বিশ্বজিৎ দাস-এর রম্যগল্প ‘নীল পর্ব’
২১ জানুয়ারি ২০১৮ ১৮:৪৯
এক.
‘হুমম!’ গম্ভীর গলায় বললেন শ্রীমান মোখলেস ভাই।
‘আমিও দেব না পরীক্ষা।’ সজোরে বলল ওয়াসিম।
‘তুই কেন দিবি না। তোর কী অসুবিধা?’ টেবিল চাপড়ে জানতে চাইল সুদেব।
‘নাসিম যদি না দিতে পারে আমিও পরীক্ষা দেব না।’ ওয়াসিম আবার বলল।
‘হুমম!’ যেন গর্জন করলেন মোখলেস ভাই।
‘নাসিমকে আমরাই তো দেখে রাখতে পারব। তুই গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আয়।’ কাওসার বলল।
‘না। দেব না। একটাই তো জীবন। সেটা না হয় বন্ধুর জন্যই স্যাক্রিফাইস করলাম।’ আবার বলল সে।
নিস্তব্ধতা নেমে এল আমাদের মাঝে।
নাসিম আর ওয়াসিম মাসখানেক হল আমাদের মেসে উঠেছে।
একই রুমে থাকে ওরা। ওরা দুজনেই এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছে।একই সাবজেক্ট-রসায়নে। লিখিত পরীক্ষা শেষ। সামনে এখন প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা। এমন সময় গতকাল রাতে নাসিমের প্রিয় বান্ধবী শাহিনা পালিয়ে ওদের বাসার কেয়ারটেকারকে বিয়ে করে ফেলেছে। বিষয়টা এতটাই শকিং- নাসিম সহ্য করতে পারেনি।
কিছু একটা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে রুমে পড়েছিল ও।
আমরা যখন হাসপাতালে নাসিমকে নিয়ে পৌঁছালাম ও তখনো অজ্ঞান। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে।
‘কী খেয়েছে?’ কর্তব্যরত ডাক্তার জানতে চাইলেন।
মোখলেস ভাই মাথা নাড়লেন। তারপর তাকালেন আমার দিকে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে।
আমিও মাথা নাড়লাম। তাকালাম সুদেবের দিকে।
সুদেবও মাথা নাড়ল, তাকাল কাওসারের দিকে। কাওসার থেকে রনি, রনি থেকে সাগর, সাগর থেকে সবশেষে গিয়ে প্রশ্নবোধক চোখ গিয়ে থামল নাসিমের রুমমেট ওয়াসিমের দিকে।
ওয়াসিম তোতলাল, ‘আ… আ… মি কী করে বলব! বোধহয় ভাত, আর মাছের তরকারি খেয়েছে।’
‘আমি জানতে চাইছি, ভিকটিম যে পয়জন খেয়েছে তার নাম কী?’
‘দে…দে…খতে নী…নীল রঙের।’
‘তাতো বুঝলাম। নীল তো অনেক কিছুরই রঙ হয়। খেয়েছেটা কী?’
‘ট…য়…লেট…’
‘টয়লেট খেয়েছে! ছিঃ ছিঃ! কী সব যা তা বলছেন। নীল রঙের টয়লেট হয় না কি?’
‘প…রি…ষ্কার।’
‘টয়লেট আবার পরিষ্কার হয় নাকি?’
‘না। টয়…লেট ক্লি…ক্লি…না…র খেয়েছে।’
‘তাই বলুন। কোন কোম্পানির?’
‘নী…ল রঙের।’
‘কী আশ্চর্য! সব টয়লেট ক্লিনারই নীল রঙের হয়। নামটা মনে নেই?’
জবাবে মাথা চুলকাল ওয়াসিম।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খসরু তুই তো নামটা জানিস। তু…তুই বলে দে না।’
হতাশায় মাথা নাড়লাম। কে কোন টয়লেট ক্লিনার দিয়ে নিজের পেট পরিষ্কার করবে তার আমি কী জানি।
তারপরই মনে পড়ে গেল নামটা -জারপিক।
‘তুই কি জারপিক এর কথা বলছিস?’
খুশিতে মাথা দোলাল ওয়াসিম।
নাসিম তাহলে জারপিক খেয়েছে!
দুই.
‘জারপিকের তুলনা জারপিকই- কী বলিস।’
কয়েকদিন আগের কথা।
বাজারে গিয়েছিলাম আমি আর মোখলেস ভাই। বাজারের লিস্টে টয়লেট ক্লিনারও ছিল। দোকানদারকে বলতেই মোখলেস ভাইয়ের হাতে একটা জারপিক ধরিয়ে দিল সে।
‘জারপিকই সেরা। কী বলিস খসরু?’ মোখলেস ভাই বলেছিলেন।
মাথা ঝাঁকালাম। আসলে এ সম্বন্ধে দু’জনের কেউই ভাল জানি না। বিজ্ঞাপনের জোয়ারে আমরা শুধু একটি টয়লেট ক্লিনারের নামই জানি-তা হলো জারপিক।
‘জানিস, রেশমা আপুর বাসায় এটাই ব্যবহার করে।’ আনন্দে গদগদ হয়ে বললেন ভাই।
একটা টয়লেট ক্লিনার দেখে খুশি হওয়ার কী আছে বুঝলাম না।
আমাদের মেসের সবার টয়লেটই বেশ অপরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মাসে অন্তত দুটো ক্লিনার দিয়ে টয়লেটগুলো পরিষ্কার করিয়ে নেব বা নিজেরাই করব।
দোকানদার মোখলেস ভাইয়ের কথা শুনে হেসেছিল।
বলেছিল, ‘ভাই, এইটাই এক নম্বর জিনিস। আপনি নিশ্চিন্তে নিয়ে যান। ভাল না হলে ফেরত নিয়ে আসবেন।’
মহাসমারোহে দু’দুটো জারপিক কিনে মেসে ফিরে এসেছিলাম আমরা। লুঙ্গির উপর গামছা বেঁধে নিয়েছিলেন মোখলেস ভাই।
‘খসরু, চল কাজে লেগে পড়ি।’
‘কাজ। এখন আবার কোন কাজ?’
‘টয়লেটগুলি পরিষ্কার করে ফেলি।’
‘টয়লেট পরিষ্কার করবেন আপনি!’
‘অসুবিধা কী। নিজেদের কাজ নিজেরই করা উচিত।’
এরপর আর কিছু বলার ছিল না।
ইমন ঢুকেছিল একটা বাথরুমে। আমি মোখলেস ভাইকে সাহায্যের জন্য তিনি যে টয়লেটে ঢুকেছেন, সেটার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম।
মোখলেস ভাই ভেতরে টয়লেট পরিষ্কার করছেন কিনা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু বেসুরো গলায় তার গান শুনতে পাচ্ছি। তিনি গাইছিলেন-‘ চল না ঘুরে আসি অজানাতে …’
ভ্রমণের গান টয়লেটে কেন চিন্তা করতে করতেই ইমন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
‘এসব কী কিনে এনেছিস তোরা?’
‘মানে।’
‘এটা তো আসল জারপিক না। নকল জারপিক।’
দরজা খুলে বাইরে তাকিয়েছিলেন মোখলেস ভাই।
‘কী হয়েছে ইমন?’
‘এটা নকল জারপিক ভাই। আটা, নীল আর সামান্য জারপিক মিশিয়ে বানানো।’
‘তুই কী করে জানলি?’
‘কেন? মলিদের বাসার নিচেই তো এর কারখানা।’
‘মলি?’
‘সরি, দাঁত দিয়ে জিব কেটেছিল ইমন, আমার বন্ধু মালেকের কথা বলছিলাম। আদর করে ওকে আমি মলি বলে ডাকি।’
‘তুই বলছিস এই জারপিক নকল?’
‘অবশ্যই বলব। হাজারবার বলব। এটা অবশ্যই নকল।’
ঘণ্টাখানেক পর। রুমে পায়চারি করেছিলেন মোখলেস ভাই।
‘আমাকে নকল জিনিস ধরিয়ে দিল। দোকানদারকে আমি ছাড়ব না।’
‘দোকানদারকে কী বলবেন? বলবেন, কেন নকল জিনিস দিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। তাই বলব।’
দুম করে হাতে কিল বসিয়ে দিলেন ভাই।
‘আপনার প্রমাণ কই। সব জারপিকই তো খরচ করে ফেলেছেন। এখন কি খালি কনটেইনার নিয়ে গিয়ে ভেজালের অভিযোগ তুলবেন?’ বললাম আমি।
থমকে গেলেন মোখলেস ভাই।
‘তাই তো।’
ঘণ্টাখানেক পর মোখলেস ভাই আর আমি দু’দুটো জারপিকের কনটেইনার নিয়ে মেস থেকে বের হয়েছিলাম। তারপর মুখোমুখি হয়েছিলাম বাড়িওয়ালা চাচার।
‘কোথায় যাচ্ছ বাবা মোখলেস?’
‘বাজারে যাচ্ছি চাচা। দোকানদার ভুল করে দুটো জারপিক বেশি দিয়ে ফেলেছে। এখন সেটাই ফেরত দিয়ে আসতে যাচ্ছি।’
‘জারপিক! আরে তোমার চাচী তো সেদিনই বলল, বাসায় জারপিক নেই। লাগবে। দাও।ও দুটো আমাকে দাও।’
আমার হাতে ধরা জারপিকের বোতল। দেব কিনা বুঝতে পারছিলাম না। অসহায়ের মত তাকালাম মোখলেস ভাইয়ের দিকে।
‘কিন্তু এর দাম?’
‘দাম নিয়ে ভাবছ কেন? দিয়ে দেব আমি। দাও।’
যেন দেয়ার ইচ্ছে নেই অথচ দিতে হচ্ছে এমন ভাব নিয়ে মোখলেস ভাই জারপিক দুটো চাচার হাতে দিয়েছিলেন।
‘চাচা। একটা কথা।’
‘বল।’
‘দোকানদারকে একটু আগে ফোন করে আমরা বলেছি যে জারপিক দুটো নিয়ে আমরা আসছি। এখন যদি না যাই, তাহলে লোকটা আমাদের কী ভাববে বলুন।’
‘ঠিকই তো। আচ্ছা, আমি ও দুটোর দাম দিয়ে দিচ্ছি।’
‘না। চাচা থাক। আমি না হয় মেসের কারো কাছ থেকে ধার নিয়ে টাকাটা দিয়ে আসব। মুশকিল হচ্ছে- মাসের শেষ।কারো কাছে ধার পাবো কী না বুঝতে পারছি না।’
‘আরে ধার করবে কেন? আমি দাম দিয়ে দিচ্ছি।’ এই বলে চাচা আমাদের হাতে চারশ টাকা ধরিয়ে দিলেন।
‘ঠিক আছে চাচা।আপনি জোর করলেন বলেই নিলাম। এই টাকা আসলে ধার হিসেবেই নিলাম। যখন চাকরি পাব, তখন আপনাকে অবশ্যই এই টাকা ফেরত দেব।’
মোখলেস ভাই খুশি হয়ে বললেন।
সেটা নগদ টাকা হাতে পাওয়ায়, না কি আমাদের বানানো নকল জারপিক বিক্রি করার আনন্দে- বুঝতে পারিনি সেদিন।
তিন.
কী করব বুঝতে পারছি না।
হাসপাতালের ক্যান্টিনে গম্ভীর মুখে বসে আছি আমরা সবাই-সুদেব, ইমন, রনি, সাদেক, কাওসার, জাকির, সাগর, আমি, ওয়াসিম আর মোখলেস ভাই।
‘তাহলে তুই পরীক্ষা দিবি না?’ ইমন জানতে চাইল।
ওয়াসিম বলল, ‘না।নাসিম দিতে পারবে না। আমিও দেব না। সামনের বছর দুজন মিলে একসাথে দেব।’
‘পরীক্ষা না দিলে কী হবে একবারও ভেবে দেখেছিস?’ সাদেক বলল।
‘কী আর হবে! এক বছর পিছিয়ে যাব। কিন্তু বন্ধুকে পেছনে ফেলে আমি এক পাও এগিয়ে যাব না।’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল ওয়াসিম।
সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোখলেস ভাই।
‘ওকে বিদায় দে। গিয়ে নাসিমের সেবা করুক। পরে ওদেরকে একই বাড়িতে দু’বোনের সাথে বিয়ে দেব। তখন দেখব ভায়রা ভাইয়ের জন্য কেমন টান থাকে।’ মোখলেস ভাই নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন।
ওয়াসিম চলে যাওয়ার পর সুদেব আর কাওসারের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন।
‘তোরা ওদের বদলে পরীক্ষা দিতে যাবি। জীবন কোন ছেলেখেলা নয়। ওদের শিক্ষাজীবন বাঁচাতে হবে।’
‘ভাই, আমি কেমন করে দেব। আমি তো দর্শনের ছাত্র।’ সুদেব আর্তনাদ করে উঠল।
‘আমি ও তো ভাই কমার্সের ছাত্র।’ মিনমিন করে বলল কাওসার।
‘ইমন?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন ভাই।
‘ভাই, কয়েকদিন আগেই প্রক্সি ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে জেল খেটে এলাম। ন্যাড়া তো বেলতলায় একবারই যায়, তাই না?’ ইমন বলল।
‘বেল যদি বারবার ফ্রিতে পায়- তবে কেন যাবে না?’ বিড়বিড় করে বললেন মোখলেস ভাই।
দেখা গেল, প্রত্যেকের কিছু না কিছু সমস্যা রয়েছে। কেউ রাজি হল না- ওয়াসিম আর নাসিমের প্রক্সি হয়ে পরীক্ষা দিতে।
ইমন ফস করে বলে বসল, ‘ওদের বদলে আপনি আর খসরু প্রক্সি দিলেই তো পারেন।’
সাথে সাথে নীল হয়ে গেলেন মোখলেস ভাই- যেন প্রচণ্ড শক খেয়েছেন।
চার.
নীল রং এর খামই তো কিনে এনেছিলেন মোখলেস ভাই।
একসাথে অনেকগুলো।
নানান সাইজের।
বড় থেকে ছোটর দিকে সাজিয়ে। প্রায় বিশটার মত খাম।
‘এত খাম দিয়ে কী করবেন ভাই? জিজ্ঞেস করেছিলাম।
‘চিঠি লিখব।’
‘আজকের যুগে কেউ চিঠি লিখে! মেসেঞ্জার বা ইমোতে লিখলেও তো পারেন।’
‘আমি কি প্রেমিকাকে চিঠি লিখব!’
‘তাহলে?’
‘আমি চিঠি লিখব হাফিজকে।’
হাফিজ ভাই আমাদের পাশের মেসেই থাকেন। নিয়মিতই দেখা হয় তার সাথে।
‘উনাকে আবার চিঠি লিখবেন কেন? দেখা তো হয়ই।’
‘সব কথা দেখা হলেই বলা যায় না। আর চল্লিশ টাকার জন্য যদি মুখের উপর বলে বসে টাকাটা দেব না- তখন?’
কয়েকদিন আগে হাফিজ ভাই বান্ধবীকে নিয়ে ফুটপাতের চায়ের দোকানে চা বসেছিলেন। মোখলেস ভাই কেমন করে যেন দেখতে পেয়েছিলেন। আমাকে নিয়ে দ্রুত পৌঁছেছিলেন সেখানে।
‘ভাবি আসসালামু আলাইকুম।। ভাল আছেন?’ হেসে বলেছিলেন ভাই।
তারপর ঝট করে হাফিজের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘কী রে,একা একা চা খাচ্ছিস। আমাদের খাওয়াবি না?’
হাফিজ ভাই বিস্কুট আর চায়ের অর্ডার দিয়েছিলেন। আমরা যখন বিস্কুটে কামড় দিচ্ছি তখন হাফিজ ভাই তার বান্ধবীকে নিয়ে ‘আসি রে’ বলে দ্রুত প্রস্থান করেছিলেন।
পরে চা-ওয়ালা মোখলেস ভাইয়ের কাছ থেকে চা-বিস্কুটের দাম আদায় করেছিল। হাফিজ ভাই না কি সেভাবেই বলে গিয়েছিলেন।
বিল বেশি ছিল না। মাত্র চল্লিশ টাকা।
মোখলেস ভাই সেই টাকার কথা ভুলতে পারেননি।
তাই হাফিজ ভাইকে চিঠি লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন মোখলেস ভাই। ঠিক করেছিলেন, একটা বড় খামের ভেতর ছোট সাইজের একটা খাম থাকবে। সেই ছোট খামের ভেতর আরো ছোট সাইজের খাম থাকবে।
এইভাবে খামের ভেতর খাম থাকবে। সবশেষের খামে লেখা থাকবে, হাফিজ, তুই আমার চল্লিশ টাকা কবে ফেরত দিবি- ইতি মোখলেস।’
পরিকল্পনা মত খামের ভেতরে খাম পুরে ডাকবাক্সে ফেলে এসেছিলেন মোখলেস ভাই। ডাকটিকেট ছাড়াই। চিঠি ডাকবাক্সে ফেলে খিকখিক করে হেসেছিলেন মোখলেস ভাই।
‘ডাকমাশুল হাফিজই দিক, কী বলসি?’
সেদিনই।
মাঝরাতে তিনি ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিলেন আমাকে, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে খসরু।’
‘কী হয়েছে?’
‘খামের ভেতর চিঠি দিতে ভুলে গেছি!’
পাঁচ.
‘কিছু ভুলে যাননি তো?’ জানতে চাইলাম।
মোখলেস ভাই কিছু বললেন না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন হাতে ধরা টেস্টটিউবের দিকে। ভেতরে থাকা তরলের রং লালচে। বিক্রিয়া বলছে- রং হবে নীল।
মোখলেস ভাই নাসিমের এবং আমি ওয়াসিমের হয়ে প্রক্সি পরীক্ষা দিতে এসেছি। তেমন কোন অসুবিধাই হয়নি। আমাদের দিকে কেউ ভ্রু কুঁচকে তাকায়নি। সহপাঠীরা কেউ বলেনি, আরে তোমরা তো ওয়াসিম-নাসিম নও।
ভয় ছিল মোখলেস ভাইয়ের দশাসই শরীর দেখে কেউ না বলে বসে- এটা আবার কে?
সে রকম কিছু ঘটেনি। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, তাই গ্রুপ করে প্রাকটিক্যাল দেয়া হয়েছে।
আমি আর মোখলেস ভাই পেয়েছি একই প্রাকটিক্যাল। বিশ টাকা ঘুষ দেয়ামাত্র পিয়ন লবণের নাম বলে দিয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা নোটপত্র দেখে দেখে খাতা ভরে ফেলেছি। অম্লমূলক আর ক্ষারীয়মূলক। ক্যাটায়ন আর অ্যানায়ন। এখন প্রাকটিক্যালটা হাতে-কলমে করে দেখাতে হবে। বিপত্তি বেঁধেছে সেখানেই।
অভ্যাস নেই। তাই এরইমধ্যে মোখলেস ভাইয়ের হাতে একটা জার আর ছয়টা টেস্টটিউব ভেঙ্গেছে। মুশকিল হচ্ছে- তবু লবণ অনুযায়ী রং মিলছে না। একই পরীক্ষা বেশ কয়েকবার করলেন ভাই। তথ্য অনুযায়ী, নীল দ্রবণ পাওয়া যাবে শেষে।
কিন্তু আসছে লালচে রং।
পিয়ন সবশুনে বলল, ‘এমন হওয়ার কথা না। শেষে নীলই আসবে। যদি না আসে, তাহলে নিশ্চয়ই লবণের নমুনা কারো সাথে বদল হয়ে গেছে।’
‘তাহলে আমরা কী করব?’ জানতে চাইলাম।
‘আমি তার কী জানি? এক্সটারনাল স্যার কাকে কোন লবণ দিয়েছেন তা লিখে রেখেছেন।’
‘তাহলে উপায়?’
‘বলতে পারব না ভাই। আমরাও চাকরি করি। বেশি শিখাতে গেলে চাকরির উপর চাপ আসবে।’
সবাই টেস্টটিউব আর কেমিক্যালের বোতল নিয়ে ছোটাছুটি করছে । আর আমরা নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রক্সি পরীক্ষা দেয়া যে সহজ নয়- সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি ।
পিয়ন এসে বলল, ‘স্যার, আপনাদের পরীক্ষা দেখাতে বলল তাড়াতাড়ি। সবাই দেখিয়ে এনেছে। আপনারাই শুধু বাকি আছেন।’
চমকে উঠলেন মোখলেস ভাই।
‘তাই তো। কী করি এখন?’
উদাস ভঙ্গিতে সামনে তাকালেন তিনি। হঠাৎ কী যেন দেখে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। চট করে একটা খালি টেস্টটিউব হাতে নিলেন তিনি। এগিয়ে গেলেন তাকে রাখা কেমিক্যালের বোতলগুলির দিকে। চট করে নামিয়ে নিলেন একটি বোতল। আমি দেখলাম, বোতলের গায়ে লেখা CuSO4। উজ্জ্বল নীল রং-এর। তারই কিছুটা টেস্টটিউবে ঢেলে নিলেন ভাই।
তারপর আমাকে নিয়ে চটপট হাজির হলেন বহিঃ পরীক্ষকের সামনে।
‘তোমরা পরীক্ষায় কী পেয়েছ? কীভাবে পেয়েছে বল?’ পরীক্ষক জানতে চাইলেন।
মোখলেস ভাই প্রাকটিক্যালটি কয়েকবার করেছেন। সেটাই গড়গড় করে বললেন।
সবশেষে বললেন, ‘শেষে এই নীল রং-এর তরল পেয়েছি।’
হাতের টেস্টটিউব উঁচু করে ধরলেন মোখলেস ভাই।
সময় যেন থমকে গেল।
প্রমাদ গুণলাম।
দৌঁড়ে পালানোর জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলাম।
টানটান উত্তেজিত হয়ে আশা করলাম- এই বুঝি পুলিশ ঢুকবে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে।
টলে উঠলাম। পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলাম।
শেষ পর্যন্ত এই ছিল কপালে! প্রক্সি পরীক্ষার্থী হিসেবে একমাসের জেল!
কল্পনায় দেখলাম- জেলে রাত কাটাচ্ছি দুজনে।
খেয়াল করলাম, মোখলেস ভাইয়ের হাতে ধরা টেস্টটিউবটা কাঁপছে। তবে কি তিনিও আমার মত ভয় পাচ্ছেন।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
পরীক্ষক আমাদের চমকে দিয়ে বললেন, ‘বাহ্! চমৎকার এসেছে তো নীল রং। আমি ভার্সিটি লাইফে এই প্রাকটিক্যালটা করেছিলাম। নীল রং তো আসছিলই না, উল্টো লালচে হয়ে যাচ্ছিল। তোমরা একবারে পেরেছ। তোমাদের অভিনন্দন।