ই-বুকের যুগেও কমেনি ছাপা বইয়ের আবেদন
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪৬
।। স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: মাত্র দ্বিতীয় সপ্তাহে পা রেখেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯। এরই মধ্যে লেখক-প্রকাশক আর পাঠকদের মিলনের উচ্ছ্বাস ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যে ঢেউয়ে তুমুল গতিতে নৌকা বেয়ে চলেছে তারুণ্য। পিছিয়ে নেই শিশু-কিশোররাও।
সব ছাপিয়ে যে কথাটি জানান দিচ্ছে- ডিজিটালাইজেশনের এই যুগেও বইয়ের আবেদন কমেনি এক রতিও- বরং বেড়েছে। লেখক-প্রকাশকদের মতও তাই। তারা বলছেন, সারা বিশ্বে এখন দ্রুত পরিবর্তনশীল। হয়ে উঠছে প্রযুক্তি নির্ভর। আমাদের দেশেও এখন হাতে হাতে স্মার্টফোন, আর পাঠকদের হাতে উঠেছে ই-বুক। সহজে মিলছে ইন্টারনেট সেবাও। কিন্তু ছাপা বইয়ের কাটতি কমেনি। অনলাইন সুবিধা নিয়ে অনেকেই কেনেন ছাপা বই। পাঠক বইমেলায় আসছেন, বই কিনছেন। এই আবেদন চিরকাল ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার শুরুর দিন থেকে আজ শনিবার, মেলার নবম দিন তারই সাক্ষী দিচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী, শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বেলা ১১টায় মেলার প্রবেশ দ্বার খুলে দেওয়া হয়। শুক্রবারের মতো ততটা ভিড় দেখা যায়নি। তবে মেলা প্রাঙ্গণে ছিল বইপ্রেমী-বইয়ের ক্রেতাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি।
এদিন ছিল এবারের মেলার তৃতীয় শিশুপ্রহর। শিশুপ্রহরের সময়সীমা সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। শিশুদের কলকাকলিতে মুখর ছিল মেলা প্রাঙ্গণের সকাল। দিনের মধ্যভাগে বিরতির পরে বিকেল ৩টা থেকে রাত অব্দি সব বয়সী পাঠকরা এসেছেন, কিনেছেন নতুন নতুন বই।
শিশু চত্বরে ছিল সিসিমপুর মঞ্চে হালুম, টুকটুকি, ইকরি আর সিকু। তাদের সঙ্গে নেচে গেয়ে শিক্ষামূলক নানা তথ্য জানতে পারে-শিশুরা।
তবে শিশু প্রহরে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বরেণ্য মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপস্থিতি। এবারের মেলায় দ্বিতীয়বারের মতো আসেন তিনি। প্রায় পুরোটা সময় শিশুদের অটোগ্রাফ দিয়ে, তাদের সঙ্গে ছবি তুলে- আবদার মেটাতে দেখা যায়। এরই ফাঁকে তিনি বলেন, শিশুরা এখন কম্পিউটার, মোবাইলের স্ক্রিনে আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য মূল ভূমিকা রাখতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের। শ্রেণিকক্ষের বাইরে খেলাধূলা করার সুযোগ করে দিতে হবে শিশুদের। সে সঙ্গে বই পড়ার সুযোগও করে দিতে হবে।
শিশু প্রহরে আরও এসেছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। তিনি বাংলা ভাষায় অনুদিত পরমাণু শক্তি বিষয়ক তিনটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
শিশু প্রহর শেষে মেলার মধ্য বিরতির সময়ে মেলাপ্রাঙ্গণ কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে। তবে বিকেল ৪টার পর থেকে মেলায় আসতে শুরু করেন পাঠকরা। সন্ধ্যা নাগাদ জমে ওঠে প্রাণের মেলা। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত আব্দুল মান্নান শিকদারের কাব্যগ্রন্থ ‘সুন্দর খেলা করে’র মোড়ক উন্মোচন করতে এসেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর।
অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে দাঁড়িয়ে বিভিন্নজনের বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন তিনি। কথা হয় তার বই প্রকাশ প্রসঙ্গে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনের সঙ্গে সময় কাটানোর। অনেক কিছু জানা ও শেখার ছিল- সে সময়।
গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, রাজনীতিতে যোগদান, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং মন্ত্রী হওয়া- এসব স্মৃতিময় ঘটনাগুলোকে তিনি বইয়ের পাতা তুলে আনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
‘লেখক বলছি…’ মঞ্চের আয়োজন: শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘লেখক বলছি…’ মঞ্চে নিজেদের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে আলাপনের অংশে ছিলেন কবি মাহবুব সাদিক (নির্বাচিত কবিতা), কবি-কথাসাহিত্যিক মাহবুব আজিজ (এইসব কলহাস্য), কবি মারুফ রায়হান (হাওয়ানগরের পারুল ফুল), কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমান (নদীধারা আবাসিক) এবং কবি ও প্রাবন্ধিক কুমার চক্রবর্তী (কবিতা সংগ্রহ)।
মেলার নতুন বই: বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার মেলায় এসেছে ২১৮টি নতুন বই। এর মধ্যে গল্প গ্রন্থ ৪৪টি, উপন্যাস ৩২টি, প্রবন্ধ ১২টি, কবিতা ৬৪টি, গবেষণা গ্রন্থ ৫টি, ছড়া বিষয়ক বই ৪টি, শিশুসাহিত্য ৮টি, জীবনী গ্রন্থ ৯টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ৫টি, নাটক ৪টি, বিজ্ঞান বিষয়ক বই ৩টি, ভ্রমণ বিষয়ক বই ২টি, ইতিহাস বিষয়ক বই ৩টি, রাজনীতি বিষয়ক বই ১টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক বই ৩টি, রম্য ও ধাঁধা বিষয়ক বই ২টি, ধর্মীয় বই ১টি, অনুবাদ বই ১টি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ১টি এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর এসেছে ১৪টি নতুন বই।
এর মধ্যে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত, ফরিদুর রেজা সাগরের ‘এবারো হাফ ডজন ছোটকাকু’ ও গোলাম কুদ্দুছের ‘ভাষা আন্দোলন সহজ পাঠ’, শোভাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত, তারেক শামসুর রেহমানের ‘দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি’, মাওলা ব্রাদার্স থেকে এসেছে, মশিউল আলমের ‘বাংলা দেশ ও অন্যান্য গল্প’, অন্বেষা থেকে প্রকাশিত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য’, জয়তী প্রকাশন প্রকাশ করেছে, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংসপ্তক’ অবলম্বনে নাজমা জেসমিন চৌধুরীর বই ‘কিশোর সংশপ্তক’ এবং ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘কানার হাটবাজার ও অন্যান্য’।
মেলার মূলমঞ্চের আয়োজন: শনিবার বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আবদুল হক: জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সৈয়দ আজিজুল হক। আলোচনায় অংশ নেন সমকালের উপ-সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত, কবি-সাংবাদিক সোহরাব হাসান এবং প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুব্রত বড়ুয়া।
আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি আতাহার খান এবং ফরিদ কবির। আবৃত্তি করেন বেলায়েত হোসেন এবং অনন্যা লাবণী পুতুল। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পর্বে ছিল গোলাম কুদ্দুছের পরিচালনায় বহ্নিশিখা এবং খাজা সালাহ উদ্দিনের পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন ঘুংঘুর সাংস্কৃতিক একাডেমির পরিবেশনা।
রোববারের মেলা: রোববার গ্রন্থমেলার দশম দিনে মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কথাশিল্পী অমিয়ভূষণ মজুমদার: জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মহবিুল আজিজ। আলোচনায় অংশ নেবেন হোসেনউদ্দীন হোসেন, মাহবুব সদিক এবং হরিশংকর জলদাস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সেলিনা হোসেন। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সারাবাংলা/এইচএস/এটি