চেনার জন্য চীনে ।। পর্ব- ৪
১৮ মার্চ ২০১৯ ১৬:৫৩
ভ্রমণ সঙ্গীদের মধ্যে দুই ধরণের মানুষ সাধারনত কমন। একদল চারপাশের সবকিছু নিয়ে ভীষণ উৎসাহ দেখায়। আরেক দলের মধ্যে সবকিছু নিয়েই চরম নিরাসক্ত ভাব।
আমাদের মধ্যেও নীরবে দুটি দল হয়ে গেল।
উৎসাহি দলের গ্রেট ওয়ালের সবকিছু নিয়েই ব্যাপক আগ্রহ। তাদের হা হওয়া মুখ বন্ধ হচ্ছে না। বিস্মিত চোখের সাইজ হয়েছে চাইনিজ কমলালেবুর মতো। গ্রেট ওয়ালের পাথর ছুঁয়ে তারা ওয়াও বলে। এমন আলতোভাবে ছোঁয় যেন ধরলে বিদ্যুতের শক খাবে। দেওয়ালের কোণায় এসে নিচে তাকিয়ে তারা সমস্বরে বলে ওঠে, ওহ মাইগড!
তাদের ভাব দেখে মনে হবে নিচে এমন কিছু আছে যা তারা জীবনেও দেখেনি। বাস্তবে নিচে আছে জংলা টাইপের ঝোপ-ঝাড় আর বড় বড় গাছপালা। তা দেখেই তাদের আহ্লাদিপনার শেষ নেই।
মালেয়শিয়া থেকে আসা মিমি চোখ বড় বড় করে গালে হাত দিয়ে বললো- ও মাই মাই! গ্রেটওয়াল মেইড বাই স্টোন! আই থিংক ব্রিংকস। (হায় খোদাতায়ালা, গ্রেট ওয়াল পাথরের তৈরি! আমিতো ভেবেছিলাম ইটের!)
১১ দেশের আঠারো জনকে নিয়ে আমাদের পুরো দল। দলে আমি ছাড়া আরও একজন বাংলদেশি আছেন। ফাহিম ভাই। তিনি নিচু স্বরে দুষ্টু কথা বলতে ওস্তাদ। মালেয়শিয়ান মিমির ইট আর পাথরের অতি উৎসাহ দেখে ফাহিম ভাই মাথা নাড়েন।
হ আপা। পুরাডাই পাথরের তৈরি। চাইলে যাওনের সময় ছোট এক টুকরা পাথর দেশে লইয়া যাইতে পারেন। পাথরডা আংটিতে বসাইয়া পড়তে পারবেন। হে হে হে।
মালয়েশিয়ান মিমির বাংলা বোঝার কথা না। তারওপরে ফাহিম ভাইয়ের লোকাল বাংলা। তবে বাংলা না বুঝলেও ফাহিম ভাইয়ের হাসি দেখে মিমি ঠিকই বুঝলো তাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে। সে তাই বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলো- সো ফানি, সো ফানি।
এবার দ্বিতীয় ধরণের মানুষদের কথা বলা যাক। আমার মতো দ্বিতীয় দলে যারা আছেন তারা সংখ্যায় কম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাদের গ্রেটওয়াল দেখা শেষ হয়ে যায়। তারপর তারা মুখ শুকনো করে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। তাদের কাছে সবকিছুই সাদামাটা লাগে।
আচ্ছা, এই তাইলে গ্রেট ওয়াল! মহাপ্রাচীর। এইটা বলে চান্দের দেশ থেকেও দেখা যায়! হাইস্যকর।
আমাদের সংখ্যালঘু দ্বিতীয় দলে শ্রীলংকা থেকে আসা সুরেন্দ্র আবেপালাও আছেন। সুরেন্দ্র মাঝ বয়সি। সিনিয়র প্রোডিউসার হিসেবে কাজ করেন শ্রীলংকার ন্যাশনাল টেলিভিশনে। সুরেন্দ্রর প্রধান দুই কাজের একটি হচ্ছে কিছুক্ষন পরপর মোবাইল ফোনের ক্যালকুলেটরে ডলারকে চাইনিজ উইয়ানে কনভার্ট করে ডলারের হাল হকিকত দেখা নেয়া। সুযোগ পেলেই এই কাজটা করেন তিনি। আর করেন শ্রীলংকান সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহেন্দ্র রাজা পাকসের আকুন্ঠ প্রশংসা। রাজা পাকসে আবার ক্ষমতায় আসছে, এই এলো বলে… এসব গল্প।
ফাহিম ভাই কানে কানে বললেন, ভাই, এই মাল মনে হইতেছে পলিটিক্যাল নিয়োগ। দ্যাখেন কেমন দলান্ধ।
আমি ফাহিম ভাইকে ইশারায় থামাই। দলান্ধ হোক আর যাই হোক আপাতত সে আমাদের দলে। আমাদের দল ভারি করা প্রয়োজন। কারণ আমাদের পুরো দলের (উৎসাহি আর নিরুৎসাহিত গ্রুপ মিলিয়ে) দলনেতা মিস লি ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, গ্রেটওয়াল ধরে আমরা সামনের দিকে অন্তত এক মাইল এগিয়ে যাব। তারপর আবার হেঁটে হেঁটে নামার স্থানে ফিরে আসবো।
মিস লি’র ঘোষণায় আমাদের নিরাসক্ত দলের মহাপ্রাচীর থেকে পড়ার জোগার। বলে কি এই ভদ্রমহিলা! এই উঁচু-নিচু সিঁড়িওয়ালা দেওয়ালের ওপর দিয়ে এক মাইল হাঁটতে হবে! এক মাইলতো আসলে এক মাইল নয়। ফিরে আসার সময় আরও এক মাইল অর্থাৎ পাক্কা দুই মাইল। বাধ্য হয়ে মিস লি কে ধরলাম।
মিস লি, এক মাইল পরে কি এমন কিছু আছে যা এখানে বসে আমরা দেখতে পাচ্ছি না?
মিস লি মাথা নাড়েন। নো, অল আর সেইম। ইটস এ ওয়াল ইউ নো।
ওকে। দেন হোয়াই উই গো ফর ওয়ান মাইল ওয়াক?
বিকজ ইটস দ্য পার্ট অফ আওয়ার ভিজিট। উই শুড…
মিস লি কথা শেষ করার আগেই দেখা গেলো উৎসাহি দল হৈ হৈ করে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। আমরা আর কি করবো, হারিয়ে যাবার ভয়ে উৎসাহি দলের পিছু নিলাম। আর হাঁটা শুরুর আগে মোবাইলে ডলার ইনটু ইউয়ানে হিসাবে ব্যস্ত সুরেন্দ্রকে বললাম, দয়া করে তোমার হিসাবটা এখন বন্ধ রাখো। এক হিসাব আর কতবার করবে তুমি! দোহাই তোমার নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটো। তা না হলে উস্টা খেয়ে পড়বে।
কথাগুলো সুরেন্দ্রকে ইংরেজিতেই বলেছিলাম। কিন্তু সেই মুহুর্তে উস্টার ইংরেজি মনে না পড়ায় উস্টাকে উস্টাই বললাম। সুরেন্দ্র উস্টার মানে বুঝলো না। বোঝার কথাও না।
ব্রো, হোয়াট ইজ উস্টা?
সুরেন্দ্রর পাল্টা প্রশ্নে আমার উস্টা খাবার জোগার। কিছুতেই তাকে উস্টা ব্যাপারটা বোঝাতে পারছি না। শেষে ফাহিম ভাই এগিয়ে এলেন। তিনি উস্টা খাওয়ার ব্যাপারটা অভিনয় করে দেখালেন। ফাহিম ভাইয়ের অভিনয় নিখুঁত হওয়ায় সুরেন্দ্র উস্টা খাওয়া ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। এবং তার হাসিহাসি মুখ দেখে মনে হল উস্টা খাবার হিসেবে খুব একটা খারাপ না।
গ্রেট ওয়াল ধরে আমরা হাঁটছি। পাশে ফাহিম ভাই। তিনি সঙ্গে থাকা ছোট ব্যাগ থেকে চানাচুরের প্যাকেট বের করলেন। রুচি চানাচুর।
নেন ভাই, খান। ফাহিম ভাই আমার দিকে চানাচুরের প্যাকেট এগিয়ে দেন।
চানাচুর খাবো! গ্যাস হবেতো।
গ্যাস হইলে তো ভালোই। গ্যাস হলে হালকা হবেন। আর হালকা হলে হাঁটতে সুবিধা হবে। হে হে হে।
ফাহিম ভাইয়ের রসিকতায় মজা পাই। প্যাকেট থেকে কিছুটা চানাচুর নিয়ে মুখে দেই।
চানাচুর খেতে খেতে নীরবে হাঁটছি। এরমধ্যে এক লোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেকটা পথ আটকে দাঁড়ানোর মতো।
আন্নেরা বাংলাদেশ তন আইছেন, ক্যান?
আমরা লোকটার দিকে তাকাই। তারপর ফাহিম ভাই আর আমি তাকাই পরস্পরের দিকে। তাকানোর অর্থ, আমরা যে বাংলাদেশ থেকে এসেছি এই লোক বুঝলো কিভাবে? আমরাতো কোনও কথা বলছিলাম না।
নোয়াখালীর লোকজন বুদ্ধিমান হয়। এই লোক তার প্রমাণ দিলেন। তিনি আমাদের মনের প্রশ্ন বুঝতে পারলেন।
আন্নেরা বাংলাদেশ তন আইছেন হেইডা ক্যান্নে বুঝছি, ক্যান?
আমরা মাথা নাড়াই।
নোয়াখালির ভদ্রলোক রুচি চানাচুরের প্যাকেট দেখিয়ে বললেন, এই মাল বাংলাদেশ ছাড়া কইত্তোন আইবো। দেশীয় পণ্য, দেখি হই ধন্য। হে হে হে।
নোয়াখালীর ভদ্রলোকও দেখা যাচ্ছে বিরাট রসিক। তিনি তার ছোটবেলার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে চীনে ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু গ্রেট ওয়ালে ওঠার পর সঙ্গী-সাথীদের হারিয়ে ফেলেছেন। তার সাথে মোবাইল ফোন নেই। সঙ্গীদের সাথে যোগাযোগেরও উপায় নেই। কিন্তু সঙ্গীদের হারিয়ে ফেলায় তাকে খুব একটা চিন্তিত মনে হলো না। আমরা তাকে স্বান্তনা দেবো কি, তিনিই উল্টো আমাদের আশ্বস্ত করেন, আরে ভাই টেনশন কইরেন না। আল্লার দুনিয়া যদি হাঁচাই গোল হই থাকে তাইলে হ্যাতাগোর লগে আঁর দেখা হইবোই ইনশাল্লাহ। ডোন্ট অরি। দ্যান, কয়ডা চানাচুর খাই। তিন দিন হইছে আইছি। এর মইদ্যে দ্যাশের জিনিস প্যাডে পরে নো।
রুচি চানাচুর খেতে খেতে আমরা সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। সঙ্গে নোয়াখালির ভদ্রলোক যুক্ত হওয়ায় সামনে আগানোর রুচি ফিরে পাই আমরা।
এক মাইল সামনে হেঁটে গিয়ে আমরা যা দেখতে পেলাম, এক মাইল পেছনেও তাই ছিল। তারপরও ট্যুরের অংশ বলে কথা। হাঁটাহাঁটি শেষে করে আমরা ফিরে এলাম নামার স্থানে। এখান থেকেই সমতলে ফিরতে হবে আমাদের।
গ্রেট ওয়াল থেকে নিচে নামার উপায় তিনটি। সবচেয়ে কঠিন এবং খরচাহীন উপায় হচ্ছে পায়ে হেঁটে নামা। সবচেয়ে ব্যয়বহুল ক্যাবল কার। আর তারচেয়ে একটু কম খরচায় স্লাইড রেলে করে নামা যায়। স্লাইড রেল অনেকটা পিছলা খেয়ে ওপর থেকে নিচে নামার মতো। চাকা লাগানো একটা কাঠের পাটাতনের ওপর হুইল ধরে বসে থাকতে হয়। এই অংশটা চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভরপুর। আতংক-উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা নিয়ে নিচে নামছে একেকজন।
নোয়াখালীর আলমাস বললেন (ইতিমধ্যে আমরা তার নাম জেনেছি) চলেন ভাই পিছলা খাই নামি। ছোটবেলার একটা পিলিংস ফাওয়া যাবে, কি বলেন?
আমাদের দলের কেউ কেউ ইতিমধ্যে ক্যাবল কারে চড়ে বসেছে। কেউ পিছলা খেয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দু-চারজন হেঁটে নামার জন্য পা বাড়িয়েছে।
সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ফাহিম ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ফাহিম ভাই বললেন, চলেন ভাই, পিছলাই খাই। একে তো ছোটবেলার ফিলিংস তার উপ্রে এইটা দামের দিক দিয়া মাঝামাঝি আছে। সবসময় মাঝামাঝি অবস্থানে থাকাই ভালো।
মাঝামাঝি থাকার জন্য মাজা বাঁকা করে পিছলা খেতে বসে পড়লাম আমরা। এবং পিছলা খেতে খেতে, পিছলা খেতে খেতে এক সময় নিচে পৌঁছে গেলাম।
পিছলার সিঁড়ি গোড়ায় এসে ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা। আলমাস তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের ফিরে পেলেন সেখানে। বন্ধুরা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। ফিরে পাওয়ার আনন্দে আবেগি আলমাস বন্ধুদের জড়িয়ে ধরলেন।
কিরে, তোরা বুইঝলি ক্যান্নে আঁরে এইখানে পাইবি?
আলমাসের এক বন্ধু বললো, ছোডো বেলাত্তন তুই যে পিছলার পিছলা। পিছলা ছাড়া যে তুই নামতি ন হেইগা আঁরা ঠিকই বুইঝছি। হে হে হে।
আলমাস আর তার বন্ধুরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তাদের চোখে-মুখে পুনর্মিলনের আনন্দ। আমরা এগিয়ে যাই পাশে থাকা স্টোন মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে।
পলাশ মাহবুব : কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। উপ সম্পাদক- সারাবাংলা।