Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ম্যাজিক বই


২৫ মার্চ ২০১৯ ১৫:৪৭

‘ঘুইর‌্যা মরে, লাফাইয়া লাফাইয়া মরে, চিত হইয়া-কাইত হইয়া মরে। একদাম … একরেট…২০ টাকা-২০ টাকা।’
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লেকচার শুনতে থাকা শখানেক মন্ত্রমুদ্ধ শ্রোতাকে দেখে বিখ্যাত লেখক মোবারক আলীর খানিকটা ঈর্ষা হয়। ঈর্ষার কারণ এই যে, তার চেয়ে সামান্য একজন ইঁদুরের ওষুধ বিক্রেতারও ভক্ত বেশি। মনে মনে নিজেকে ব্যর্থ লেখক বলে ধিক্কার দিলেন তিনি, ‘সারাজীবন কী লিখলাম? কী হয়েছে এতশত বই লিখে? জনপ্রিয়তায় যদি একজন ইঁদুর মারার ওষুধ বিক্রেতার ধারে-কাছে পৌঁছতে না পারলাম, তবে আর এই লেখালেখির মূল্য কী?’

বিজ্ঞাপন

ইঁদুর মারার ওষুধ বিক্রেতার সঙ্গে একজন বিখ্যাত লেখকের তুলনা চলে না-এটা ঠিক। কিন্তু টানা পঁয়ত্রিশ বছর লেখালেখির সময়কালে একশর বেশি বই লেখার পরও বইমেলার ষ্টলে দাঁড়ালে যে গুটিকয়েক ভক্ত-দর্শক ভিড় করে, তা ফুটপাতের হকারের তুলনায় অতি নগণ্য। সেই হিসেবে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় মোবারক আলীর।
ইঁদুরের ওষুধ বিক্রেতা আর মোবারক আলীর পেশা ভিন্ন হলেও উভয়ের চাওয়া মানুষ তার চারপাশে ভিড় করুক। ভিড় বেশি মানে বিক্রি বেশি, আর বিক্রি বেশি তো লাভ বেশি-এই সহজ হিসেবটি তাদের কাছে পরিষ্কার। পৃথিবীতে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ছে বলেই তার নিধনের ওষুধও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু পাঠক যে হারে কমতে শুরু করেছে, তাতে বই কিনবে কে? এই জটিল ভাবনা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে মোবারক আলীকে।
‘এভাবে চলতে পারে না। কিছু একটা করতে হবে।’ প্রতিজ্ঞা করেন মোবারক আলী।

বিজ্ঞাপন

লেখকের ভাবনা বাস্তব ভাবনা। অল্প সময়ের ভাবনায় মোবারক আলী একটা আইডিয়া পেয়ে যান। হ্যাঁ, এবার একটি বই বের করব, নতুন ঘরানার-নতুন বই। যে বইয়ের আইডিয়া আজও দুনিয়ার কারো মাথায় আসেনি। পাঠকহীন বাজারে এর চেয়ে ভালো আইডিয়া এবং ভালো বই আর হতেই পারে না। শ্রম কম লাভ বেশি টাইপের বই। আধুনিক দুনিয়ায় কৌশলটা মুখ্য আর যোগ্যতা, মুলধন ও গুণাগুণ গৌণ।
সপ্তাখানেকের মধ্যেই বাজারে এল নতুন উপন্যাস, নাম ‘ম্যাজিক বই’। দেশের সেরা শিল্পী দিয়ে তৈরি প্রচ্ছদ, আকর্ষণীয় রঙে শক্ত মলাট। পাতাগুলো ১২০ গ্রাম অফসেট। বাকি শুধু ফাটাফাটি একটা রিভিউ লিখে শীর্ষ পত্রিকায় ছাপানো। সেটাও ঠিক করে রেখেছেন মোবারক আলী।

যেমনটা ভেবে রেখেছিলেন তেমনই ম্যাজিক বইয়ের এক কপি ড. জাবর মোল্লার কাছে নিয়ে গেলেন লেখক মোবারক আলী। ড. জাবর দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি কোনো বইকে ভালো বললে সেই বই মুহুর্তেই পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হয়। দেশের বইবিমুখ মানুষকে বই কেনানোর জন্য ড. জাবেরের প্রসংসাসূচক দুটি বাক্যই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে বইয়ের ভিতরে লেখক কী দিতে পেরেছেন সেটা বড় নয়। ড. জাবের বহুকাল আগে বই পড়া বাদ দিয়েছেন, তিনি পূর্বের পড়া থেকে জাবর কেটে কেটে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন, ফরমায়েশমত বইয়ের রিভিউ লেখেন। তাকে দিয়ে বইয়ের গুণগান করানো গেলে এবং সেটা দিয়ে প্রথম সারির মিডিয়ায় প্রচারণা করা গেলে এক ঝটকায় তৃতীয় মুদ্রণ নিশ্চিত!

তিনদিন পর ড. জাবর মোল্লা বইয়ের যে গুণগান লিখে দিলেন তা দেখে রীতিমত বিস্মিত মোবারক আলী। মনে মনে বললেন, কেল্লাফতে! তবে রিভিউ লেখাখানি হাত বদলের সময় দুইজনই মুচকি হাসলেন, উভয়ের হাসি তাৎপর্যপূর্ণ। ড. জাবর মোল্লা হেসেছেন এই কারণে যে, তিনি বই বই না পড়েই তার কম্পিউটারে রিভিউ লেখার যে ষ্ট্যান্ডার্ড ফরমেট আছে, সেখানে শুধু বই আর লেখকের নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন, সে কারণে। অন্যদিকে, লেখক মোবারক আলী হেসেছেন এই জন্য যে, কৌশলে তিনি জিতে গেছেন!

লেখক মোবারক আলীর ইঙ্গিতপূর্ণ হাসিটা ড. জাবরের চোখ এড়িয়েছে তা নয়, কিন্তু জগতে সবকিছুকে গুরুত্ব দিতে গেলে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাও অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। সঙ্গত বিবেচনায় তিনি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসির অগ্র-পশ্চাৎ উদঘাটনে না গিয়ে আপাতত এড়িয়ে গেলেন।
দেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোয় ম্যাজিক বই বিষয়ে ড. জাবর মোল্লার জাবরকাটা প্রশংসা প্রকাশের পর মানুষ হইচই করে বই কিনতে লাগল। নানারকম ডটকম, দ্বিতীয়া প্রকাশনীসহ নামিদামি লাইব্রেরীতে বই সরবরাহ করা হয়েছে। বই পড়ুন, বই উপহার দিন-শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে বই না পড়া যুগের মানুষগুলো বই উপহার দিতে লাগলেন। উপহার পেয়ে খুশি মানুষগুলো অন্যান্য উপহার যেমন সাজিয়ে রাখেন তেমনি বইও বুকশেলফে সাজিয়ে রাখছেন।
টেলিভিশনে লাইভ অনুষ্ঠান হচ্ছে, সুন্দরী উপস্থাপিকার সামনে রাখা ম্যাজিক বইয়ের কপি। রাস্তায় দামি দামি গাড়ির সামনেও দেখা পাওয়া যায় ম্যাজিক বইয়ের কপি। বইয়ের পুরুত্বও ভালো, পুরো ২০০ পৃষ্ঠা। টকশোতে জনৈক বিজ্ঞ আলোচক বলেন, ‘এমন বই জগতে খুব বেশি নাই। এই বই জাতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।’ অবশ্য কত উঁচুতে সেটা তিনি বলেন না। তো আরেকজন বলেন, ‘এই বইয়ের লেখককে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরষ্কার প্রদানের জন্য দাবি জানাচ্ছি।’ কেউ একজন একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘যথাশীঘ্র সম্ভব বইয়ের এক কপি সরকারি উদ্যোগে এখনই নোবেল কমিটির কাছে পাঠানো হোক।’
মোবারক আলী বলেন, ‘শিক্ষিত সমাজ যখন বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মানে বইবিমুখ যুগে ভালো লেখা নয়, দরকার সৃষ্টিশীল চিন্তা ও কৌশল। সেটা পেরেছি বলেই আজকে আমার বই নিয়ে এত হইচই। এর আগে শতাধিক বই লিখে যে সাড়া পাইনি, তার তিনগুণ সাড়া পেয়েছি এই বই থেকে। আমি নিশ্চিত এই বই মানুষের চোখ খুলে দিবে।’
‘ম্যাজিক বই আমারও এক কপি আছে,’ এ কথাটা বুক ফুলিয়ে বলার জন্য আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই হুড়মুড় করে বই কিনছে। মুদ্রণ-পুনর্মুন্দ্রণ চলছে। ষ্টক শেষ হয়, আবার নতুন চালান আসে। চারদিকে প্রশংসা আর প্রশংসা।

এদিকে ড. জাবর আলী, যিনি জাবর কেটে কেটে বইয়ের প্রশংসা লেখেন, তার পড়ার ঘরে ছড়ানো ছিটানো অনেক বই। প্রতিবছর একুশে বইমেলার পর এমনই হয় তার রিডিংরুমের। তিনি কাজের ছেলেকে বললেন বইগুলো গুছিয়ে শেলফে তুলে রাখতে।
বই গোছাতে গিয়ে হঠাৎ ম্যাজিক বইখানা কাজের ছেলের হাত থেকে পরে খুলে গেল। তারপর মাথার ওপর শো শো করে ঘুরতে থাকা সিলিংফ্যানের বাতাসে ম্যাজিক বইয়ের পাতাগুলো ওল্টাতে থাকল। এক পাতা দুই পাতা তিন পাতা…। ড. জাবরের বাসায় এই প্রথম ম্যাজিক বইয়ের পাতাগুলো আলোর মুখ দেখল, তাও আবার কাজের ছেলের সচেতনতার অভাবে, হাত থেকে পড়ে।
কাজের ছেলেটা পড়াশোনা জানে না। তবে বইয়ের পাতায় কালো কালো আঁকিবুঁকিকে যে লেখা বলে সেটা সে জানে। সে দেখল বইয়ের পাতা সব সাদা, মানে বইয়ের ভেতরে কোনো লেখা নেই। বইটা সে হাতে নিল। চমৎকার প্রচ্ছদ, শক্ত মলাট।
‘স্যার, এই বইটার সব পাতা সাদা কেন?’
ড. জাবর মোল্লা অন্য একটি বইয়ের রিভিউ লিখছিলেন। কাজের ছেলের প্রশ্ন শুনে তিনি চমকে উঠলেন। জীবনে প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটেছে বলেই ধাক্কাটা একটু বেশি। কড়া ধমক দিয়ে কাজের ছেলেকে বইখানা শেলফে রাখতে বললেন ড. জাবর। ধমকে কাজ হলো, কিন্তু মনে মনে ড. জাবর আঁতকে উঠলেন, বাজারে ম্যাজিক বইয়ের সব কপি কি এই রকম ফকফকে? তাহলে প্রশংসা করে যে রিভিউ লিখলাম, তার কি হবে?
‘না, এটা হতেই পারে না,’ মনে মনে স্বান্তনা খুজলেন ড. জাবর। প্রতিদিন হাজার হাজার কপি যে বিক্রি হচ্ছে, নিশ্চয় সবাই দেখে কিনছে। আবার গোলটেবিল, টেলিভিশন লাইভ, লেখকের সঙ্গে সেলফি, অটোগ্রাফ গ্রহণ- এসব কি এমনি এমনিই হচ্ছে? অবশ্যই না। এ যুগে মানুষ বই পড়ে না, তাই বলে কেউ যে পড়ে না তা তো নয়। নিশ্চয় তাকে দেওয়া বইয়ের পাতাগুলো প্রেসের ভুলে সাদা রয়ে গেছে।

ড. জাবরের ঘুম আসে না। টানা তিন রাত তিনি নির্ঘুম। না পড়েই যে বইয়ের বিপুল প্রশংসা লিখেছেন, এটা মানুষ জানলে কি বলবে? বিষয়টা ক্লিয়ার হওয়া দরকার।
বাসার কাছেই শাহবাগ। তিনি গেলেন কফিশপ কাম লাইব্রেরিতে। মানুষ বইয়ের দোকানে আসতে চায় না বলে কফিশপের আড়ালে বইয়ের দোকান দিয়ে জাতিকে বই পড়াতে চান এক ব্যবসায়ী। কিন্তু খদ্দেররা ব্যবসায়ীর চেয়েও ত্যান্দর। শপে গিয়ে সবাই কফি খায়, মাঝেসাঝে দুই-একজন বই কিনলেও কেউ বই পড়ে না। বইয়ের শেলফের ধারে কাছেও কেউ ঘেঁষে না।
তবে লাইব্রেরির ‘কফি কর্নারের’ একবারে কোনার চেয়ারে এক সুন্দরী মহিলা কফি খাচ্ছেন আর কার সঙ্গে যেন মোবাইলে কথা বলছেন। সামনে একখানা ম্যাজিক বই। ‘হ্যাঁ, ভাবী ম্যাজিক বইটা আমিও পড়েছি। দারুন বই। এমন বই গত দশ বছরেও পড়িনি। আর হ্যাঁ, বইয়ের মলাটটা দারুন না? কী সুন্দর গোলাপি, মনে হয় যেন তাজ গোলাপের পাপড়ি দিয়ে মলাটটা বানিয়েছে…।’
মোবাইলে সুন্দরী ভদ্রমহিলার কথোপকথন শুনে ড. জাবের খানিকটা স্বস্তি পেলেন, যাক, কেউ একজন তো বইটা পড়েছে। তবুও আশঙ্কা কাটে না তার।
বিশাল লাইব্রেরির শেলফ খুঁজে খুঁজে ড. জাবর ম্যাজিক বইয়ের এককপি পেলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে তিনি পাতা ওল্টালেন।
না পার্থক্য নেই, তার বাসায় থাকা বই আর এই বই হুবহু এক – পাতাগুলো ধবধবে সাদা।
ড. জাবর মোল্লার চোখের সামনে ভাসতে লাগল লেখক মোবারক আলীর সেই ইঙ্গিতপূর্ণ হাসিটা, যে হাসিটা তিনি হেসেছিলেন তার কাছ থেকে রিভিউ-স্ক্রিপ্ট গ্রহণের সময়।

সারাবাংলা/পিএম

ম্যাজিক বই শরীফ শহীদুল্লাহ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর