পূর্ণ এক জ্যোৎস্না দিন
১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৩৪
সাবা চিৎকার করে উঠল, চমকে উঠলাম আমি।
দূর থেকে মা একদিন বলেছিল, ‘বাবা, আমি মরে যাচ্ছি!’ পড়ার টেবিল থেকে জীবনের শ্রেষ্ঠ লাফটা দিয়েছিলাম আমি। এরপর দুর্দমনীয় দৌড়। রান্নাঘরের কপাট পেরিয়েই বিস্ফারিত চোখ। মায়ের ডান হাতের কবজির নিচটা ফালি হয়ে গেছে। ফিনকি রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটির মেঝে। ভিজে যাচ্ছে পরনের তাঁতের শাড়ি। লাল তরলে ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশ। বাবা মস্ত বড় একটা শোল মাছ এনেছেন সকালে। দুপুরে অফিস ফিরে খাবেন। সেটা কাটতে গিয়েই মায়ের টুকরো হাত। সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরি হাতটা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকি, ‘ফরিদ কাকা!’ দোকানের গোমস্তা কাকা দৌড়ে আসেন। নিয়ে যান হাসপাতালে। ওই হাত জোড়া লাগতে তিন সপ্তাহ। আমি প্রতিদিন অন্তত একঘণ্টা হাত ছুঁয়ে থাকতাম মার। মা কত গল্প বলতেন তখন আমাকে!
সাবা চিৎকার করে উঠলো এবার, ‘বাবা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।’
সম্পূর্ণ স্থির চোখে আমি মেয়ের দিকে তাকালাম। বিছানা থেকে নেমে এসেছে সে। মেঝেতে এখন। কাতরাচ্ছে। আমি তবু বসে আছি চেয়ারে। সকালে না পড়া দৈনিকটা নেতিয়ে আছে হাতে। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে চা। সামনে খোলা টিভির খবর, ঢুকছে না তা কানে।
দু হাত পেটে চেপে সাবা কাত হয়ে গেল একপাশে। আমি এখন কেবল ওর পিঠটা দেখতে পাচ্ছি। সিল্কি চুলের গোছাটা গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। গায়ের নীল থ্রি কোয়ার্টার ফ্রকটা কুঁচকে যাচ্ছে ওর কাতরানিতে।
বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল সাবা, ‘বাবা, মাকে ফোন করো। আমি আর পারছি না।’
স্থির হয়ে বসে রই তবু। সাবা আড়চোখে একবার তাকায় আমার দিকে। সমস্ত কাতরতা নিয়ে সে আরো একবার চিৎকার করে ওঠে, ‘বাবা, প্লিজ, প্লিজ বাবা।’
দ্বিধাজনিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াই আমি। তারপর আবারও স্থির। দু পা আর চলে না আমার। মেয়ের রুম থেকে আমার রুমটা দশ সেকেন্ডের ব্যবধান। আমি তিনগুণ সময় নেই। চার্জে দেওয়া মোবাইল হাতে নেই আরও দুই গুণ সময়ে। তারপর সংকোচ এসে আবার জড়িয়ে ধরে আমাকে। কন্ট্যাক্টসে গিয়ে স্থির হই আরও কিছুক্ষণ। মনে মনে হিসাব করে ফেলি—তিন মাস সতের দিন চলে গেছে। এর মধ্যে আর ফোন করা হয়নি ফাহমিকে।
রিং বাজছে ওপাশে। শেষও হলো। রিসিভ হলো না।
বুকের ভেতর অভিমান জমে আছে, ক্রোধে পরিণত হলো একটু। বাটনে চাপ দিলাম আবার। রিং বাজলো। শেষও হলো। কিন্তু রিসিভ হলো না।
ক্রোধটা বেড়ে যাচ্ছে। আরো একবার বাটনে চাপ দিতে নিয়েই থেমে গেলাম—না, আর না। মরে গেলেও না।
সাবা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিল আবার, ‘বাবা বাঁচাও, আমার আর সহ্য হচ্ছে না।’
দৌড়ে চলে আসি আবার মেয়ের রুমে। এবার সম্পূর্র্ণ উপুড় হয়ে গেছে সে মেঝেতে। আমার শরীর ঘেমে উঠেছে। ভেতরটায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে তুমুল গতিতে। নিজেকে পুরো সমর্পণের ভঙ্গিতে পাশে বসি ওর। হাত রাখি পিঠে। স্থির হাত, স্থির আমার চিন্তাও।
‘বাবা, কোমড় ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার।’
শঙ্কা আর অস্বস্তি নিয়ে হাতটা নামিয়ে আনি সাবার কোমড়ে। অনেকটা কাছাকাছি যেতেই থেমে যাই। ও শক্ত করে ওর একটা হাত রাখে আমার হাতে। মৃদু চাপ দেয়। আমি আমার হাতের তালুটা ঠেসে ধরি ওর কোমড়ে। মাসাজের ভঙ্গিতে চাপতে থাকি সমস্ত একাগ্রতা নিয়ে। সাবার কাতরানি একটু থামে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি আমি। কয়েক সেকেণ্ড। তারপর আবার সাবার কাতরানি। মৃদু চিৎকারও।
‘মা, এক গ্লাস পানি দেই।’
‘দাও, ঠাণ্ডা দিও।’
ফ্রিজের কাছে দৌড়ে যাই। বোতল থেকে পানি ঢালি গ্লাসে। কিছুটা নরমাল মিশাই। ফিরে এসে এগিয়ে দেই সাবার দিকে। অল্প একটু মাথা উঁচু করে এক ঢোক পানি গিলে ফিরে দিল আবার গ্লাসটা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে সে। গ্লাসটা মেঝেতে রেখে হাত রাখি ওর মাথায়।
‘বাবা?’
দূর থেকে বলা গলার মতো উত্তর দেই আমি, ‘উ।’
‘তুমি কি আমার কোমড়ের নিচটা একটু জোরে চাপ দিতে পারবে?’
সব ঝেড়ে ফেলে আমি আবার হাত নিয়ে আসি কোমড়ে। চাপ দেই বেশ জোরেই। সাবা বলল, ‘বাবা, আরও জোরে।’
আরও একটু শক্তি প্রয়োগ করি আমি।
নিবিড় ঘুমানোর মতো কিছুটা চুপ হয়ে থাকে সাবা। আরেক হাত মাথায় রাখি ওর। বুলাতে থাকি পিতার মমতায়। ঝট করে উঠে বসে ও। দুই হাত দিয়ে খামচে ধরে আমার ডান হাতটা। জগতের সমস্ত কাতরতা নিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘মাকে তুমি আরও একবার ফোন দাও, বাবা।’
‘দুবার দিয়েছি।’
‘আরো দুবার দাও। তিনবার দাও। চারবার দাও। মাকে খুব দরকার বাবা। প্লিজ।’
উঠে দাঁড়াই আমি আবার। পা নড়ে না। অনড় হয়ে থাকি মেঝেতে। নরম করে পায়ের আঙুলগুলো ছুঁয়ে দেয় সাবা। ভেতরটা গলে যায় আমার, উগরে ওঠে সমস্ত চাপা কষ্ট।
‘বাবা?’
‘জি।’ গলা থেকে স্বর বের হয়ে না আমার।
‘তোমার পায়ের নখগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে।’
‘পায়ের নখ কাটতে পারি না আমি।’
সাবার ম্লান হাসি, ‘মা তোমাকে অনেক যত্ন করে নখ কেটে দিত। রক্ত দেখলে ভয় পাও তুমি। কোরবানির গরু জবাই করা দেখতে পারো না তুমি, মুরগি জবাই করে না কখনো। একদিন নখ কাটতে গিয়ে মা তোমার পায়ের একটা অংশ কেটে ফেলেছিল। তোমার চোখে ভীতি, মার অপরাধবোধ। আর আমি হাসতে হাসতে মরে যাই।’ সাবা একটু থামে, ‘মা, তোমাকে অনেক ভালোবাসে বাবা।’
আমি আর দাঁড়াই না। নিজেকে লুকাতে, নিজের চোখ উগরানো জল লুকাতে নিজের রুমে চলে আসি। ফোনটা হাতে নেই। কিন্তু বাটন চাপতে ইচ্ছে করে না। চোখ স্থির করে ঘরের মাঝখানে তাকাই। মনে হলো-ফাহমি নড়ে উঠল হঠাৎ। ওই যে টোল ফেলা হাসিতে এগিয়ে আসছে ঘরের কোণা থেকে। এদিকে। কাছে এলো, পাশে বসল। হাত রাখল কাঁধে। কান ছুঁইয়ে দিল দু আঙুলে। কাত হয়ে যাই আমি। বুজে ফেলি চোখ। একটু পর টের পাই-না, ও নেই; আমি একাই।
কোনো কোনো দিন এমন হয়েছে-কোনো কথাই বলি না আমরা। মুরাকামিতে বুঁদ হয়ে থাকে ও, আমি কোক স্টুডিওতে। মেহজাবিনের গলা শুনি আর বিড়বিড় করে বলি-সোবাহানাল্লাহ…।
খুব ইলিশ খেতে ইচ্ছে হলো একদিন। বাজারে তখন নিষিদ্ধ। অস্থির হয়ে গেল ফাহমি। চার-পাঁচটা বাজার ঘুরল, পেল না। এক রাতে অফিস থেকে ফিরতেই কী আপন হাসি-দু টুকরো ইলিশ রেধেছে, সরষে দিয়ে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, ‘লুবনার বাসায় ছিল। দুই টুকরো নিয়ে এসেছি।’
‘লুবনার বাসা থেকে মাছ!’
‘ও আমার খুব ভালো বন্ধু। ওর কাছ থেকে আমি অনেক কিছুই আনতে পারি।’ ফাহমি হাসতে থাকে, আমি দ্বিধা বোধ করি। টের পায় তা ও। বাম হাতের বাহুটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বিষাদ গলায় বলে, ‘একদিন পুরো একটা ইলিশ কিনে নিয়ে যাব ওর বাসায়।’
বাসায় ফিরেছি এক রাতে। মাঝ রাত। ব্যাংক জব। জুন ক্লোজিং। রাত যতই হোক, দরজা খুলে দিতো ও নিজেই। সেদিন খুললো না। এতদিন এমন হয়নি কখনো। সাবা খুলে দিলো।
রুমে ঢুকলাম আমার। ফাহমি শুয়ে আছে। শঙ্কা এবং অভিমান দুটোই বইছে, সমান্তরাল। হাতের ঘড়িটা একটু শব্দ করেই রাখলাম টেবিলে। আড়চোখ বিছানায়। কাত হয়ে আছে ফাহমি। আগের মতোই। নড়চড় নেই একটু। অভিমানটা হেরে যাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে শঙ্কা।
পাশে গিয়ে বসলাম ফাহমির। হাত রাখলাম বাহুতে। ও আঁতকে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখেই উঠে বসলো ঝট করে। আতঙ্কগ্রস্ত গলা ওর, ‘কখন এলে!’
ফাহমির চোখে চোখ আটকে যায় আমার। ভেজা প্রলেপ। কিছুটা ফোলাও। অজানা দূর্ভাবনায় মুষরে যায় আমার ভেতরটা। আমি ভেজা গলায় বলি, ‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’ হেয়ালি উত্তর ওর।
অস্থির হয়ে উঠি আমি, ‘মিথ্যা বলছো তুমি, কিছু একটা হয়েছে।’
‘বললাম তো কিছু হয়নি।’ ফাহমির গলা আগের চেয়ে জোরালো।
আমি আর কিছু বলি না। স্বাভাবিক হয়ে যাই দ্রুত। হাত-মুখ ধুই। রাতের খাবার খাই। গল্প করি সাবার সঙ্গে। টুকটাক কিছু ব্যক্তিগত কাজও সারি। তারপর ঘুম।
হঠাৎ গোঙ্গানির শব্দ। চমকে উঠি। বেড সুইচে হাত রাখি। দেখি, নিজেকে সম্পূর্র্ণ কুঁকড়ে ফেলেছে ফাহমি। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে ওর মুখ। জাপটে ধরি সমস্ত আকুলতায়। তারপর জেনে যাই সেই ব্যথা-একবার ওর জন্ডিস হয়েছিল, সেই ছোটকালে। মাঝে মাঝে ব্যথা করে পেটের ডান পাশটা। ইদানীং বেশি।
দুই মাস নিয়মিত ডাক্তারের স্পর্শে অনেকটা ভালো হয়ে যায় ফাহমি। ও ঘুমাতো, আমি মাঝরাতে পায়চারি করি মেঝেতে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই-আঠার বছর আগে গত হওয়া বাবা আমার পাশে পায়চারি করছেন। মা কিংবা আমাদের কারো সামান্য অসুখ হলে অস্থির হয়ে যেতেন তিনি। এরকম পাগল-চিত্তে হাঁটাহাঁটি করতেন সারা ঘর, তারপর একটু পর পর পাশে বসে মাথায় হাত। সারারাত তিনি ঘুমাতেন না। সারাদিনও না, যতক্ষণ না অসুখমুক্ত হচ্ছি আমরা।
বাবার অনেক কিছু পেয়েছি আমি, এই অস্থিরতাও। ফাহমিকে একদিন বললাম, ‘বড় একটা অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছিলে প্রায়। একটুর জন্য লিভারটা বেঁচে গেছে। পনের বছর ধরে সংসার করছি আমরা। এখনো তোমার বন্ধু হতে পারলাম না। যদি হতেই পারতাম, তাহলে তোমার পেটের ওই ব্যথার ভাগটা আমাকেও দিতে।’
ফাহমির কোনো কথা বলল না। কেবল চোখ দুটো তুলে নিচু করে ফেলল আবার।
‘আজ একটা কথা বলব তোমাকে-অন্তত একটা মাস আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে চাই।’
এবারও কিছু বলল না ফাহমি।
পরের দিন অফিস থেকে এসে দেখি ফাহমি নেই। ছোট্ট একটা চিরকুট, ‘ভালো থেকো, একা একা। মেয়েটা যেতে চায়নি আমার সঙ্গে। এটা তো জানি আমি-আমার চেয়ে যোজন যোজন প্রিয় তুমি ওর।’
খুব অভিমান হয়েছিল সেদিন। ওটা এখনো কমেনি, এই তিন মাস তের দিনে বরং আরো বেড়েছে। আজ বেড়ে গেছে আরো একটু।
বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে আমার। সাবা চুপচাপ কেন! ওর তো কোনো শব্দ পাচ্ছি না। দৌড়ে ওর রুমে যাই। ও নেই। আমি চিৎকার করে উঠি, ‘সাবা…।’
ক্লান্ত গলায় সাবা উত্তর দেয়, ‘বাবা, তুমি মাকে এনে দাও। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি বাবা। কিছু বুঝতে পারছি না আমি।’
বাথরুমের দরজায় আলতো ঠেলা দিলাম আমি। বন্ধ। ভেতরে সাবার মৃদু গোঙ্গানি। আর পানির শব্দ।
নিজের রুমে চলে এলাম আবার। ফাহমিকে নয়, শাশুড়ির নাম্বারে বাটন চাপলাম। দুবারেই রিসিভ করলেন তিনি। আমি আমার সমস্ত উৎকণ্ঠা নিয়ে বললাম, ‘মা, ফাহমিকে দিন। কুইক।’
ফাহমিকে ফোন দিলেন মা। আমি ওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাবাবৃত্তান্তে ভাসিয়ে দিলাম। আমি এ পাশ থেকেই টের পেলাম-ঢুকরে কেঁদে উঠল ফাহমি। ওর আলমারিটা খুলতে বলল এবং আরও কিছু কথা শেষ করে বলল, ‘আমি না আসা পর্যন্ত তুমি আমার মেয়েটাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে রাখবে।’ কান্নার প্রবল প্রগলভায় ও শেষ করল, ‘আমি আসছি।’
দুই.
সাবা বসে আছে আমার সামনে। দুই হাঁটু উঁচু করে, তার ওপর দুই হাত, তাতে ঠেকিয়ে রেখেছে থুতনিটা। ব্যথা ছড়িয়ে পরেছে ওর চোখে, কপালে, ভ্রূতে। দাঁত চেপে বসে আছে ও। আর আমি একটু পর পর জিজ্ঞেস করছি, ‘ব্যথা কমেছে মা?’ কোনো উত্তর দেয় না সাবা, আরো অস্থির হয়ে যাই আমি।
মিনিট বিশেক আগে ফাহমি বলেছিল-ও আসছে। রাস্তার যা অবস্থা, আরও আধা ঘণ্টা লাগবে। এই বিশ মিনিটে দশবারের বেশি ফোন দিয়েছে ও। আমি ওকে শান্ত করতে চাই, ও আরও অশান্ত হয়ে ওঠে।
সাবা হঠাৎ ওর একটা হাত রাখে আমার কাঁধে, ‘বাবা, আমি একটু শুই। তুমি কি আমার পেটে একটু হাত রাখবে?’
উত্তরের প্রত্যাশা করে না সাবা। শুয়ে পড়ে ও। আমার সামনে আমার রক্ত, আমার অস্তিত্ব, আমার ঔরস। আমি গুটিয়ে রই তবু। জড়োসড়ো হয়ে যাই আরও। সংকোচের তুমুল পাহাড় এসে জাপটে পড়ে আমার ওপর।
সাবা কাতর গলায় বলে, ‘বাবা, রাখো না প্লিজ।’
দ্বিধা আর বিব্রতায় হাত বাড়িয়ে দেই আমি। সদ্য তের পেরুনো আমার হলুদ রঙা মেয়েটা কেমন নীল হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে গেছে ঝরে পরা পাতার মতো। চোখ দুটো আলতো বুজে হাত রাখি ওর পেটে। ও কষ্টমাখা শব্দ করে একবার। তারপর ওর একটা হাত তুলে দেয় আমার হাতের ওপর। চাপ দিতে থাকে মৃদু মৃদু।
রুমের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। কিচ্ছু নেই ওখানে। তবু ওই তাকানোত কী মুগ্ধতা! চোখের দু পাশ ঘেঁষে গড়িয়ে পরা পানিতে আমি আমার বুকের ভেতরের ভাঙনের শব্দ শুনি। ভেঙে যাচ্ছে ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে সব বাঁধ। তারপর সেই ভাঙা বাঁধের জল! জলের উদগীরণে ভেসে যায় আমার চোখ, আমার সমগ্র নিস্তব্ধতা।
‘বাবা, মাথায় একটা হাত রাখো।’
পেটের হাতটা আমি মাথায় নিতে চাই। পারি না। খামচে ধরে সাবা এক হাতে। আরেক হাতে আমার আরেক হাতটা টেনে নেয়, তুলে দেয় নিজের মাথায়। তেল চিটচিটে ঘামে আমি বুলাতে থাকি হাত। একটু পর আধো স্বরে বলি, ‘মা, ব্যথা কেমন এখন?’
‘একটু কমে একটু বাড়ে।’
‘আরো একটু পানি খাবে।’
‘না।’ সিলিং থেকে চোখটা আমার দিকে ফেরায়, ‘মা কত দূর, বাবা?’
‘এই তো এসে যাবে।’
‘মা এলে তোমরা দুজন একসঙ্গে বসবে। আমার পাশে। আমি মার কোলে মাথা রাখব, আর জড়িয়ে রাখব তোমাকে। কতদিন তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখি না। কত দিন আমরা একসঙ্গে ডায়নিং টেবিলে বসি না, চা খাই না বারান্দার বেতের চেয়ারে। বাবা?’
আমি কোনো উত্তর দেই না।
‘বাবা, শুনতে পাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ বলো।’
‘আমাদের ক্লাসের দয়িতা আছে না, ওর যখন আট বছর, ওর মা’টা তখন মারা যায়। ওর বাবা আর বিয়ে করেননি।’ হাঁপাতে থাকে সাবা, ‘তিন মাস আগে ওর একদিন আমার মতো ব্যথা হয়েছিল। ওর বাবা সারাদিন ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল।’ সাবা কাঁদছে, ‘দয়িতা বলেছিল, বাবাদের জড়িয়ে ধরার মধ্যে নাকি অন্যরকম একটা আনন্দ আছে, বাবা।’
চোখ দুটো আবার বুজে ফেলি আমি। আলতো করে তুলে ধরি সাবার মাথাটা। বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে জাপটে ধরি পরম মমতায়। ও গুটিশুঁটি হয়ে মাথাটা ঠেসে দেয় আমার বুকের ভেতর। পুব দিকে একটা জানালা আছে রুমে। সেদিকে তাকাই আমি। রাতের অন্ধকারেও এক টুকরো আলো এসে থমকে আছে পাশের বাসার মাধবীলতায়।
শব্দ হলো দরজায়। হন্তদন্ত হয়ে ফাহমী ঢুকল রুমে। জাপটে ধরা হাতের ফাঁক দিয়ে সাবা একবার ওর মাকে দেখল। তারপর সমস্ত উচ্ছাস নিয়ে হাত বাড়ালো সামনের দিকে। পূর্ণ আকুলতা নিয়ে ফাহমি পাশে বসল, মাথা ঠেকাল সাবার মাথায়। সংকোচে দোলা ওর হাতটা হাতে নেই নেই আমি। জড়িয়ে নেই নিজের মাঝে।
তারপর অনেকক্ষণ। ফাহমি ওর মুখটা আমার কানের কাছে আনে। ফিসফিস করে কী একটা বলতে নেয়, পারে না। কান্নার জোয়ার ওকে বাধা দিচ্ছে। তারপর জড়ানো গলায় শেষমেষ বলেই ফেলে, ‘কী অদ্ভুত, আমাদের মেয়েটা আজ বড় হয়ে গেলো!’
আমি কোনো উত্তর দেই না। কেবল প্রবল অনুভবে টের পাই, সব কিছু পূর্ণতা পায় একদিন-আমার বাবাত্ব কিংবা মেয়ের নারীত্ব! ঘরের কোনা থেকে একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে হঠাৎ-টিকটিক টিকটিক।