লালুর মতো এসেছে অনেকই
৮ জানুয়ারি ২০১৯ ১৩:৪৪
শেখ সাদী ।।
লালুই নয় কুকুর এসেছে নানারূপে। গল্প, কবিতায়, নানাভাবে হাজির হয়েছে। শিশুপাঠ্য থেকে গোরার মত উপন্যাসেও এসেছে।
‘লেজ নড়ে, ছায়া তারি নড়িছে মুকুরে
কোনোমতে সেটা সহ্য করে না কুকুরে।
দাস যবে মনিবেরে দোলায় চামর
কুকুর চটিয়া ভাবে, এ কোন্ পামর?
গাছ যদি নড়ে ওঠে, জলে ওঠে ঢেউ,
কুকুর বিষম রাগে করে ঘেউ-ঘেউ।
সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে
ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারি প্রভু-কোলে।
মনিবের পাতে ঝোল খাবে চুকুচুকু,
বিশ্বে শুধু নড়িবেক তারি লেজটুকু।’
-কণিকা ১৮৯৯
২.
এসেছে উপমায়। কাহিনির চরিত্রে। পরিবেশে। এবং নিজমহিমায়।
উপমায় দেখা পাই শেষ লেখা ৪-এ।
‘রৌদ্রতাপ ঝাঁঝাঁ করে
জনহীন বেলা দুপহরে।
শূন্য চৌকির পানে চাহি,
সেথায় সান্ত্বনালেশ নাহি।
বুক ভরা তার
হতাশের ভাষা যেন করে হাহাকার।
শূন্যতার বাণী ওঠে করুণায় ভরা,
মর্ম তার নাহি যায় ধরা।
কুকুর মনিবহারা যেমন করুণ চোখে চায়
অবুঝ মনের ব্যথা করে হায় হায় ;
কী হল যে, কেন হল, কিছু নাহি বোঝে —
দিনরাত ব্যর্থ চোখে চারি দিকে খোঁজে।
চৌকির ভাষা যেন আরো বেশি করুণ কাতর,
শূন্যতার মূক ব্যথা ব্যাপ্ত করে প্রিয়হীন ঘর।‘
৩.
গোরা কহিল, কেন চাইব না? কিন্তু পরিবর্তন তো পাগলামি হলে চলবে না। মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে— ছেলেমানুষ ক্রমে বুড়োমানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ তো হঠাৎ কুকুর-বিড়াল হয় না।
গোড়ায় গলদ-এ বললেন, ‘এতদিন আমার টাকা ছিল না, অভাবও ছিল না—বিয়ের পর থেকে দারিদ্র্য বলে একটা কদর্য মড়াখেকো শ্মশানের কুকুর জিব বের করে সর্বদা আমার চোখের সামনে হ্যাঁ হ্যাঁ করে বেড়াচ্ছে—তাকে আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি নে।’
৫.
স্যার লেপেল গ্রিফিনের বাঙ্গালী জাতীর প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রবন্ধের লিখলেন।
প্রতিবাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ। এনেছেন খেঁকি কুকুরের তুলনা, ’কুকুর সম্প্রদায়ের মধ্যে খেঁকি কুকুর বলিয়া একটা বিশেষ জাত আছে, তাহাদের খেঁই খেঁই আওয়াজের মধ্যে কোনোপ্রকার গাম্ভীর্য অথবা গৌরব নাই। কিন্তু সিংহের জাতে খেঁকি সিংহ কখনো শুনা যায় নাই। স্যার লেপেল গ্রিফিন জুন মাসের ফর্ট্নাইট্লি রিভিউ পত্রে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে-একটা প্রবন্ধ লিখিয়াছেন তাহার মধ্যে ভারি-একটা খেঁই খেঁই আওয়াজ দিতেছে। ইহাতে লেখকের জাতি নিরূপণ করা কিছু কঠিন হইয়া পড়িয়াছে।’
৬.
জীবনস্মৃতির বিলাত পর্বে লিখেছেন, ‘বার্কার-জায়ার সান্ত্বনার সামগ্রী ছিল একটি কুকুর— কিন্তু স্ত্রীকে যখন বার্কার দণ্ড দিতে ইচ্ছা করিতেন তখন পীড়া দিতেন সেই কুকুরকে। সুতরাং এই কুকুরকে অবলম্বন করিয়া মিসেস বার্কার আপনার বেদনার ক্ষেত্রকে আরো খানিকটা বিস্তৃত করিয়া তুলিয়াছিলেন’।
মানুষের সাথি ও কাহিনির চরিত্র হিসাবে কুকুরের এই আগমন।
গোরা উপন্যাসের একটি চরিত্র সতীশ কুকুর প্রেমিক তাই এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ কুকুরের প্রসঙ্গ এনেছেন এইভাবে-
সতীশ হঠাৎ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা বিনয়বাবু, আপনার কুকুর নেই?
বিনয় হাসিয়া কহিল, কুকুর? না, কুকুর নেই।
সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, কেন কুকুর রাখেন নি কেন?
বিনয় কহিল, কুকুরের কথাটা কখনো মনে হয়নি।
আরেক জায়গায় বললেন, ‘এমন সময় সতীশ তাহার অচিরজাত কুকুর-শাবকটাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া লাফাইতে লাফাইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। হরিমোহিনী ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বাবা সতীশ, লক্ষ্মী বাপ আমার, ও-কুকুরটাকে নিয়ে যাও বাবা!’
সতীশ কহিল, ‘ও কিছু করবে না মাসি! ও তোমার ঘরে যাবে না। তুমি ওকে একটু আদর করো, ও কিছু বলবে না।
হরিমোহিনী সরিয়া গিয়া কহিলেন, ‘না বাবা, না, ওকে নিয়ে যাও।’
তখন আনন্দময়ী কুকুর-সুদ্ধ সতীশকে নিজের কাছে টানিয়া লইলেন। কুকুরকে কোলের উপর লইয়া সতীশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি সতীশ না? আমাদের বিনয়ের বন্ধু?
৭.
চরিত্র হিসাবেও এসেছে কুকুর।
গোরা উপন্যাসের এই পর্বে কুকুর আনন্দময়ী ও হরিমোহিনীর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। অনেক সময় কুকুর হয়েছে পারিবারিক সদস্য।
যোগাযোগ গল্পে বললেন, ‘পাশে বসে কুমু নিজের দুই ঠাণ্ডা হাতের মধ্যে দাদার শুকনো গরম হাত তুলে নিলে। বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুর খাটের নীচে বিমর্ষ মনে চুপ করে শুয়ে ছিল। কুমু খাটে এসে বসতেই সে দাঁড়িয়ে উঠে দু পা তার কোলের উপর রেখে লেজ নাড়তে নাড়তে করুণ চোখে ক্ষীণ আর্তস্বরে কী যেন প্রশ্ন করলে।
শেষের কবিতায়, ঝাঁকড়া-চুলে-দুই-চোখ-আচ্ছন্নপ্রায় ক্ষুদ্রকায়া ট্যাবি-নামধারী কুকুর।
সে একবার ঘ্রাণের দ্ববারা লাবণ্য ও সুরমার পরিচয় গ্রহণ করেছে। আর, শেষ সপ্তকের ৩২ নম্বর কবিতায় কুকুর ডাকে অকারণে ।
এসেছে চিত্রায়।
‘চিত্রা নির্জন পথ চিত্রিতবৎ, সাড়া নাই সারা দেশে
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে ।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে —
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘন্টা বাজে ।
অফুরান পথ,অফুরান রাতি, অজানা নূতন ঠাঁই —
অপরূপ এক স্বপ্নসমান।’
সারাবাংলা/পিএম