কথাসাহিত্যিক শওকত আলী : হৃদয়ে মম
২৫ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:৫২
ড. অরিজিৎ ভট্টাচার্য
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত আলী আর আমাদের মধ্যে সশরীরের কোনোদিন ফিরে আসবেন না, এই নির্মম সত্যটা তাঁর অনুরাগীদের কাছে কতোখানি বেদনার তা ভাষায় প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। তবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে যে, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরদিন শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে যেমন আজ গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গে তাঁর মাতৃভূমির শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও আজ স্বজন হারানোর বেদনা। ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করা শওকত আলীর সৃষ্টির ভুবন বাংলা সাহিত্যকে নিরন্তর সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর উপন্যাস-গল্পে একদিকে যেমন সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবন চিত্রিত হয়েছে, তেমনি একেবারে খেটে খাওয়া সাধারণ নিম্নবর্গের জীবনও স্থান পেয়েছে। মানুষের উজ্জীবনের যে চেতনা তার প্রতিফলন সর্বক্ষেত্রে উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। জীবনের সামগ্রিকতাকে ধরার লক্ষ্যেই তিনি সদা ব্রতী থেকেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে স্মরণ করে নেওয়া যায় পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩), যাত্রা ( ১৯৭৬), প্রদোষে প্রাকৃতজন ( ১৯৮৪), সম্বল (১৯৮৬), ওয়ারিশ (১৯৮৯), নাঢ়াই (২০০৩), বসত (২০০৫), মাদারডাঙার কথা (২০১১) প্রভৃতি। তাঁর লেখা উন্মূল বাসনা (১৯৬৮), লেলিহান সাধ (১৯৭৮) প্রভৃতি গল্পও পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলো।
তিনি মনে করতেন যে, সামগ্রিকভাবে কেউ যদি রাজনীতিকে পরিত্যাগ করে সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করে, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে, সেটা ঠিক হয় না। জীবনকে সেক্ষেত্রে পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা যায় না। জীবনের একটা খণ্ড অংশই সেখানে পাওয়া যায় মাত্র। প্রকৃতিলগ্ন যে মানুষ, তাদের জীবন-যাপন, তাদের চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, এগুলো যেমন উঠে আসা দরকার, তেমনি যারা বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করছে, নগর-সভ্যতার মধ্যে বসবাস করে, শোষনের মধ্যে যাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে, তাদের কাহিনিও সমানভাবে বলা দরকার।
বর্নাঢ্য ও সংগ্রামমুখর জীবনে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের সাক্ষী তিনি। দেখেছেন দেশভাগ। শিকার হয়েছেন নির্মম বাস্তবতার। জন্মস্থান ছেড়ে আসার সুতীব্র বেদনা তাঁর রক্তে বপন করেছে সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তৃণমূল মানুষের মুক্তি ও প্রাপ্তির জায়গায় তিনি ছিলেন আপোসহীন। তাঁর গল্প-উপন্যাসে তাই ধ্বনিত হয়েছে সাধারন মানুষের শোষন, নির্যাতন, বঞ্চনার, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। প্রকাশের ভিন্নতায় তা হয়ে উঠেছে শিল্পোর্ত্তীন জীবনের ঘনিষ্ঠ পাঠ।
শওকত আলীর গল্প-উপন্যাসের মূল জায়গা জুড়ে আছে নিম্নবর্গের মানুষ ও শোষিত জীবনের কথকতা। সামন্তবাদী সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছে তাঁর কলম। জীবনের খুব কাছ থেকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা। অনুভব করেছেন একাত্মতা। তাঁর মতো করে নির্মোহভাবে জীবনকে খুব কম মানুষই প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের ইতিহাসের গভীরে ঢুকে তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সচেষ্ট হয়েছেন।
আবহমান বাংলার আঞ্চলিকতার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে তাঁর লেখার মধ্যে। তাঁর উপন্যাসের ঘটনাশ্রিত চরিত্রে মুখ্য হয়ে উঠে মননের সক্রিয় ভূমিকা। গ্রাম-বাংলা, বিশেষত উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর অঞ্চলের প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা, গ্রামীণ বা মফস্বলী মানুষের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দুরাশা, বিষন্নতা, নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখার মধ্যে। ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার, শোষণ, প্রতারণা, যৌনতাবোধ, মান-অভিমান, প্রত্যয়, অসহায়ত্ব, প্রভৃতি মানবিক আচার-আচরণকে উপলব্ধির আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন তিনি। তাঁর প্রয়াস মানুষ ও মাটির খুব কাছাকাছি থেকে এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।
তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যের বিপুল ক্ষতি হয়ে হলো, একথা বললে অত্যুক্তি হয় না।
[ ড. অরিজিৎ ভট্টাচার্য- সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, মানকর কলেজ, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ। তিনি কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি উপাধি অর্জন করেছেন। শওকত আলী গবেষক হিসেবে তাঁর একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এখানে তুলে ধরা হলো।]
সারাবাংলা/পিএম