Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আলখেল্লার আইকন


২৭ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৪

শেখ সাদী ।।

যা পরতেন সেটাই মানিয়ে যায়, মনে হয় পেশাকটি যেন তাঁর পরার অপেক্ষায় ভাঁজ হয়ে এতদিন বসে ছিল।
প্রিয় পোশাক আলখেল্লা। এই আলখেল্লার আইকন হয়ে ওঠেন তরুণ বয়সে, বাল্মীকির প্রতিভা গীতিনাট্য করার সময়। দিনটি ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮১। জোড়াসাঁকো বাড়ির তেতলার ছাদে মঞ্চস্থ হয়।

দর্শক সারিতে বসে আছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় ও রাজকৃষ্ণ রায়সহ বড় বড় মানুষ। শুরু হলো বাল্মীকি প্রতিভা। প্রথমেই মায়ার-জগৎ। শুরু হলো আলোর ঝিলিক। ডাম্বেল গড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে বজ্রধ্বনি। আর টিনের নলের সাথে ঝাঁঝারি ব্যবহার করে শোনানো হচ্ছে অঝোরে ঝরে পড়া বৃষ্টির শব্দ। এমন মায়াবী জগতে প্রবেশ করলেন এক যুবক। দীর্ঘ পুরুষটি বাল্মীকি। মানে বাল্মীকির অভিনয় করছেন। পরনে আলখেল্লা। পায়ে চটি। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।
বাল্মীকি গান ধরলেন। দেশ বিদেশের সুর একাকার হয়ে গেল। একসময় বাল্মীকি গাইলেন রামপ্রসাদী, ‘শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা।’
কে অভিনয় করছেন বাল্মীকির? চিনতে পারছেন?
এই প্রশ্নটা করলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
উত্তর দিতে পারলেন না পাশে বসে থাকা গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়।
এক সময় শেষ হলো বাল্মীকির প্রতিভা গীতিনাট্য। মঞ্চ থেকে নেমে এলেন বাল্মীকির অভিনয় করা যুবকটি।
ও ও এ-তো দেবেন্দ্রর ছেলে রবি। সবার চোখ বড় হয়। রবির নতুন রূপ দেখে। চেনা অথচ অচেনা। নাটকের আগে বিদেশি রাজাদের ‘ম্যান্টল’ বা আলখাল্লার আদল আর ঋষিসুলভ গেরুয়া রঙটায় দেশি বিদেশি রীতি মিলিয়ে অন্যরকম পেশাকের জন্ম দিয়েছেন।

বাল্মীকি প্রতিভার পর মঞ্চস্থ হলো কালমৃগয়া। এবার রবি সাজলেন অন্ধমুনি। এর কিছুদিন পর রবি এলেন শিলাইদহে। এখানে পরিচয় ঘটলো কুষ্টিয়ার বাউল ফকিরদের সঙ্গে।
বাল্মীকির পর অন্ধমুনির পোশাক এবার যোগ হলো বাউল-পোশাক। মানে বাউলদের জোব্বা। এই তিনরূপে গড়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথের আলখেল্লার নব-রূপ। এই কাজে সাথে ছিলেন দুই ভাইপো। গগন ও অবন।
বড় বাবার সন্তান রবি। আবার প্রিন্স দ্বরকানাথ ঠাকুরের নাতি রবির পোশাক ছিল সাদামাটা। বিলাস করার কোন উপায় ছিল না। কিশোর রবিকে সাথে নিয়ে হিমালয় ঘুরতে যাবার সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করে দিয়েছিলেন পোশাক। ঠাকুরবাড়ির দর্জি ফতেউল্লাহকে ডেকে পুত্রের জন্য জরির কাজ করা জোব্বা আর জরির কাজ করা মখমলের টুপি তৈরির নির্দেশ দেন দেবেন্দ্রনাথ।
সেই প্রথম জোব্বা পরা।

বিজ্ঞাপন

এরপর ধাপে ধাপে তিন ধারার মিলনে তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জোব্বা।
মঞ্চে দেখা দিতেন কখনো অচলায়তনের দাদাঠাকুর রূপে। কখনো ডাকঘরের ঠাকুরদা। শারদোৎসবের সন্ন্যাসী বা মুক্তধারার ধনঞ্জয় বৈরাগীর বেশে। এভাবে চলতে চলতে হয়ে উঠলেন একজন ‘রবি বাউল’।
ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা শরীরে সাথে ধীরে ধীরে মানিয়ে যায় আলখেল্লা।

সাল ১৯০৮। শারদোৎসব নাটকে সন্ন্যাসীর ভূমিকায় দারুন অভিনয় করলেন রবি। দর্শকের একবারও মনে হলো না এটা অভিনয়। দুই বছর পর ১৯১০’এ রাজা নাটকে ঠাকুরদা হলেন কবি। কোনটাতেই পাগড়ি দরকার হলো না। গেরুয়া খিলকার ওপর পরলেন ফুলের মালা। পোশাকের খানিকটা বদল করলেন। সাদা রেশমের পেশাকের ওপর চওড়া লাল কোমরবন্ধনী পরলেন।
ফাল্গুনি নাটকে তিনি সাজলেন অন্ধবাউল।
এভাবে ব্যক্তিজীবন থেকে মঞ্চের অভিনয়, আলখেল্লার আইকন হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন আশ্রমে থাকার সময় পরতেন দু-সুতির লুঙ্গি। উপরে থাকতো ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি। এই পাঞ্জাবিটাও অনেকটা আলখেল্লার কাছাকাছি।

লুঙ্গিরও ডিজাইন বদল করেছিলেন তিনি।
লুঙ্গি আর পেটিকোটের রূপ ছিল সেটায়। রঙ হতো সাদা বা গেরুয়া। কোথাও যাবার সময় পরতেন সিল্কের লুঙ্গি। পাঞ্জাবির ওপরে পরতেন দুটো জোব্বা। ভেতরের জোব্বাটি বুক ঢাকা। পুরাতন কুর্তার মতো বুকের ওপর আড়াআড়ি করে কোমরে বোতাম লাগানো। উপরেরটি গলা হতে পা পর্যন্ত সামনের দিকে সবটাই খোলা। আলগা হয়ে ঝুলে থাকতো গায়ে। নানা রঙের জোব্বা পরতেন। কালো, ঘননীল, খয়েরী, বাদামী, কমলা, গেরুয়া, বাসন্তী, মেঘ-ছাই।

শীতকালে পরতেন কালো বা ছাই রঙের হোজ।
হোজ হলো বিলিতি গ্রেট-কোট আর ভারতীয় শেরওয়ানির মিশেলে তৈরি নতুন পোশাক। এর উপরে পরতেন শাল-চাদর। মাথায় টুপি। নানা ধরনের টুপি তৈরি করে নিয়েছিলেন। সুতি বা পুরু ভেলভেটের।
আলখেল্লা ছাড়া অন্য পোশাক পরতেন খুব কম।
জন্মদিনে পরতেন কোঁচানো ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি। গায়ে থাকতো বাটিকের উত্তরীয়। পায়ে কটকি চটি বা নাগরা। পৌষ উৎসবে বা উপাসনার সময় পরতের গরতের ধুতি, পাঞ্জাবি।

বিজ্ঞাপন

ঋতু নিয়ে যেমন গান করেছেন। লিখেছেন কবিতাও। তেমনি ঋতু ধরে আলখেল্লার রঙ পাল্টে নিতেন। বর্ষা ছিল অত্যন্ত পছন্দের। বৃষ্টির দিন পরতেন গাঢ়নীল জোব্বা। জোব্বা বা আলখেল্লা সবচেয়ে প্রিয়।
ধাপে ধাপে প্রিয় পোশাকের বদল করেছেন ডিজাইন বা নকশার।
শেষ ডিজাইনটি করেন গগন ঠাকুর। হঠাৎ করেই গগনের মাথায় ভাবনাটা দৌড়ে আসে। কারণও ছিল। বেশ কিছুদিন থেকে বাড়িতে জাপানী শিল্পীরা আসা যাওয়া করছেন। ওরা আসেন ঝোলা পোশাকে। এটাও এক ধরনের জোব্বা।
জাপানি জোব্বা থেকে খানিকটা অংশ নিয়ে এবার গগন জুড়ে দেন রবিকাকার আলখেল্লায়। দর্জি ফতেউল্লাহকে বুঝিয়ে দিলেন নকশা। ফতেউল্লাহ কাপড় একবার কাটছেন। একবার জোড়া দিচ্ছেন। পরক্ষণে খুলছেন। কোন মতেই সেটা গগন ঠাকুরের নকশার মত হচ্ছে না। এভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা চললো কয়েকটা দিন।
শেষমেষ ঠিক হলো নকশা।
আলখেল্লার ঝুল নেমে এসে শেষ হলো পায়ের গোড়ালিতে। হাতা হয়ে গেল প্রায় দ্বিগুন ঢোলা। রাখা হলো না বোতাম। ব্যবহার করা হলো ফিতা। ফিতা দিয়ে গলাবন্ধ বানানো হলো।
এবার মনে ধরেছে গগনের। রবি কাকার জন্য বানানোর পর নিজের জন্যও একই নকশার আলখেল্লা বানিয়ে নিলেন। বাদ থাকলো না গগনের অন্য দুই ভাই অবনীন্দ্রনাথ ও সমরেন্দ্রনাথ।
কয়েকদিন পর গগনের রবি-কাকা এলেন বাড়ি। ভাইপো গগন নতুন নকশায় করা আলখেল্লা নিয়ে গেলেন রবিকার কাছে।
রবি এখন তরুণ নেই। রূপালি চুল উঁকি দিচ্ছে সারা মাথায়। কাঁচা-পাকা দাঁড়ি গোঁফে এখন রূপবান পুরুষ। সাদা থান ধুতি কোঁচা দুলিয়ে পরিপাটি করে পরে আছেন। পায়ে নাগরা জুতো। কিছুদিন আগে স্ত্রী মারা যাবার পর কুঁচিয়ে ধুতি পরতে পারছেন না। ধুতিকে সযত্নে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এরকম সময়ে অভিনব-ডিজাইনের আলখেল্লা উপহার দিলেন ভাইপো গগন।
খুব খুশি হলেন গগনের রবিকাকা। একসময় এই আলখেল্লার নাম হয়ে যায় ঠাকুরবাড়ির জোব্বা ।

সারাবাংলা/পিএম

আলখেল্লা এক যে ছিল রবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেখ সাদী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর