ফরিদ কবিরের কবিতা দার্শনিকতায় মোড়া যাদু বাস্তবতা
২৬ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:৩৮
কামরুল হাসান শায়ক ।।
রাস্তাও মানুষ খোঁজে, সেও জানে
যে পথে যায়না কেউ, সে পথ কখনো পথ নয়…
(রাস্তা/ফরিদ কবির)
এক.
ফরিদ কবির মূলত কবি হলেও সাহিত্যের সব শাখায় রয়েছে তার দাপুটে বিচরণ। ফরিদ কবির যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন তখন তার সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের কবিদের অধিকাংশরা যেভাবে কবিতায় প্রেম, রাজনীতি আর প্রকৃতিকে তরলভাবে উপস্থাপনের মিছিলে নেমেছিলেন সেখানে ফরিদ কবিরকে একটু সতর্কভাবে পা ফেলতে হয়েছে। এই পা ফেলতে গিয়ে ফরিদ কবির আশির দশকের কবিদের চেয়ে নিজেকে, নিজের কবিতাকে বহু বর্ণিল আভায় রাঙিয়ে তুলেছিলেন। তিনি তার কবিতায় স্বাধীনতা উত্তর এক অস্থির সময়কে এক বিশাল ক্যানভাসে এঁকেছেন। ফরিদ কবির তাঁর কবিতায় দেশ আর দেশের মানুষের প্রেম, ভালবাসা, চাওয়া-পাওয়া আর দ্রোহের অনুভূতিগুলোকে কবিতার জমিনে অসম্ভব মায়াবি ভাষায় তুলে আনতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয় আমাদের চোখের সামনেকার নিরীহ সাধারন মানুষের অন্তর্নিহিত সুখ দুঃখ আর তাদের মনোযাতনার কথাগুলোকেও জাদুকরী উপমা- উৎপ্রেক্ষায় তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
ফরিদ কবিরের কবিতায় চিরায়ত উপলব্ধির পাঠ সন্ধান তো থাকেই পাশাপাশি তাঁর কবিতার শরীরে এক ধরনের দার্শনিক অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গও বারবার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে তাঁর কবিতায় নানাভাবে, আকারে ইঙ্গিতে অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে যাদু বাস্তবতার ছোঁয়া। তাঁর প্রমাণ মেলে অনেক কবিতায়। ফরিদ কবিরের ‘ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম’ গ্রন্থের কয়েকটি কবিতার পংতিতে এ বিষয়টি বেশ পরিস্কার হয়ে ওঠে। যেমন ‘তোমার চাইতে উঁচু নয় কোনো গর্বিত পাহাড়ও / তুমি ছোট হতে হতে তাকে এই উচ্চতা দিয়েছো ’ (পাহাড়), ‘ বলি আজ শোনো-ঘুণপোকারাই অধিক মানুষ / তাদের দাঁতের নিচে নিরাপদে নিদ্রা যায় অপর ঘুণেরা ’ (ঘুণপোকা ), কিংবা ‘ তবে, মানো আজ / এই বনে ঘাসেরাই প্রকৃত শাসক / আকাশ-পাতাল আজ পূর্ণ হোক তাদের শাসনে’ (ঘাস)।
শুধু ‘ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম’ গ্রন্থই নয় ফরিদ কবিরের সব কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে দার্শনিকতার এক নিজস্ব প্রলেপ যা তাঁর কবিতার পাঠককে নিয়ে যায় ভাবনার আরেক জগতে।
কবিতার বিষয়আশয় আর নির্মাণ শৈলীর কারণে তাঁর কবিতা সমকালীন কবিদের কবিতার তুলনায় হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। খুব বেশি বেশি কবিতা লিখে পাঠকের নজরে থাকতে হবে কিংবা তাদের নজর কাড়তে হবে অথবা সব সময় নিজেকে আলোচনার পাদপ্রদীপের তলায় রাখতে হবে এমন স্বভাবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ফরিদ কবির খুব সাধাসিধেভাবে ‘কবিতা-জীবন’ মতবাদে বিশ্বাসী। কম লিখে নিজের শক্তিমত্তাকে প্রকাশ করার দুর্নিবার সাহস আছে তাঁর।
দুই.
মাত্র পাঁচটি বই আর প্রায় দুশো কবিতা লিখে ইতিমধ্যে ফরিদ কবির সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় নিজেকে অপ্রতিদ্বন্ধি করে তুলেছেন। প্রথম কবিতার বই ‘হৃদপিন্ডে রক্তপাত’র পর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে নিবিষ্ট চিত্তে কবিতায় বসবাস করা ফরিদ কবির গদ্যেও নিজের অসাধারন দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। প্রবন্ধেও তিনি সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্প্রতি ফরিদ কবিরের সাহসী রকমের আত্মকথা ‘ আমার গল্প ’ পাঠক মহলে নানা কারণে সাড়া ফেলেছে। পেশাগত জীবনের বাইরে তাঁর অনেক পরিচয় রয়েছে। সাংবাদিকতা, প্রকাশনা বিশেষজ্ঞ, সাহিত্য সমালোচক, শিল্প রসিক- সব কিছু ছাড়িয়ে ফরিদ কবির অসম্ভব প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর এক শব্দ প্রেমিকের নাম।
শক্তিমান কবি ফরিদ কবিরের ৬০তম জন্মদিনে অফুরান ভালোবাসা।
প্রতিকৃতি : মনিরুল ইসলাম
সারাবাংলা/পিএম