তৃতীয় দিনে এসে প্রাণের মেলায় গোছালো ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:১২
হাসনাত শাহীন, বইমেলা থেকে ।।
আপামর বাঙালির আবেগ-অনুভূতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বাঙালি জাতির গৌরবদীপ্ত বিজয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রতীক ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৭২ সালের ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার (১ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া এবারের এই গ্রন্থমেলা তার তৃতীয় দিন (রোববার) এসে পেল সার্বিকভাবে গোছালো ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। যেদিনে- বিগত দুইদিনের মতো ধূলো-বালির প্রকোপের মতো মেলা প্রাঙ্গণের কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলো না স্টল-প্যাভিলিয়ন নির্মাণের কোনো সামগ্রী। যে কারণে, মেলা প্রাঙ্গণে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পাঠক। হাসি ফুটেছে বিভিন্ন প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত প্রকাশকদের ঠোঁটেও।
সাপ্তাহিক কর্মদিবসের দিন বিকেল তিনটায় মেলার প্রবেশ পথ খুলে দেওয়ার পর থেকেই মেলা প্রাঙ্গণের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপ্রেমী মানুষ মেলায় প্রবেশ করেন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্টল নির্মাণের দ্রব্যাদি, ধূলো-বালি, সঙ্গে দেখা মেলেনি বিগত দুইদিনের মতো বইপ্রেমী, দর্শনার্থীদের। কম ছিল সাধারণ মানুষের আনাগোনাও।
এমন পরিবেশে মেলায় ঘুরতে ঘুরতে ঐতিহ্য প্রকাশনা সংস্থার কাছে দেখা মেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে মেলায় আসা সালাউদ্দিন আহমেদের সাথে। তার কাছে মেলার পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, প্রতিবছরই বই মেলায় আসি, আসতে হয়। এবারের মেলায় আজই প্রথম আসলাম। মেলার সার্বিক পরিবেশ দেখে খুব ভালো লাগছে। মেলায় স্টলগুলো যেমন নান্দনিকভাবে সেজেছে, তেমনই মেলায় স্টল বিন্যাসও ভালো হয়েছে। স্টল থেকে স্টলের মাঝে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা থাকায় নির্বিঘ্নে চলাফেরা করা যাচ্ছে। এ জন্য বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবারের মেলার পরিবেশ অনেক শান্ত ও স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে।
দেশের শিল্পী ও স্থপতিদের সুনিদৃষ্ট দিকনির্দেশনায় স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন নকশায় সুবিন্যাস্ত, গোছালো এবং পরিপাটি মেলার পরিবেশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসতেই জ্বলে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণের সব বাতি। কিন্তু বইমেলার মূল আলোকবাতি সেই বইপ্রেমীর তেমন দেখা মেলেনি। এ বিষয়ে কথা হলো প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজলের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলা’কে বললেন, দুইদিন ছুটির পর বইপ্রেমীদের আনাগোনা কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক, তবে এতোটা কম থাকবে এটা ভাবিনি। তিনি আরো জানান, বইপ্রেমীদের আনাগোনা কম থাকলেও বিক্রি তুলনামূলকভাবে ভালোই। এই সপ্তাহ শেষে মেলা পুরোপুরি জমে উঠবে বলেও মনে করেন ঐতিহ্যের এই ব্যবস্থাপক।
তিনি আরো বলেন, এই সময়টাতে মেলায় পাঠকরা সাধারণত ক্যাটালগ সংগ্রহ করে থাকেন। অনেকে আছেন প্রিয় লেখকের পছন্দের বইয়ের জন্য অপেক্ষা করেন, অনেকে আবার একটু সময় নিয়ে প্রথম সপ্তাহ পার করেই মেলায় আসে। নানাবিধ কারণে ভিড় কম থাকাটাই স্বাভাবিক। তিনি আরও বলেন, একদিকে কর্মমুখর দিন অন্যদিকে বাণিজ্যমেলা এখনও শেষ হয়নি সব মিলিয়ে মেলায় একটু ভাটার টান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, শীতের পরে বসন্ত যেমন করে প্রকৃতিকে সাজায়, কয়দিন পরে মেলাও সেজে উঠবে বইপ্রেমীদের অনেক বেশি আনাগোনায় এমন আশাবাদও ব্যক্ত করেন তিনি।
এ বিষয়ে মেলার অন্যান্য বেশকিছু প্রকাশনা সংস্থার কর্মকতাদের সঙ্গে কথা বললে-তারা ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজলের মতো একই অভিমত ব্যক্ত করেন। এবং তারা জানান, প্রতিবছর মেলার শুরুর পর পরই তেমন জমে ওঠে না। বইও বিক্রি তেমন হয় না। এই সময়ে যেসব বইপ্রেমী মেলায় আসেন তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার বইয়ের ক্যাটালগ সংগ্রহ করেন। এসব ক্যাটালগ দেখে মেলার মাঝামাঝি সময়ে বই কিনতে আসেন। এবারও সেই রকমটাই হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
এদিকে, মেলার তৃতীয় দিনে এসে উদ্বোধন হলো বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির প্যাভিলিয়ন। রোবরার (৩ ফেব্রুয়ারি) তৃতীয় দিনের বিকেলে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি’র এই প্যাভিলিয়নের উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ, সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক মনিরুল হকসহ সমিতির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশ প্রকাশ করেছে কবি, সাংবাদিক ও গীতিকার হক ফারুক আহমেদের কাব্যগ্রন্থ ‘নিসঙ্গতার পাখিরা’। শনিবার (২ ফেব্রুয়ারি) মেলার দ্বিতীয় দিন প্রকাশিত হওয়ার পর বইটি নিয়ে কবিতাপ্রেমীদের ভিড় জমেছে অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নের সামনে। বইটির বাজার কাটতিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে অন্যপ্রকাশের ফিন্যান্স ম্যানেজার সানাউল কবির চৌধুরী কিরন বলেন, হক ফারুক আহমেদের বইটি পাঠকদের দ্বারা এতো বেশি সমাদৃত হবে এটা আমরা আশা করিনি। বইটির সফলতার বিষয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম, তবে প্রত্যাশার চেয়ে আমাদের প্রাপ্তিটা বেশি ঘটেছে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। ৪৬টি কবিতা দিয়ে সাজানো ৫৬ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা।
মেলার নতুন বই: বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যমতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিনে নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ১৩৮টি। এর মধ্যে গল্প ২০, উপন্যাস ২০, প্রবন্ধ ১৫, কবিতা ২০, গবেষণা ৪, ছড়া ৮, শিশুসাহিত্য ১০, জীবনী ৬, মুক্তিযুদ্ধ ৬, বিজ্ঞান ২, ভ্রমণ ৩, ইতিহাস ৫ রাজনীতি ৩, চিকিৎসা স্বাস্থ্য ৩, রম্য/ধাঁধাঁ ১, অনুবাদ ২, সায়েন্সফিকশন ২ ও অন্যান্য ৮টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো শোভাপ্রকাশ প্রকাশিত তারেক শামসুর রেহমানের ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি’ ও ‘দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি’, আবুল আহসান চৌধুরীর ‘বিচারপতি রাধাবিনোদন পাল এক বাঙালির জাপান জয়’, পুঁথিনিলয় এনেছে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘বাঙালি জীবনের গল্প’, পূরবী বসুর ‘আলোকিত সহোদরা এবং প্রকাশনা সংস্থা চন্দ্রবিন্দু প্রকাশ করেছে কবি মাজহার সরকারের কাব্যগ্রন্থ ‘চিৎকার রণিত হৃৎপিণ্ড’ ইত্যাদি।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিন বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সুবর্ণজয়ন্তী’ শীর্ষক আলোচনা। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের আলোচনায় অংশ নেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান।
এর পর একই মঞ্চে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি রবিউল হুসাইন এবং আলতাফ হোসেন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও ঝর্ণা সরকার। সংগীত পরিবেশন করেন ফাহিম হোসেন চৌধুরী, সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, আবদুর রশিদ এবং নূসরাত বিনতে নূর।
সারাবাংলা/এইচএস/পিএ