমাকে ঘিরে তার ভয়ানক সন্দেহবাতিকগ্রস্ততার কারণে।ভেবেছিলাম, এতো দিনে এটা থেকে সে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু আদতে পারেনি। এর সাথে ভালোবাসাতেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চোখে পড়বার মতো, অনুভব করবার মতো ঘাটতি।
ভালোবাসার অনুভূতি এমন একটি রহস্যপূর্ণ বিষয় যে এর উপস্থিতি বা অভাব বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনা। যখন কেউ একজন আরেকজনকে ভালোবাসে, তা বুঝতে পারার কথা। অন্তত আমি তো পারি। কারো ভালোবাসা তার সামান্য শারীরিক অভিব্যক্তি থেকেই আমি বুঝে ফেলতে পারি। যেমন বুঝতে পারি তার অবহেলা বা উপেক্ষা যখন সে পাশে বসে থাকলেও রয়ে যায় অনেক দূরে। শরীরের স্পর্শে তো বটেই, মনে মনেও যেন যোজন যোজন ব্যবধানে।
এতো জায়গা থাকতে আমাকে কেন স্কুলের একটা বিশেষ কক্ষে খুঁজে পেলাম সেটা স্বপ্নের নিজস্ব নিয়ম মেনে সম্ভব। হতে পারে, ইদানিং স্কুলসংক্রান্ত একটা বিষয়ে খুব বেশি জড়িয়ে পড়েছি সে কারণে। স্বপ্নের কিছু বাঁধাধরা কার্যকারণের একটি নাকি, যে বিষয় নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা করা হয়, সেটাই অবচেতন মনে এসে ধরা দেয়। এই তথ্য কতখানি যুক্তিগ্রাহ্য জানিনা। আসলে স্বপ্ন ব্যাপারটাই আমার কাছে অমীমাংসিত এক ধাঁধা মনে হয়, তাই স্বপ্ন দেখে দেখা স্বপ্নটা নিয়েই ভাবি। খুব বেশি এর কারণ ঘাঁটতে যাইনা।
যা হোক,শিক্ষকদের কমনরুম অথবা লাইব্রেরিতে আমাকে দেখতে পাওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। অন্ততপক্ষে, আমার সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে যারা কিছুটা জেনে থাকবেন, তাদের কাছে ব্যাপারটার মধ্যে আহামরি কিছু নেই।
‘মেহজাবিনের কথা বলছেন? আমাদের স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষিকা। আরেকটু চেষ্টা করলে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারতো। সেই যোগ্যতা ওর ছিল। কিন্তু সে তো ওদিক দিয়েই গেলো না। সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে। ওর নামের আগে পড়ুয়া, বিশেষ করে বইপোকা, শব্দটা বসালেই কেবল অন্য যেকোন মেহজাবিন থেকে ওকে আলাদা করা সম্ভব।ইত্যাদি।
কমন রুমের ভেতরে লম্বা টেবিলটার যে পাশে আমি বসেছিলাম, সেখান থেকে উন্মুক্ত আকাশের কিছুটা দেখা যায়। কিছুটা, কারণ বেশিরভাগ অংশ একটা বিশাল কড়ই গাছের সবুজ আঁধারে ঢেকে গেছে। পাতার ফাঁক গলে, শাখা-প্রশাখার আড়াল থেকে বিশাল আকাশের যতটুকু দেখা যায়, তাতেই শান্তি।
অনেক দিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কড়ই গাছটা থেকে আমি কিছু টিয়া পাখি উড়ে যেতে দেখতাম। কেউ উড়ে গিয়ে পাশের কদম গাছটায় বসতো, আবার কেউ ফিরে এসে কড়ই গাছটার আশ্রয়ে আরাম নিতো। বেশ কিছু সময় চলতো তাদের এই ওড়াউড়ি। একটা সময় তাদের আর দেখা যেতো না। পাতার আড়ালে পাখিরা লুকালে তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
পাখিদের জীবন আমাকে সবসময় টানে। এ কারণে অনেক রাতের স্বপ্নে নিজেকে উড়তে দেখেছি। দুটো হাত দুদিকে মেলে। পা দুটো সটান লম্বা করে পেছনে ছড়িয়ে। অবধারিতভাবে সময়টা কোন রাত। কারণ, দেখতে পেতাম, বিভিন্ন বাড়ি-ঘরের জানালা দিয়ে আলোর অস্পষ্ট আভা জ্বলছে।উঁচু ভবনগুলোও একইভাবে রাতের অন্ধকারে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আমি আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভেসে বেড়াচ্ছি, নিশ্চিন্ত আনন্দিত মনে উড়ে যাচ্ছি। সবকিছু দেখছি, কিন্তু আমাকে কেউ দেখছে না। কী দারুণ ব্যাপার!
তবে এখানে, স্কুলের এই কমন রুমে,আমাকে অনেকের সামনে পড়তে হলো। সবার মুখে একটাই অনুচ্চারিত প্রশ্ন; কী হয়েছে তোমার/আপনার? আমি কিছু বলিনা। বলবার মতো কিছু নেই। আমার নির্বাক, ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে বসে থাকার ভঙ্গি অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। আলাদা করে কিছু বলবার প্রয়োজন নেই।
তাছাড়া এরকম অবস্থায় আশেপাশের কৌতূহলী মানুষ অনেককিছু অনুমান বা কল্পনা করে নিতে ভালোবাসে। মোটা দাগে এই মানুষগুলো দুটো শ্রেণিতে পড়ে। একদলের কথার নমুনা অনেকটা এই ধাঁচের:’ ঘরে নিশ্চয় কোন সমস্যা হয়েছে। তা না হলে স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পরও বাড়ি না ফিরে এভাবে কেউ বসে থাকে?’ ‘হুম, ওর হাজবেন্ডের সাথে মনোমালিন্য চলছে। জানেন না, বেশ কদিন ধরে বাবার বাসা থেকে আসা-যাওয়া করছে? বেচারি!’ ‘হবে না! বিয়ের পর এতোগুলো বছর হয়ে গেলো। এখনো একটা বাচ্চা-কাচ্চার মুখ দেখলো না। মন খারাপ থাকাটাই তো স্বাভাবিক।’ ইত্যাদি।
বেশিরভাগ সময় মানুষের কথার সুরে বা জিজ্ঞাসায় না-ভাবটাই বেশি থাকে।না মানে যে কথার মধ্যে একটু মেলোড্রামা বা দুঃখকষ্টের ইঙ্গিত থাকে। সৃষ্টিগতভাবে মানুষ মানুষের কষ্টের খবর শুনতে বা দেখতে বেশি আগ্রহ বোধ করে। অ্যারিস্টটলের ‘পোয়েটিক্স’ পড়বার সময় ট্রাজেডি নাটকের বিষয়ে এমন একটা ধারণাই পেয়েছিলাম। ওই যে ক্যাথারসিস না পারগেশন কী যেন বলে,মানুষ পয়সা কেটে ট্র্যাজেডি নাটক দেখে এই সান্ত্বনা নাকি নিজেকে দিতে চায় যে, যাক, বাবা, আমার জীবন ইদিপাস বা ইলেক্ট্রার মতো এতো ভাগ্য-বিড়ম্বিত হয়নি তো! অনেক ভালো আছি ওদের চেয়ে! ইত্যাদি।
আবার মানুষের ভেতরে আরেকটা দলও আছে যাদের হৃদয় তুলনামূলকভাবে সহানুভূতিশীল। যদিও তাদের সংখ্যা নগন্য। ভদ্র ভাষায় এদেরকে সংবেদনশীল বলা হয়। অথবা মানবিক হৃদয়সম্পন্ন। কখনও কখনও এই বলার ভেতরে সূক্ষ্ম একটা খোঁচা বা টিটকারির হাল্কা ছোঁয়া থাকে। সংবেদনশীল মানুষদের কখনই প্রাপ্যতা অনুসারে তাদের যোগ্য সম্মানটুকু দেওয়া হয়না। বরং তাদের ব্যাপারে যেন ঠাট্টার সুরটাই মুখ্য থাকে। বাংলা সংবেদনশীল শব্দটা উচ্চারণ করতে সময় এবং কষ্ট দুটোই কিছুটা বেশি খরচ করতে হয় বলে ইংরেজি সেনসিটিভ শব্দটার ব্যবহার বেশি।
সত্যি কথা বলতে কী, কেন যে এতো কথা বলছি নিজেও জানিনা। মনটা আমার আসলে একটু বেশিই খারাপ। এক নামহীন বিষণ্ণতা আমার সারাটা অনুভুতিকে এমন ভীষণভাবে জাপটে ধরেছে যে কিছুতেই এর থেকে নিজেকে টেনে বের করতে পারছিনা। সে কারণেই এসব নানা উলটাপালটা চিন্তা।কিন্তু চিন্তাগুলো যে অযৌক্তিক নয় তাও জানি।
আর ওই যে বলছিলাম, দ্বিতীয় শ্রেণির সংবেদনশীল মানুষের কথা। তাদের কেউ কেউ হয়তো আমার বিষণ্ণ বদন দেখে বলে,’আপনারা একটু বাড়িয়ে বলছেন। হয়তো ওর শরীরটা ভালো না। একবার জিজ্ঞাসা করেছেন? না করেই নিজেদের মন মতো যা খুশি ভাবছেন। একটা মানুষ কি নিজের মতো করে কিছু সময় কাটাতে পারেনা?’ ইত্যাদি।
আমি ওদের প্রত্যেকের কথা শুনে অথবা অনুমান করে মনে মনে হাসি। অবাকও হই, মানুষের কল্পনাশক্তির দৌড় দেখে। মানুষের এমন বিপরীতধর্মী চিন্তা বা ধারণার মধ্যেও একটা বিষয় আবিষ্কার করি। প্রত্যেকে নিজের মতো করে অন্যের সমস্যাগুলো দেখে, ভেবে নেয়। আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখবার মতো। এখন আমি ওদের একেকজনের আয়না।
সুমাইয়া নামের ইতিহাসের যে শিক্ষক আমার বাচ্চা না হবার প্রসঙ্গটা সামনে আনলো, সে নিজেও একই সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছে। বিয়ের সাত বছর পরও যখন স্বামীকে বাবা বানাতে পারলো না, শ্বশুরবাড়ির লোকজন, বিশেষ করে শাশুড়ি আর স্বামীর বড় বোন, ভীষণ ক্ষেপে উঠলো ছেলে/ভাইকে আবার বিয়ে করাবার জন্য। যেন বাচ্চা না হবার একক দায়টা কেবল সুমাইয়ার।
মেয়েটা স্কুলে এসে মনমরা হয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে আঁচলে মুখ লুকিয়ে সামান্য কেঁদে নিয়ে নিজেকে খানিকটা হাল্কা করতে চাইতো। তার ওই কঠিন সময়টাতে একটাই সান্ত্বনা ছিল, স্বামীটা ভালো মনের মানুষ পেয়েছিল। ভালো মানে উদার বা সহৃদয় বা বুঝদার। অনেক ডাক্তার-চিকিৎসা করে আট বছরের মাথায় কন্যা শিশুর বাবা-মা হলো ওরা। তাতেও শ্বশুরবাড়ি খুশি না। বংশের বাতির সেই প্রাগৈতিহাসিক প্যাচাল।
আর, সাবিনা, যে সহানুভূতির সুরে কথা বললো, তার সাথে আমি ডাকনাম শেয়ার করি। আমরা দুজনই লাকি। কিন্তু স্কুলে পোশাকি নাম ব্যবহারের রেওয়াজ। সাবিনা বিয়ে করেনি। করবে বলেও মনে হয়না। অথবা করলেও সেই ভাবনা এখনও দূরবর্তী। বৃদ্ধ বাবা-মাকে আগলে রেখেছে। ছোট বোনটার বিয়ে দিয়েছে। ভাই দুটোকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাবে বলে পণ করেছে। সব ওর স্কুলের বেতনের সামান্য বেতনে।কী করে সব সামাল দেয় ভেবে কূল পাইনা।
খুব মায়া লাগে সাবিনার জন্য। কখনো কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেছে বলে মনে করতে পারিনা। স্কুলে ওর সাথেই যা আমার একটু পর্তা পড়ে মানে কথা বলে আরাম পাই। এই পর্তা পড়া কথা শুনেছি আম্মার মুখে। সুযোগমতো আমিও আমার কথায় চালিয়ে দিই। বইয়ে কখনো পড়িনি। কিন্তু অর্থ অনুমান করা যায়।
স্কুলে অন্যদের সাথে আমার খুব একটা যায়না। কারণ, সবার ধারণা, সামান্য বেতনের চাকরিটা আমার বিলাসিতা। স্বামী সরকারের যুগ্মসচিব। শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও ভালো। তারপরও এই চাকরি কেন করি, এই মনোভাব অধিকাংশ সময় তাদের অভিব্যক্তিতে প্রশ্ন বা বিরক্তি হয়ে ঝুলে থাকে।আমি না করলে কোন একটা গরীব ঘরের ছেলে বা মেয়ে চাকরিটা পেতো। একটা পরিবার উঠে দাঁড়াতে পারতো। ইত্যাদি।
ওদের যুক্তি আমি মানি। কিন্তু এতো কষ্ট করে পড়ালেখা শেষে শুধু ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে চাইনি কখনও। তাছাড়া, চাকরিটা আমি বিয়ের আগে থেকেই করছি। তাই বিয়ের পর স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে কোন আপত্তি না থাকতেও চাকরিটা করে যাচ্ছি।
তবে এটা ঠিক, আপত্তি করলে কী করতাম সেটা এখন আর বলতে পারছিনা। অনেক দিন তো হয়ে গেলো। এর মধ্যে পদ্মা-যমুনায় কত জল গড়িয়ে গেলো! যমুনার কথা বলাতে অনেক কথা মনে পড়তে শুরু করলো। বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় আমরা তাজমহল দেখতে আগ্রা গিয়েছিলাম। শুধু আগ্রা না। কোলকাতাসহ ইন্ডিয়ার আরও দুয়েকটা জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলাম।
আমার প্রথম বিদেশ যাওয়া। বিমানে ওঠা। ও, মানে আমার স্বামী, আমাকে হাত ধরে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। এতো ভালোবাসত আমায়। বিমানের ভেতরে জানালার পাশের সিটটায় বসতে বললো। প্রথম আকাশে ওড়ার যে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা তার সবটুকু স্বাদ যেন আমি পেতে পারি তা নিশ্চিত করেছিল রায়হান।
হুম, রায়হান ওর নাম। তবে কোনদিন এই নামে তাকে আমার ডাকা হয়নি। বিয়ের প্রথমদিকে খুব জোরাজোরি করেছিল তাকে যেন কোন একটা প্রিয় নামে ডাকি। অনেক দম্পতি ভালোবাসায় ভেসে যেমনটা করে থাকে। আমার দিক থেকে তেমন কিছু হয়নি। সে অবশ্য আমাকে একটা বিশেষ নাম দিয়েছিল। নামটা এখন আর বলতে চাইনা। ওটা আমার কাছেই থাকুক। শুধু আমার নিজস্ব কিছু প্রিয় বিষয়ের একটা হয়ে।
আসলে এতো কথা কেন বলছি নিজেও বুঝতে পারছিনা। মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি কখন যে বদলে যায় কেউ বলতে পারেনা। সেই বদলে যাওয়া জীবনের অনেক কিছুই আর আগের মতো সহজ থাকেনা। অনেক কৃত্তিম জটিলতায় সহজ-সরল জীবনটা হয়ে পড়ে দুর্বিষহ।ভাবলে কেবল অব্যক্ত যন্ত্রণা আর কষ্টে ভেতরটা গুমড়ে ওঠে।
এই যেমন আমিও ভাবতে পারিনি, সরল বিশ্বাসে একজনের সাথে কথা বলতে গিয়ে তার পরিণাম আমার জীবনে এতো বড় অভিশাপ হয়ে আসবে। কত কারণেই তো মানুষ মানুষের সাথে কথা বলে। বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কে জড়ায়। আমি শুধু কথার খাতিরে একজনের সাথে কিছুদিন কথা বলেছিলাম। কিছুটা প্রয়োজনে, বেশিরভাগটাই অপ্রয়োজনে। কিন্তু সেটাই আমার জীবনে এক বিভীষিকাপূর্ণ কালো অমানিশায় রুপ নিয়েছে।
এজন্য এখন আর মানুষের সাথে দরকারের বাইরে কোন কথা বলতে মন সায় দেয় না। কে জানে, কোন কথার কী অর্থ দাঁড়ায়।কার মনেই বা কী আছে। আমিও যেমন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি, একজন মানুষের সাথে কথা বললে তার ফলাফল এতোটা ভয়াবহ হতো পারে। সারা জীবনের জন্য হারাতে হতে পারে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার বিশ্বাস।
প্রথম দিকে না বুঝলেও মাঝামাঝি একটা সময় বুঝতে পারছিলাম, যার সাথে আমি কথার খাতিরে কথা বলছি, তার মনে অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। সেজন্য নিজে থেকেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া, নিজের ওপর বিশ্বাস এতোটাই দৃঢ় ছিল যে ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে চাইনি।
আর একজন মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে কোন কারণ ছাড়া হুট করে তা বন্ধ করে দেওয়া যায়না। কিছুটা সময় নিতে এবং দিতে হয়। সেই সময়টার আগেই আমি বিশ্রীভাবে হেরে গেলাম। কাছের মানুষটার বিশ্বাসই শুধু হারালাম না, দারুণ বিস্ময়ে একটি পুরনো কথা নতুনভাবে উপলব্ধি করলাম। আমি/আপনি যতই সচেতন থাকি, শত্রু আমাদের ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে শ্বাস ফেলছে। সামান্য এদিকওদিক হয়েছে কী মরেছেন। কাজেই, সাধু সাবধান!
আচ্ছা, আমি কি একটু অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেছি? তাই তো মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছি, নিজের মনে আমি যা বলে চলেছি, তার পুরোটা এখনও পরিস্কার নয়। একেবারে যে বোঝা যাচ্ছে না তা নয়। কিন্তু একটা অস্পষ্ট ধোঁয়াশা আমার বলতে চাওয়া কথাগুলোকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। হয়তো,আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই এমনটা করছি।
কথাগুলো আমি ভাবছি যখন ১ সেপ্টেম্বর রাতে দেখা লম্বা স্বপ্নটা ভেঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঁচের গুঁড়ার মতো।স্ফটিকের দানার মতো। চকচকে গোল মার্বেলের মতো। গোলাপের ঝরে পড়া পাপড়ির মতো। একটা দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন ভেঙ্গে অনেকগুলো ছোট ছোট স্বপ্ন হয়ে এখন জেগে ওঠা এই আমাকে ক্রমাগত অস্থির করে তুলছে।
একটা ছোট্ট স্বপ্নের টুকরার ভেতর আমি নিজেকে বিয়ের সাজে দেখতে পাচ্ছি। অনেক লোকের ভিড় বিয়েবাড়িতে। আমাকে একটু পরেই বিদায় দেওয়া হবে। চারদিক থেকে নানা ধরনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই আওয়াজ বা শব্দ বা চিৎকারগুলো যা আশেপাশের অন্য বাড়িগুলো থেকে বিয়েবাড়িকে আলাদা করে দেয়। ছোট ছেলেমেয়েদের দৌড়াদৌড়ি,বাড়ির পুরুষদের হাঁকাহাঁকি, আলাদা সুরে মহিলাদের নিজস্ব কথামালা; এর মধ্যে একটা বাচ্চার জোর কান্নার ধ্বনি। কেউ একজন বলছে, ‘বর তো এখনও এসে পৌঁছায়নি।’ বর কি আসবেনা? আমি এর মধ্যেই ভাবতে থাকি।
আরেকটা স্বপ্নের দানার মধ্যে আমি একটা দ্বিধার দ্বন্দে দুলছি। বিয়েবাড়ি থেকে ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে বের করে আনা হচ্ছে আমাকে।আমি তো চলছি না। আমাকে যেন একটা ঢেউয়ের ঠেলায় সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।বেশ খানিক ক্ষণ পরে মনে করতে পারলাম, আমার বিয়ে হচ্ছে আমার এক প্রিয় বান্ধবীর ক্যাবলাকান্ত ভাইয়ের সাথে। নিশ্চয় আমি কোন অঘটন ঘটিয়েছি।তা না হলে যে ছেলের বোকামি নিয়ে আমরা সবসময় হাসাহাসি করে, শেষ পর্যন্ত কিনা তার সাথেই আমার বিয়ে! আশ্চর্য! এটা কি আমার কোন ভুলের শাস্তি? আমি কি তাহলে একটা বদ চরিত্রের লোকের সাথে গোপনে দিনের পর দিন কথা চালিয়ে গিয়ে আমার ভালমানুষ স্বামীটাকে ঠকিয়েছিলাম? কিন্তু আমার মনে তো কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না।
‘ছিল না?’ বলে কেউ সজোরে আমার গালে একটা চড় মেরে বসলো।ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে আমি নিজের গালে নিজেই হাত বুলাতে লাগলাম। আর হঠাৎ একটা প্রশ্ন কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে গভীরভাবে তাকালো।তাতে আমার ভেতরটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। প্রশ্নটা আমার কাছে জানতে চাইলো, আমার নিজের মধ্যেও আসলে কোন দুর্বলতা কাজ করেছিল কিনা। প্রশ্নটা আমাকে আরও অভয় দিলো এই বলে যে আমি এখন নির্দ্বিধায় সত্যি কথাটা বলতে পারি। কারণ, এর মধ্যে সময় অনেক গড়িয়েছে। আর আমার স্বামীও বুঝতে পেরেছে, ব্যাপারটা নিয়ে সে যতটা শঙ্কিত ছিল ঘটনা তত ঘোলা নয়। কিছু সময়ের জন্য আমার মতিভ্রম হয়েছিল। এই যা!
কিন্তু আমার ভেতরের আরেকটা আমি জানি যে, ডাল মে কুছ কালা থা। ওই লোকটা আমাকে তার কথার জালে আটকে ফেলেছিল। বুঝতে পারছিলাম, ভুল হচ্ছে। এসব অর্থহীন কথা একটা সম্পর্ককে কোথাও নিয়ে যায়না। আমি ঠিক জানিনা, লোকটার মনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল। কিন্তু তার বলা কথাগুলোয় প্রলুব্ধ করবার মতো যথেষ্ট উপাদান ছিল। আমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমতি ভেবে সেগুলোর ফাঁদ গলে থাকতে চাইছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেলাম।না, লোকটার কাছে না। আমার স্বামীর কাছে। তারপর থেকে সে আমাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করলো। তারপর থেকে আমার ভেতরে এই ভাঙ্গনের শুরু।
অথচ, এতোদিন পরে যখন সবকিছু থেমে স্থির হয়ে গেছে,অস্থিরতা-অভিযোগ আর অস্বীকার-এর জঞ্জালগুলো নীরবতার নীচে তলানির মতো জমে গেছে, তারপরও কোন কোনদিন হঠাৎ আমি আবার নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিই। সেই পুরানো প্রশ্নটার মুখোমুখি করি নিজেকে। সত্যিই কি আমার মনে অন্যরকম কিছু ছিল? তা না হলে ব্যাপারটা এতো দূর গোড়াতো না। এতোদূর মানে ততদূর যেখানে কোনকিছু অস্বীকার করলে নিজেকে আস্ত একটা আহাম্মকের মতো দেখায়। সমস্যা হয়েছিল মূলত পুরো বিষয়টাই আমি আমার নিজের মতো করে দেখতে চেয়েছিলাম। আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম, আমি মানে দুনিয়া না।আমার চিন্তা-ভাবনার বাইরে একটা গোটা পৃথিবী তার নিজের মতো করে চলে। আর তাই ওই লোকটার সাথে শুধু কথা বলার জন্য বলার ব্যাপারটা ততোটা নির্দোষ ছিলনা যতটা আমি ভাবতে চেয়েছিলাম। একটা কিন্তু সবসময় ছিল। বোকার মতো হোক অথবা আমার সহজাত সরলতার কারণে হোক, বুঝতে বুঝতে আমি বেশ দেরি করে ফেলেছিলাম।
আর তারপর থেকে আমার সমস্যার শুরু। মনে হয়, সবকিছু ভেঙে পড়ছে চারপাশ থেকে। গোলাপের ঝরে পড়া পাপড়ির মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাটিতে। আমি ঝরে পড়া এক একটা পাপড়ির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, আমার গায়ে বিয়ের ভারি গোলাপি বেনারসি। ক্যাবলাকান্ত ছেলেটা একদম আমার পাশেই বসে আছে।লজ্জায় জড়সড় হয়ে। কে যেন ওকে বলেছে, নতুন বরকে মুখে রুমাল দিতে হয়।ও ঠিক তাই করেছে।
আর আমি মনে করার চেষ্টা করছি,আজ কত তারিখ। একবার সামনে তাকিয়ে দেখি, একটু দূরে হল রুমের একটা দরজার পাশে আমার স্বামী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর অপলক দৃষ্টি আমার মুখের ওপর আঠার মতো সেঁটে আছে। আমাদের দুজনের চোখাচোখি হলো। ঠিক যেন শুভদৃষ্টি বিনিময়! আর তখনই, ঠিক তখনই আমার মনে পড়ে গেলো, আজ পহেলা সেপ্টেম্বর-আমাদের বিয়ে বার্ষিকী!কততম? থাক, আজ সে কথা।
সারাবাংলা/পিএম