ঘেঁটু গান
১৯ জানুয়ারি ২০১৯ ১৪:১৬
শেখ সাদী ।।
ঘেঁটু বা ঘাঁটু। যে নামে চিনি না কেন একি কেবল লোকগান?
লোকায়ত সংস্কৃতির ইতিহাস বলছে ঘাঁটু চর্মরোগের দেবতা।
তাহলে?
২.
‘শোন শোন সর্বজন ঘাঁটুর জন্ম বিবরণ।
পিশাচ কুলে জন্মিলেন শাস্ত্রে লিখন।
বিষ্ণুনাম কোনমতে করবে না শ্রবণ
তাই দুই কানে দুই ঘন্টা করেছে বন্ধন।’
৩.
ঘাঁটুর আরেক নাম ঘণ্টাকর্ণ। চর্মরোগের দেবতা।
শোনা যায় ঘাঁটু সূর্য ও ধর্মঠাকুরের লৌকিক রূপ। কারণ, সূর্য ও ধর্মঠাকুর দুজনই কুষ্ঠ ও নানারকম চর্মরোগ থেকে মুক্তি দেন।
যাইহোক, দেবকুমার থাকা অবস্থায় বড় বড় অপরাধের জন্য বিষ্ণু অভিশাপ দেন।
এতে করে জন্ম নিতে হয় পিশাচ কুলে। রাগে ফুলে থাকতেন। কোনোভাবেই যেন বিষ্ণু নাম কানে না আসে সেজন্য দুই কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখার কারণে নাম হয় ঘণ্টাকর্ণ। কোনো মন্দিরে ঘাঁটু দেবতার পূজা হয় না। পূজা হয় বিল হাওড়ের পাশে রাস্তার মোড়ে।
চর্মদেবতা ঘাঁটুর নাম ও আচরণ যেমন মূর্তিটিও অদ্ভুত।
ব্যবহার হওয়া আধভাঙা মাটির হাড়ি উল্টো করে রাখা হয়, এটি আসন। এর ওপরে একদলা গোবর দিয়ে করা হয় ঘাঁটু দেবতার মুখ। চোখ তৈরি করা হয় দুটি কড়ি দিয়ে। কপালের অংশে দেয়া হয় সিঁদুরের তিলক। হাড়ির ওপরে রাখা হয় দুর্বা ঘাস ও ভাটকুল ফুল। কোনো কোনো এলাকায় ঘাঁটুর পোশাক হিসেবে হাড়িতে জড়িয়ে দেয়া হয় হলুদ ছাপানো কাপড়। আর ভাঙাহাড়ির ভেতর জ্বালানো হয় মোমবাতি। পূজা পায় চৈত্র মাসের শেষ দিন।
৪.
খুব ভোরে অর্ঘ্য দেন কোন এক নারী।
এলোমেলো চুলে থাকা ওই নারীর হাতে থাকা মাটির পাত্রে রাখা হয় সেদ্ধ চাল, মসুরের ডাল। কোন এলাকায় চাল আর গুড় দেয়া হয়।
কোন মন্ত্র নেই। কেউ কেউ দু-একটি ছড়া বলেন।
পূজা শেষ হলে ছোট ছেলেমেয়েরা লাঠি দিয়ে ঘাঁটুর আসন মানে মাটির হাড়িটা ভেঙে দেয়। এরপর গোবরের টুকরো আর কড়ি বাড়ির চৌকাঠের ওপর রেখে দেয়া হয়। এর মানে এই পরিবারে এবার কারো চর্ম রোগ হবে না।
পূজার এখানেই শেষ নয়। চলে পুরো চৈত্র মাস। ঘাঁটুর প্রতীক হিসেবে প্রদীপ নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি যায়, এসময় গান করে।
‘আলোর মালা চাল-ডাল দাও
নয় খোসপচড়া লও।
যে দেবে ধামা ধামা
তারে ঘাঁটু দেবে জরির জামা
যে দেবে শুধু বকুনি।
ঘাঁটু দেবে তাকে খোস-চুলকানি।’
গান শুনে বাড়ির কর্তা ছেলেদের চাল দেয়। কেউ দেয় চাল ডাল দুটোই। এভাবে চাল-ডাল জোগাড় কওে ছেলেরা দলবেধে রান্না করে।
এভাবে ঘাঁটু গানের জন্ম। এখন বেশিরভাগ এলাকার লোকজন জানেন না ঘাঁটু একজন দেবতা।
এখনকার গানের কথা অন্যরকম।
‘আমি উড়িয়া বেড়াই দুনিয়ার মাঝে
মনের মানুষ পাইলাম না।’
গানের সুরে কথায় মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায় ঘেঁটু গানের বালকেরা।
পায় কি মনের মানুষ?
৫.
প্রাণের আকুতি ফুটে ওঠে গানের কথা আর সুরে।
‘আমার দুঃখের কথা কারে জানাই, লো সই
যাইতে যমুনার ঘাটে, ওলো সই, আমি তোরে
দুঃখের কথা শুনাই।
চোখের জলে ভইরাছে আমার কাঙ্খের কলসি, লো সই
কোনখানে যে বাজে বাঁশি, শুইনা হয় মন উদাসী
ঘরে যাইতে, বারেবারে পথ ভুইলা যাই
দুঃখের কথা কারে জানাই,ওলো সই।’
এভাবে মনের আকুতি জানায় ঘাটুরা। এই আকুতি শোনা যায় ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে এবং ভারতের ত্রিপুরার কিছু অঞ্চলে হয় ঘেঁটুগান।
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামের গরিব পরিবারের ছেলেদের যাদের গলায় গান তাদের নিয়ে ঘেঁটুগানের দল গঠন করে। এরপর দলের ছেলেদের নাচ শেখানো শুরু হয়।এই দলে যারা স্থান পায় তাদের বলে ঘাটু।
এও দেখা যায় দলপতি টাকার বিনিময়ে ঘাটু বালকদের নিয়োগ দেন।
ঘেঁটুগান একসময় মেয়েরা করতো। পরে বালকরা মেয়ে সেজে এই নৃত্যগীত করে।
বর্ষা ও শরৎকালে ঘেঁটুগানের চল বেশি। এই সময় বর্ষার পনিতে চারদিক থইথই করে। হাওড়-বাওড়ের যে দিকে চোখ যায় পানি আর পানি। মাঠে ফসল থাকে না। চাপ থাকে না কাজের। এরকম অলস দিনে নৌকার পাটাতনের ওপর আসর বসে।
এই নৌকা ভেসে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রামে।
শিল্পীরা নৌকার ওপর গান করতেন। দর্শকেরা নদীর পারে দাঁড়িয়ে শোনে ঘেঁটুগান।
গানের দুটি অংশ। প্রথম অংশে বালক ঘাটু একক সংগীত পরিবেশন করত। অন্যটি ঘেঁটু দলের শিল্পীরা একসাথে গান করে। ওই সময় গানের তালে তালে নাচে ঘাটু বালক। পরনে থাকে নারীর পোশাক। মাথায় লম্বা চুলের বেণী। গলায়, কানে, হাতে অলংকার।
এখন ঘাঁটু গানের বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক।
শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনতে পেয়ে রাধা যখন যমুনার জল আনতে গেলেন, তখন তিনি জলের মধ্যে কৃষ্ণের মুখচ্ছবি দেখতে পান।কৃষ্ণ তখন কদমডালে। বাঁশিতে সুর তুলেছেন।
সারাবাংলা/পিএম