প্রসঙ্গ: পলাশ আনন্দপাঠ ও বইমেলায় নতুন ৭ বই
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২৩:২০
।। মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক ।।
ঢাকা: পলাশ মাহবুবকে নিয়মিত পাঠ করলে আনন্দে থাকা যায়। বছরজুড়ে আপনি পলাশ মাহবুবের লেখা পড়তে পারবেন। সোস্যাল মিডিয়ার যুগে আপনার পক্ষে যদি ফেসবুক এড়ানো অসম্ভব কিছু হয়, তাহলে পলাশ মাহবুবকে এড়ানোও অসম্ভব! অন্তত আপনি যদি তার বন্ধু তালিকায় থাকেন কিংবা হয়ে থাকেন তার ভক্ত-অনুসারী।
এতে আপনার সকালগুলো হয়ে উঠতে পারে সুন্দর। তাছাড়া আপনার যদি মন খারাপ থাকে কোনো কারণে, চলে যান না পলাশ মাহবুবের ফেসবুক পাতায়। একটার পর একটা পোস্ট পড়ে নিন। আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। একটা উদাহরণ দেই—
নানা ধরনের নাম চেয়ে অনেকেই ফোন দেন। এক ছোট ভাই তার সদ্যসমাপ্ত উপন্যাসের জন্য নাম চেয়ে ফোন দিলো।
– ভাই, একটা উপন্যাস লিখছি। নাম দেন।
– উপন্যাস লিখছো তুমি আর নাম দেবো আমি! তা কী উপন্যাস লিখছ?
– প্রেমের। টানটান প্রেমের উপন্যাস।
– টানটান হইলে নাম দাও ‘রোমান্টিক ইলাস্টিক’।
– নাম শুনে ছোট ভাইকে সন্তুষ্ট মনে হলো না। সে মাথা নাড়ে।
– ধুর, না ভাই। আরেকটা নাম দেন। উপন্যাসের প্লটে কঠিন প্রেম। প্রেমের কাবাবে মনে করেন হাড্ডি ঢুইকা যায়। সেই হাড্ডি নিয়া মনে করেন টানটান ব্যাপার-স্যাপার।
হুম। আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকি।
– তাইলে এক কাজ করো। তোমার উপন্যাসের নাম দাও- প্রেমের কাবাব ও কতিপয় হাড্ডি।
হাসছেন তো! হাসবেনই। পলাশ মাহবুবের ফেসবুকের দেয়াল জুড়ে এমন সব হাসির খোড়াক, মন ভালো করে দেওয়ার কথাবার্তা থাকে অফুরান। তার কোনোটি মন্তব্য, কোনোটি বাক্যাংশ। আবার কোনোটি কাব্যাংশ। যার নাম তিনি দিয়েছে অণুকাব্য। যেমন-
কেউ বাঁচে খেটে… কেউ কেউ চেটে।
অদ্ভুত পৃথিবী… জীবনের সেটে।
কিছু আছে প্রেমাণুকাব্য। যেমন—
চান্স হয়নি বিসিএস-এ,
বান্ধবি তাই পিছিয়েছে।
কেবল যে অণুকাব্য… তা নয়, ছোট ছোট কিছু কথা তার ভীষণ অর্থবহ, চিন্তার খোড়াক ধরা দেয়। কোনোটি থাকে কৌতুকে ভরা। কিন্তু শুধুই কি কৌতুক? তাতে থাকে বড় ধরনের খোঁচা। সমাজের মানুষকে তার অজ্ঞতা, অসামাঞ্জস্যতা বুঝিয়ে দেয়।
পলাশ মাহবুব লিখছেন—
– ‘শীত একটি ধনী ঋতু। উহা গরিবকে কষ্ট দেয়।’
– ‘স্বপ্ন এবং ডালপুরির মাঝে মিল আছে। দু’টোর মধ্যেই প্রচুর বাতাস।’
– ‘যে বাজারে দুধ আর ঘি-এর একদর, সে বাজার ঘি শূন্য হবেই।’
– ‘ভোট উৎসব’ হচ্ছে একমাত্র উৎসব যেখানে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়।’
– ‘আমার অবস্থা হইছে বাংলাদেশের নদীর মতো। যার সাথেই দেখা হয়, বলে, শুকাইয়া যাইতেছ।’
এটি কৌতুকময়। কিন্তু গুঢ়ার্থ হিসেবে নদীর শুকিয়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আবার ‘একটিমাত্র সূত্রের কোনো আবিষ্কারক নেই— বিশ্বস্ত সূত্র।’ এমন বাক্যে এই সময়ের সাংবাদিকতা চর্চার ভীষণ এক দুর্বলতার দিক ধরা পড়ে।
পলাশ কেবলই লেখক কিংবা সাহিত্যিক নন, পেশায় সাংবাদিক। আর পেশাকে তিনি যারপরনাই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দেখেন ও চর্চা করেন।
সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এবারের প্রসঙ্গ পলাশ পাঠ ও তার বইমেলায় নতুন সাতটি বই।
প্রতিবছর বইমেলায় পলাশ মাহবুবের কী কী বই আসছে, তার ইঙ্গিত আগের গোটা বছরজুড়েই পাওয়া যেতে থাকে। ফলে দিনে দিনে, তিলে তিলে তৈরি হতে থাকে পলাশের নতুন পাঠক। বছরজুড়ে পলাশ নিয়ম করে লেখেন— প্রতি রাতে দুই ঘণ্টা করে। এ নাকি তার এক কঠিন রুটিন। ফলে বছর শেষে তার পাঁচ-সাতটা বই দাঁড়িয়ে যায় অনায়াসে। আর গোটা বছর ধরেই চলে তার প্রকল্পগুলো। সব্যসাচী লেখক হয়তো তাকে এখনই বলা যাবে না; কিন্তু গল্প, উপন্যাস, ছড়া- ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য— এমন নানা ঘরানায়, নানা ধরনের লেখা লিখতে থাকেন পলাশ মাহবুব। আর কী লিখছেন, তা নিয়ে খুব একটা লুকোছাপা নেই। যখন যা লেখেন তার অনেকটাই আবার তুলে দেন ফেসবুকের দেয়ালে।
ফলে বছরজুড়ে পলাশ পাঠ আপনাকে ফেব্রুয়ারিতে পলাশ মাহবুবের কোন কোন বইটি কিনবেন, তার একটি তালিকা তৈরি করে নিতে সাহায্য করে।
এবারের বইমেলায় পলাশের বই এসেছে সাতটি। লজিক লাবু সিরিজ চলছে তার কয়েক বছর হলো। এবার সেই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে জানা যাচ্ছিল আসছে সিরিজের নতুন বই। নাম যার ‘বাবুদের বাজিমাত’। গ্রামে স্কুলের একদল ডানপিটে কিশোর আর নানা বৈশিষ্ট্যের শিক্ষকদের নিয়ে কাহিনী এগুচ্ছে। তাতে বাবু অবশ্য নতুন চরিত্র হয়ে এসেছে শহর থেকে।
নভেম্বরেই পলাশ জানিয়েছিলেন, আসছে ‘পরীর কাছে জরির চিঠি’ নামে ছোটদের গল্পের বই। সে বইটিও ছুঁয়ে যাবে কিশোর-কিশোরীদের। নিজেদের তারা খুঁজে পাবে নানা গল্পে। একই ধরনের আরেকটি গল্প সংকলন তালি। তাতেও রয়েছে সামাজিক সংকটের নানা দিক।
জুন ২০১৮তে পলাশ লিখেছিলেন ডিসকভারি নামে একটি ছড়া-কবিতা। ফেসবুকের কল্যাণেই সেটা জানা যায়। বনের পশুপাখিদের উদ্বেগ তাদের নিয়ে ব্যবসা করছে ডিসকভারি চ্যানেল, তারা এখন রয়্যালিটি চায়। সেই ছড়া স্থান পেয়েছে ‘বৃষ্টিরা তিন বোন’ ছড়াগ্রন্থে। বইটির নাম ভূমিকার ছড়াটিও লিখেছেন গেল জুনে। সেটিও এসেছে এবারের বইমেলায়। এছাড়াও এসেছে তার ‘টমোজ’ নামে হাসি-রসাত্মক কাহিনী উপন্যাস। ‘তালি’ নামে সামাজিক সংকট বিষয়ক উপন্যাস। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিশোর উপন্যাস ‘লালুর লাল জামা’। পলাশ মাহবুব নিজেই বলছেন, গতানুগতিক ধাঁচের বাইরে গিয়ে তিনি শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে লিখেছেন এই বইটি।
পলাশ মাহবুব মূলত ছোটদের জন্য, মানে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখেন। এবারের বইমেলায় তার একটি বড়দের উপন্যাসও এসেছে। নাম ‘কম বয়সি সন্ধ্যা’। নামেই বড় বড় গন্ধ আছে। এভাবে লিখতে লিখতে তার পেরিয়ে গেছে ২০টি বছর। কুড়িতে বুড়ি যদি হয়, বুড়োও হবে তবে। সে হিসেবে পলাশ মাহবুব এখন পরিণত লেখক, উত্তীর্ণ লেখকও বটে।
সময়কে জানতে ও বুঝে নিতে পলাশ মাহবুব পাঠ হতে পারে যেকোনো পাঠকের জন্য একটি দারুণ কিছু। হোক সে ছেলে, বুড়ো কিংবা যেকোনো বয়সি নারী।
এ বছরের সাতটি নিয়ে পলাশ মাহবুবের মোট ৫১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। দুই দশকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। আর এর মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার জনপ্রিয়তাও তৈরি হয়েছে। শিশু-কিশোররা পলাশ মাহবুবের বই খুঁজে খুঁজে কিনে নেয়। তবে পলাশ মাহবুব মনে করেন, তার অন্যতম ‘লাকি’ বুক হচ্ছে ‘মা করেছে বারণ’, যেটা অগ্রণী ব্যাংক-বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে, এসিআই আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের নির্বাচিত বইয়ের তালিকায় জায়গা পেয়েছে। এমনকি জাতীয় গ্রন্থাগার অধিদফতরের নির্বাচিত বইয়ের তালিকাতেও ছিল বইটি।
পলাশ বলেন, ছড়ার বই সাধারণত খুব একটা চলে না। কিন্তু এই বইটির চতুর্থ মুদ্রণ বাজারে এসেছে। ভাবলে ভালো লাগে, বইটি আমি আমার মা’কে উৎসর্গ করেছি, বলেন তিনি। এছাড়াও পলাশ মাহবুবের লেখা ‘তালা’ নামে ছোটদের গল্পের বই ইউনিসেফের মীনা অ্যাওয়ার্ডের প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত। সার্বিকভাবে লেখালেখির জন্য পশ্চিমবঙ্গের অন্নদাশংকর রায় শিশুসাহিত্য পুরস্কারও রয়েছে পলাশ মাহবুবের ঝুলিতে।
সারাবাংলা/এমএম/এটি