আমিই মিথিলাকে বলেছি লাশটা বাবুর নয়
১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৩:১১
পারা আর না পারা নিয়ে পুরুষমানুষ মিথ্যে একটু বেশিই বলে। মিথ্যেটুকুও পৌরুষের অংশ।
আমি তো পারি! বেশ পারি! মিথিলার শীৎকার আমার সক্ষমতার প্রমাণ দেয়।
তাই না মিথিলা? তোমার কী ধারণা?
প্রথম দিকে মুগ্ধচোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তারপর যখন লজ্জাটা কাটলো, বললো, দারুণ। একেবারে হিউ হেফনার!
হিউ হেফনার?
নাম শোনোনি? মিথিলা অবাক হয়।
মিথিলা সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি যে কী আবদুল খালেক! তুমি এমন একটা মানুষের নামই জানো না! তুমি একটা গণ্ডমূর্খ, ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেরাও তার নাম জানতো। হিউ হেফনার প্লেবয় সাম্রাজ্যের মালিক। এক শোয়াতে পাঁচটা সুন্দরীকে স্যাটিসফাই করতে পারতেন।
বোকার মতোই আমি জিজ্ঞেস করি, কীভাবে?
কীভাবে আবার? তোমার মতো করেই। অবশ্য তুমি বাকি চারজন পাবেই-বা কোথায়? আর যদি পেয়েও যেতে চারজনই আমার হাতেই খুন হতো। অবশ্য তখন আমাকে নিয়ে বাজে রকম খবর ছাপা হতো: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রীর কাণ্ড! খুনের দায়ে শ্রীঘরে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠি। সাইড টেবিলের ওপর থেকে পানিভর্তি গ্লাসটা তুলে নেই। ব্যাপারটা যখন ঘটে, শরীরের ভেতর রক্তের চাঞ্চল্য খুব বেড়ে যায়, আমার শরীর ঘামে আর পানি খেতে ইচ্ছে করে।
মিথিলা ওঠে না, শুয়ে শুয়ে বলে, আবদুল খালেক, তুমি আমার সঙ্গে আর আধঘণ্টা শুয়ে থাকোনা প্লিজ।
আমি মিনমিন করে বলি, তাহলে আবারও কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে যেতে পারে।
মিথিলা বলে, ঘটুকনা।
আমার পারঙ্গমতা নিয়ে মিথিলার মনে একটুও প্রশ্ন নেই। সেই আধঘণ্টা এক ঘণ্টা হয়ে যায়। মিথিলা বলে, আসলে সব পুরুষই কম বেশি হিউ হেফনার। তুমি পারোও।
মিথিলা শুয়ে শুয়ে আইএসসি সেকেন্ড ইয়ারের গল্প শোনায়। ক্লাসের ভয়ঙ্কর পাঁজি মেয়ে শুঁটকি আইরিন (ক্লাসে আর একটা ছিল মটকু আইরিন) সাদা আর্ট পেপারে মলাট করা একটি ম্যাগাজিন গোপনে পাতা উল্টে দেখার জন্য তার হাতে দেয়। ওহ্ মাই গড! প্লেবয়।
মিথিলা বলে, আবদুল খালেক, পাতা উল্টাই আর লজ্জা, ভয় এবং আরও কোনো একটা কারণে কাঁপতে থাকি। সে কারণটা কী বলো তো শুনি।
বিস্ময়!
হয়নি, শিহরণ।
আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে পরহেজগার উম্মে মাখদুমা ঘাড় ঘুরিয়ে একটুখানি দেখে বলে, ধ্যাৎ, লুকাবার কী আছে? এ তো ডালভাত!
শুনে মিথিলা বললো, কী বললি তুই, এটা ডালভাত?
উম্মে মাখদুমা সাহারা খানম বললো, নয়তো পোলাও-কোর্মা নাকি। তোর কি ধারণা, অ্যাডাম থ্রিপিস স্যুট আর ইভ মিরপুর জামদানিপল্লিতে তৈরি শাড়ি পরে বিছানায় শুয়েছেন?
মিথিলাদের ক্লাসে বিবাহিত ঘোষণা দিয়ে পড়াশোনা করতে আসা মেয়ে একটিই উম্মে মাখদুমা, বিয়ের ব্যাপারটা গোপণ করে অবিবাহিত সেজে ক্লাস করে যাচ্ছে অন্তত আরও দুজন।
ক্লাসে তখন অর্গানিক কেমিস্ট্রির আব্বাহুজুর স্যার ঢুকে পড়েছেন। প্লেবয়টা ততক্ষণে চালান করা হয়েছে নিশির ব্যাগে। নিশি এখন বিমানের ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস।
আব্বাহুজুর!
জি, আব্বাহুজুর। ফোরকানউল্লাহ স্যার মেয়েদেরও আব্বা ডাকতেন। ছেলেদের ডাকতেন হুজুর। প্রথম দিনই মিথিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, বলো তো আব্বা, মিথেনে কার্বনের ভূমিকা কী?
এসব গল্প শুনতে শুনতে আমি একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। মিথিলাও হাই তুলতে তুলতে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।
ব্যাপারটা ঘটলে সকালে খুব সহজে আমার ঘুম ভাঙতে চায় না। মিথিলা আমাকে আলতো করে একবার জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে উঠে পড়ে, ভোর সাড়ে পাঁচ কি পৌনে ছয়টায়।
মিথিলা দেখতে সুন্দর, পড়াশোনা খুবই ভালো, অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। ইউনির্ভাসিটির টিচার, একালের টিচারদের মতো দলবাজি করে নয়, নিজের মেধা ও যোগ্যতায়।
আমার জন্য মেধা ও যোগ্যতার চেয়েও বড় কথা ভালোবাসা। আমি জানি মিথিলা আমাকে ভালোবাসে।
অথচ খুব বড় একটি প্রতারণা তার সঙ্গেই করেছি। একসময় মনে হয়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারি অফিসারদের মতো খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আমার ছবিও ছাপা হবে: প্রতারক আবদুল খালেক।
ওই যে বলেছি আমার পৌরুষ, আমার সক্ষমতা, আমার পারঙ্গমতা—এসব নিয়ে মিথিলার সামান্য প্রশ্নও ছিল না। বরং দু-চারবার বলেছে, এই যে হিউ হেফনার ভাই, শান্ত হোন। এখন হবে না, আমার পিরিয়ডিক ব্যাপারটা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে।
যে কথাটি আমি মিথিলাকে বলিনি, তা হচ্ছে আমার সিমেন অ্যানালিসিস রিপোর্টের ফাইন্ডিংস। আমার অ্যাডাল্ট স্পার্ম বলতে গেলে নেই-ই। স্মার্মকাউন্টও কম।
তার মানে কী?
মানে খুব সহজ। বাচ্চা না হলে বউটা বন্ধ্যা, এমন কথা চালানো মুশকিল হবে। বউ স্মার্ট হলে ধরে ফেলবে সমস্যা আমারই। আমার দুর্বল-অসহায় স্পার্ম ওভারি থেকে ছুটে আসা জিমের সঙ্গে নিষিক্তকরণ করতে পারে না।
নিষিক্তকরণ!
মানে কী?
গর্ভবতীকরণ! ফার্টিলাইজেশন।
শেষ দিকে শাহানা আফরোজা কনক আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। বলেছিল, আমি না, তুমিই দায়ী।
শুরুতে অবশ্য শান্ত দয়ার্দ্র কণ্ঠে বলেছে, চলোনা, দুজনই ডাক্তারের কাছে যাই। সমস্যা যারই হোক নিশ্চয়ই চিকিৎসা থাকবে। চিন্তার কারণ নেই, খালেক, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি আমাদের দুজনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে এসেছি। স্পেশালিস্ট ডাক্তার। আমরা দুজনেই যাচ্ছি কিন্তু। শোনো কাল সিক্স থার্টি শার্প। আমাদের সিরিয়াল চার নম্বরে।
আমি সে রাতে বাড়ি ফিরি সাড়ে দশটায়। কনক আমার সঙ্গে কথা বলেনি।
হু কেয়ার্স? এমন একটা ভাব করে উল্টো দিক ফিরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।
কনক ব্যাংকার। সিনিয়র অফিসার শাহানা আফরোজা। খুব মিষ্টিস্বভাবের মেয়ে। কাস্টমারদের প্রিয় কনক আপা। ব্রাঞ্চ ম্যানেজারও তাকে খুব পছন্দ করেন।
কনক বললো, কোনো সমস্যা নেই। তোমার সুবিধেমতো একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিরিয়াল নিয়ে এসো, আমাকে সঙ্গে নিয়ো।
আমি বলি, ওয়েট করো, বাচ্চার জন্য এমন উতলা হয়ে গেছ কেন? বারো-চৌদ্দ বছর পরও তো হয়। অসুবিধে কী? তা ছাড়া সমস্যাটা যদি তোমার হয়, তখন কী হবে?
কেন তুমি আমার চিকিৎসা করাবে? দেশে না হলে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে যাবে, ওখানে ভালো ফার্টিলিটি সেন্টার আছে। ইন্ডিয়া পছন্দ না হলে সিঙ্গাপুর যাবে কিংবা ব্যাংকক।
আমার সক্ষমতার আনন্দ ও অহঙ্কার কমতে শুরু করে। আমি নিজেই ডাক্তারের কাছে যাই। দেশের সবচেয়ে ভালো প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে আমার সিমেন অ্যানালিসিস করা হয়। আমি ফল জেনে গেছি।
কনকের জন্য একটু কষ্টও পাই। আমাদের বিয়ের প্রথম রাতেই, খানিকটা বেহায়াপনার মতো শোনালেও কনক বলেছে, এই যে শুনুন, একটু ভালো করে শুনুন। আমি জানি বাবারা মেয়ে চায়। আমি কিন্তু ছেলেই চাই। এ বছরই। মিচকে শয়তান টাইপের একটা ছেলে।
আমি বলি, আচ্ছা।
কনক বলে, আচ্ছা মানে কিন্তু আচ্ছা। নো কন্ট্রাসেপটিভস। নো পিল, নো কনডম।
আমি বলি, আচ্ছা।
ফল জেনে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আমার পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি নেত্রকোনার মদন এলাকা থেকে তিন মাস বয়সী যে মেয়েটিকে নিজের মেয়ে হিসেবে লালন-পালন করব বলে নগদ পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে এক দুস্থ স্বামী পরিত্যক্ত নারীর কাছ থেকে তুলে আনি, সেই আমার, মানে আমাদের চন্দ্রা, চন্দ্রাবতী।
দামি তোয়ালেতে পেঁচিয়ে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে আসি। মাথা নিচু করে বলি, কনক, সমস্যাটা তো আমারই। সে জন্য মেয়েটাকে নিয়ে এলাম, মেয়েটা সুইট। একটু আদর-যত্ন পেলে দেখো দারুণ দেখাবে।
কনক বললো, সমস্যাটা যে তোমার এই সত্যটা স্বীকার করতে দশ বছর সময় নিলে! আমি তো সেকেন্ড ইয়ার থেকেই জানি আমার কোনো প্রবলেম নেই, ডাক্তার শামারুখ প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন আমার ফেলোপিয়ান টিউবে অ্যাডহেসন থাকতে পারে, পরে বললেন, ইটস ওকে, ইউ আর ফাইন। হাজব্যান্ডকে নিয়ে এসো।
কনক হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে একটা ফ্লাউয়ার ভাস তুলে আমার মাথা বরাবর ছুড়ে মারলো এবং চিৎকার করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, তুমি পারবে ফিরিয়ে দিতে আমার জীবনের দশটি বছর?
আমি মাথা সরিয়ে নেই। দেয়ালে লেগে ক্রিস্টাল ফুলদানি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে।
বুয়া চন্দ্রাকে সামলায়।
বুয়া জিজ্ঞেস করে, বাচ্চাটা হিন্দু নাকি? এমন নাম ক্যান?
আমি বলি, তিন মাসের বাচ্চার আবার হিন্দু-মুসলমান কী?
বুয়া বলে, বাচ্চার ডান হাতে আঙুল ছয়টা। ছয় আঙ্গুইল্যা মাইয়াছেলে। আরও খুঁত আছে, বাম চোখটা মনে হয় ট্যারা।
থাকুক খুঁত।
বুয়া বলে, ব্যাটাছেলের খুঁতে সমস্যা হয় না, মাইয়াছেলের খুব সমস্যা হয় বিয়াশাদির সময়।
চন্দ্রাবতীই মেয়েটির নাম কি না আমি জানি না, মায়ের নাম সূর্যবান, এ জন্য আমি বলেছিলাম, বেশ তো মেয়ে, তাহলে চন্দ্র, চন্দ্রাবতী।
আরও কিছু কথাবার্তা সেদিন শুনে এসেছি, কনককে এসব বলবো না তখনই ঠিক করি। চন্দ্রা যখন সাত দিনের মেয়ে, সূর্যর স্বামী নিজের দুহাত স্ত্রীর সামনে মেলে ধরে বললো, দ্যাখ হারামজাদি, আমার হাতে আঙুল কটা। বল, বেশ্যা মাগি, এটা কার বাচ্চা?
সূর্য অঝোরে কেঁদেছে। একসময় তাকে পিটিয়ে বাচ্চাসহ ভিটে থেকে বের করে দেয়। বলে, জাউরা মাইয়ার গুষ্টি কিলাই।
চন্দ্রাবতীর আগমন কনক স্বাগত জানায়নি। চেঁচিয়ে বলেছে, আমি নিজেরটা চাই, নিজের পেটের। তুমি একটা ভণ্ড, ঠকবাজ।
পরের তিন মাসে কনক আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে, রাত করে বাড়ি ফেরে। একদিন অনেক রাতে ফোন করে বললো, থানায় জিডি করতে যেয়ো না, আমি হারাইনি। তিন-চার দিন পর ফিরব।
জিজ্ঞেস করি, কনক, তুমি কোথায়?
জাহান্নামে।
তারপর ফোন কেটে দেয়।
শহানা আফরোজার উকিল আমাকে যে নোটিশ পাঠান তাতে মিথ্যে কিছু লেখেননি, সন্তান জন্মদানে ব্যর্থতার কথাই বলেছেন। যৌন-নিষ্ক্রিয়তা কিংবা নপুংসকতার কথা কিছু যোগ করেননি। তালাকের জন্য কারণটি যথেষ্ট।
সবসুদ্ধ তিন মাসে তালাক সুসম্পন্ন হলো। অভিযোগ তো আর মিথ্যে নয়। কনক কোনো ধরনের সিনক্রিয়েট না করে প্যানোরমা ফিশিংয়ের একটি কাভার্ডভ্যানে নিজের কেনা জিনিসপত্র—এলইডি টিভি, ডিপ ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, বেতের সোফা, বুকশেলফ—এসব ভরে ভালো থেকো, টেইক কেয়ার বলে পেছনের একটি জিপে দুটো স্যুটকেস তুলে নিয়ে চলে গেলো।
প্যানোরমা ডিপ সি ফিশিং অ্যান্ড ফিশ প্রসেসিংয়ের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাব্বির আহমেদকে বিয়ে করে কনক চট্টগ্রামেই স্থিত হবে, নিজের পেটে সন্তান ধারণ করবে, এমনই শুনেছি। চাকরি ছাড়তে হবে না, বদলির দরখাস্ত দিয়েছে, করিয়ে নিতে পারবে।
হইচই করে তো আর ব্যর্থতা ঢাকা যায় না। হইচইয়ে বরং আরও বেশি রটে যেতো: আবদুল খালেক পারে না। সে জন্যই তো বউ চলে গেছে। কনকের ছোট বোন মহুয়া করুণার দৃষ্টিতে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। বলবে, দুলাভাই, কথাটা কি সত্যি?
দুই.
ইউনিভার্সিটির টিচারকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস আমার কোনোকালেই ছিল না, আমি সুশিক্ষিত নই। ডিগ্রির কথা বাদই থাক, বইপত্র ধারকর্জ করে পড়েও অনেকে স্বশিক্ষিত হয়ে থাকে, কেউ কেউ ইউনিভার্সিটির টিচারদেরও ম্লান করে দেন, আমি সে ধারারও নই।
আমি তেল কোম্পানিতে চাকরি করি বলে টেলিভিশনের টকশোতে ডাক পেয়েছি এবারই। বিষয়টি ছিল বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি চল্লিশ ডলারের নিচে নেমে গেছে, বাংলাদেশে তেলের দাম কমছে না কেন? আমরা চারজন কথা বলে চলেছি আর তেলের বাজার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাহীন অ্যাংকর একবার ডানে একবার বামে ঘাড় ঘুরিয়েছেন। চেম্বারের প্রতিনিধি বললেন, রাবিশ, বাংলাদেশে সব রাবিশ। এ জন্য মন্ত্রী অ্যাকাউন্টিং বোঝেন, ইকোনমিকস বোঝেন না।
মিথিলা ফারাহ নাজ অনেক তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বললেন, তেলের দাম ছাপান্ন শতাংশ কমা দরকার। আমি তাকে সমর্থন করে বললাম, তাতে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়বে দশমিক সাত-ছয় ভাগ। গবেষণা সংস্থার প্রতিনিধি বললেন, অর্থ ব্যবস্থাপনাও একটি রাজনৈতিক বিষয়, এই দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের পালন করা উচিত, আমলাদের নয়—যত পাণ্ডিত্যই থাকুক তারা বরং সমস্যার অংশ, সমাধানের নয়।
মিথিলা ফারাহ নাজ এই বলে শেষ করলেন যে আমাদের এই টকশোর কোনো মানে নেই, আগে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ক্ষতি পূরণ হয়ে কিছু লাভ হোক, তারপর জনদাবি বিবেচনা করা হবে বলে সরকার জানিয়েছে। সে পর্যন্ত কি আমরা অপেক্ষা করতে পারি! তত দিনে পৃথিবী অনেক এগিয়ে যাবে। আর আমাদের মন্ত্রী রাবিশ রাবিশ বলে তসবিহ জপবেন?
এসবও দশ বছর আগের কথা। তবে শুরুটা টেলিভিশন স্টুডিওতেই।
মিথিলা জেনে গেছে আবদুল খালেকের বউ চলে গেছে।
কেন?
হাজব্যান্ডের নামটা এমন কেন? আবদুল খালেক বলতে লজ্জা পেতো?
তাই বলে চলে যাবে?
হয়তো আরও কিছু সমস্যা ছিল।
কনক পরে যাকে বিয়ে করবে ভেবেছিল সেই সাব্বির আহমেদ সম্ভবত বিট্রে করেছে। কয়েক বছর আগে যাকে বিয়ে করে, এখন স্টেটসে আছে, আটলান্টায়। দুজনই একটি চেইন শপে কাজ করে।
দ্যাটস গুড।
কিন্তু কনকের কপালটা খারাপ। হাজব্যান্ডের নামটা আবদুল খালেক ধাঁচেরই। কোব্বাদ আলী সমাদ্দার।
মিথিলা বলে, নাম কোনো বিষয় হলো? মানুষটা কেমন, সেটা বরং গুরুত্বপূর্ণ। কই, আবদুল খালেক শুনতে আমার তো খারাপ লাগে না।
আমি ভাবি, তাহলে আর বাধা কোথায়? এগোলেই পারি।
আমার মন মোর্স কোডে আমাকে সিগন্যাল পাঠায়: টরে টক্কা। এগোয়।
মিথিলাকে পিএইচডি ফেলে একেবারে গোড়ার দিকেই চলে আসতে হয়েছে। বৃত্তিটা ছিল কমনওয়েলথের, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির। কথা ছিল সাত মাসের মাথায় আশরাফ নেওয়াজ বাবুকে নিয়ে যাবে, তিন মাস থেকে ফিরে আসবে; কয়েক মাস পর আবার যাবে।
নেওয়াজ বাবুর দেখাশোনায় ফাঁকি দেয়নি। শান্তিনগরে টুইন টাওয়ার্সের একটি অ্যাপার্টমেন্টেই ওরা ছিল, নিজেই বাবুকে খাইয়েছি। বাবুর জন্য টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন নাকি মিস্টার বিন কি যেন চালিয়ে দিয়েছে। কেউ এসে নেওয়াজকে ডেকে নিয়ে গেছে না নিজেই বেরিয়ে গেছে তা কেউ বলতে পারল না। বুড়ি বুয়ার বয়স ষাটের কম হওয়ার কথা নয়, দেখায় আরও বেশি। ফজরের আগে ঘুম থেকে ওঠে, রাত দশটা বাজতেই কিচেনের মেঝেতে পাতলা তোশক ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে। নেওয়াজ তাকে খাটায় না, আদর করে ফুপু ডাকে, বাবুকে দিয়ে দাদু ডাকায়, গেস্টরুমটা তাকেই ছেড়ে দিয়েছিল, নেয়নি। বলেছে, আর পাঁচ-সাত বছর পর ঘুমাতে হবে মাটির নিচে, রুমের কী দরকার।
সে রাতে বাবু বিছানায় পেশাব করে। ভোরের দিকে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে এসে ফজরের নামাজের সিজদায় থাকা বুড়িটার ওপর চেপে বসে।
বাচ্চাটাকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে সালাম ফিরিয়ে বলে, মুতের গন্ধ পাই ক্যান? গেলো তো অজুটা!
বুড়ি বিছানার চাদর বদলায়, ধরে নেয় সাহেব নিশ্চয়ই আরও সকালে বেরিয়েছে। ঘরে খাবারদাবার যথেষ্ট আছে। জরুরি কোনো কাজে লাগতে পারে এমন সম্ভাবনায় এক শ টাকার পাঁচটা নোট বুড়ির হাতে মুনমুন দিয়েই রেখেছিল। গত আট মাসে এক টাকাও খরচ হয়নি। টাকাগুলো রান্নাঘরেই একটি খালি কৌটার ভেতর। বুড়ি পান-জর্দাও খায় না। খায় রুটি, কড়া গরম পানিতে দুই চিমটি চায়ের পাতা ছেড়ে দেয়, আয়েশ করে লম্বা সময় লাগিয়ে খায়। তার চাওয়া একটাই, হুট করে মরেটরে গেলে লাশটা যেন নেত্রকোনা পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আশরাফ নেওয়াজ সারা দিন ফেরেনি। বুড়ি বিড়বিড় করে, পোলা একখান, পাষাণের পাষাণ, জন্মের পাষাণ! মা একলা বিদেশ যায়, পোলা কান্দেও না, বাপ কই, সারা দিন খবর নাই, পোলা জিজ্ঞাসাও করে না। এগুলানই রোজ কেয়ামতের আলামত।
এ বাড়িতে ভেতর থেকে কোনো ছিটকিনি লাগানো হয় না। মিথিলা কিংবা নেওয়াজ এমনকি এই বুড়িও যার যার হাতের চাবি ঘুরিয়ে বের হয়। চাবি ঘুরিয়ে ঢোকে। কয়েক দিন পর বাবুকেও একটা চাবি দেওয়া হবে। বাবা-মায়ের ব্যাপারে নির্বিকার বাবু টম অ্যান্ড জেরি, মিস্টার বিন, গারফিল্ড, সিম্পসন—এসব পেলেই খুশি।
সে রাতটাও কেটে যায়। পরদিন খুব ভোরে যখন কলিং বেল বাজতে থাকে, বুড়ি কেবল নামাজ সেরে উঠেছে। পিপহোল দিয়ে দেখে মিথিলার ছোট বোন প্রিয়াংকা, সঙ্গে তার স্বামীও। দরজা খোলে।
দুলাভাই কোথায়?
কেমনে কমু?
মিথিলা দুই দিন ধরে দুলাভাইকে ফোনে ধরতে পারছে না। ফোন বন্ধ বলছে। ঘটনা কী?
বুড়ি আবার বলে কেমনে কমু? বাড়িতে আইলে তো।
প্রিয়াংকা হইচই ফেলে দেয়। থানা-পুলিশ-র্যাব সব মিলিয়ে বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি করে। প্রিয়াংকার ভাশুর র্যাবের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল মোবাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম কাজে লাগিয়ে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউঘেঁষা অসামাজিক কাজের জন্য কিছুটা কুখ্যাতি রয়েছে এমন একটি আবাসিক হোটেলে প্রথম রাতে সাড়ে বারোটার দিকে ফোনটা শেষবারের মতো বেজেছে, কথা হয়েছে তেত্রিশ সেকেন্ড। ও প্রান্তের কলারকেও ট্রেস করা গেছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির কনিষ্ঠ পুত্র জাভেদ ইকবাল, কিন্তু সেদিনই শেষরাতের কাতার এয়ারলাইনসের ঢাকা-দোহা-লন্ডন ফ্লাইটে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
মিথিলা ‘আমার বাবু আমার বাবু’ বলে কতক্ষণ কেঁদে আবার ফোনে প্রিয়াংকাকে জানাল, এখনই বুকিং দিচ্ছে, হাতে রিটার্ন টিকিট আছে, বাবুটাকে একটু দেখে রাখিস।
কিছুক্ষণ পরই জানালো, পরশু মধ্যরাতে পৌঁছাবে।
এয়ারক্রাফট টেইল উইন্ড পাওয়ায় কুড়ি মিনিট আগে টাচ ডাউন করল।
মিথিলা বাবুটাকে কোলে নিয়ে জাপটে ধরল, উচ্ছ্বাস প্রকাশের বদলে বাবু জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি আবার কবে যাবে?
মিথিলা জিজ্ঞেস করে, তোর বাবা কোথায়?
আমি তো মিস্টার বিন দেখছিলাম। বাবা বলেনি তো।
সেদিন রাতের ব্রেকিং নিউজ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছা এক্সপ্রেস ট্রেনে পরিত্যক্ত জোড়া ট্রাংকের ভেতরে ভারী পলিথিনে মোড়া দুটি লাশ। একটিতে একজন নারীর শরীরের কোমর থেকে নিম্নাংশ এবং একজন পুরুষের কোমর থেকে ঊর্ধ্বাংশ। অন্যটিতে নারীর শরীরের ঊর্ধ্বাংশ এবং পুরুষের নিম্নাংশ। ভিকটিম পুরুষ নেওয়াজ গার্মেন্টস-এর মালিক আশরাফ নেওয়াজ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, ভিকটিম নারীর কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।
পুরো ব্যাপারটা মিথিলার জন্য যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে বেশি বিব্রতকর হয়ে উঠলো। প্রিয়াংকাও জিজ্ঞেস করলো, কিরে আপু, মেয়েটিকে চিনতে পেরেছিস নাকি?
আশরাফের নেওয়াজের সঙ্গে একজন মন্ত্রীর তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের সঙ্গে বাড়াবাড়ি রকমের সম্পর্কের খবরও ছাপা হয়। মিথিলা দ্রুত নেওয়াজের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
বাবুর জন্য একটি নিরাপদ জীবন তার চাই-ই। কোনো তদবির না থাকায় আশরাফ নেওয়াজের মামলাটি নিষ্প্রভ হতে হতে একসময় কার্পেটের তলায় চলে যায়। মেয়েটি কমার্শিয়াল সেক্স ওয়ার্কার, নেওয়াজকে কবজায় আনার জন্য তাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। খুনের সাক্ষী রাখতে নেই হয়তো সেই সূত্র অনুসরণ করেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
মিথিলা একবার ভেবেছে বাবুকে নিয়ে কালই শেফিল্ড চলে যাবে। পরক্ষণেই মনে হয়েছে চাইল্ড মাইন্ডারের কাছে বাবুকে রেখে সে স্বস্তি পাবে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিথিলা বলল, বুঝলেন আবদুল খালেক সাহেব, আমি আর ফিরে যাইনি। বছরের বাকি সময়টা ঘর বন্ধ করে বাবুকে নিয়েই কাটিয়েছি। আমার পিএইচডি আর করা হয়নি। বাবু করবে। ডক্টর নেওয়াজ আদনান। আমার ডিগ্রি দিয়ে কী হবে! একটাই তো জীবন।
আমরা বিয়ের আলাপ করি। মিথিলাদের অবস্থা এমনিতে ভালো। নেওয়াজের অ্যাপার্টমেন্ট এবং অন্তত দশ কোটি টাকার সম্পদের মালিকানা নেওয়াজ আদনান বাবু এবং মিথিলার। তখন আমিও ভালোই কামাই-রোজগার করি। মিথিলা বলেছে, দেখুন আবদুল খালেক, আপনি কোনো মোহ কিংবা হঠাৎ ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিয়ে আমার কথায় বিয়েতে রাজি হবেন না। বিয়েতে শরীর ও মন দুটোকে রাজি করাতে হয়।
আমি বললাম, ম্যাডাম, আপনি উচ্চশিক্ষিত মানুষ। সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আমি পরীক্ষা টেনেটুনে পাস করার জন্য যেটুকু পড়াশোনা করতে হয় তার বাইরে দুই লাইনও পড়িনি। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, বাবু আমার ছেলে হয়েই থাকবে, আপনি আমার চন্দ্রাবতীকে দেখবেন। চন্দ্রার আমি ছাড়া আর কেউ নেই। একটা কথা বলে রাখতে চাই চন্দ্রার ডান হাতে কিন্তু ছয়টা আঙুল।
মিথিলা বলল, আমার বাম ব্রেস্টে একটা লাম্প আছে, এখনো বিনাইন। কিন্তু বলা তো যায় না। আপনাকে এটাও জানিয়ে রাখতে চাই। আপনি কি আমাকে কিছু জানাতে চান?
জি, ফিজিক্যাল ব্যাপারটা ঘটলে আমার খুব লম্বা একটা ঘুমের দরকার হয়।
বাহ্, ঘুমানো তো স্বাস্থ্যকর ব্যাপার, ঘুমাবেন।
কিন্তু আমি সিমেন অ্যানালিসিস রিপোর্টের কথা মিথিলার কাছে কেবল গোপনই করিনি, বাড়ি ফিরে রিপোর্টটা আগুনে পুড়িয়েছি। আমাদের দাম্পত্যজীবনের দ্বিতীয় বছর শুরুর আগেই মিথিলা বললো, আবদুল খালেক, তুমি তো বিছানায় দারুন পারফরমার। আমাদের একটা বাচ্চা নিলে হতোনা! আমার চেহারায় তখন আষাঢ়ে মেঘের ছায়া পড়ার কথা। কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, আমিও তো তাই চাচ্ছিলাম। কিন্তু ইউনিভার্সিটির টিচারকে কথাটা কেমন করে বলি যে এখন থেকে নো পিলস নো কনডম, নো কন্ট্রাসেপটিভস অ্যাট অল। কয়েক মাস পরপর মিথিলা বলে যায়, কী হলো, আমি কনসিভ করতে পারছি না যে। নাকি বয়স বেশি হয়ে গেছে।
আমি বলি, জাস্ট ওয়েট, আমার ছোট ফুপুর তো চুয়াল্লিশ না পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে বাচ্চা হলো।
তিন.
আমার আর মিথিলার মানে আমাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের নাম নেওয়াজ আদনান বাবু, চে গুয়েভারার মতো দাড়ি রেখেছে। বয়স উনিশ বছর। জন্ম তারিখ ২৮ অক্টোবর। আমার প্রিয় নায়িকা জুলিয়া রবার্টসের জন্মও সেদিন। আমাদের মেয়ে চন্দ্রাবতী জাস্ট থার্টিন। ২৩ জুন তেরো হয়েছে। আসলে চন্দ্রার জন্মতারিখ জানার কোনো উপায় নেই। তেরো বছর আগে ২৩ জুন আমি চন্দ্রাকে মদন থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। তখন তার বয়স কমবেশি তিন মাস—এটা বোনাস।
মিথিলা বলল, ধরে দেখো আমার ডান ব্রেস্টের একটা লাম্প। ম্যালিগন্যান্ট হলে কিন্তু সর্বনাশ! শরীরের কত যে কমপ্লিকেসি! এসব কারণেই হয়তো কনসিভ করতে পারলাম না।
আমি বললাম, মিথিলা, আমাদের তো বাবু আর চন্দ্রা আছেই।
মিথিলা বললো, কোথাও ব্ল্যাক বিউটি কনটেস্ট হলে চন্দ্রাকে পাঠাব। একটা না একটা ক্রাউন পাবেই।
মিথিলা কিচেনেই জোরে জোরে চন্দ্রাকে পড়ে শোনাচ্ছে: খাসির মাংস দুই কেজি, চিনিগুঁড়া চাল এক কেজি, ঘি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ, জায়ফল, জয়ত্রী, জিরা, শুকনো মরিচ, দই, গোলাপ জল, কেওড়া জল, আলু বোখারা, আটা, লবণ, হলুদ—এতে আট-দশজনের হয়ে যাবে। ২৩ জুন চন্দ্রাবতীর জন্মদিনে মিথিলা কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করলো, ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক আনলো, চন্দ্রাকে একটা ল্যাপটপ প্রেজেন্ট করলো। বাবুকে বললো, ছয়টার মধ্যে ঘরে ফিরবি।
চন্দ্রাও বললো, মনে রাখিস কিন্তু।
আমারই ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। মিথিলার বায়োপসি রিপোর্ট নিয়ে এসেছি, দুটোই ম্যালিগন্যান্ট।
মিথিলা জিজ্ঞেস করে, রিপোর্টে কী এসেছে?
কাল দেবে, স্পেশালিস্ট ডাক্তার আসেননি।
চন্দ্রার জন্যই আমি অবলীলায় এই মিথ্যেটা বললাম। আগে কেক আর কাচ্চি হোক, পরে বলা যাবে।
বাবু আসেনি। আগেও কবার এমন করেছে। টানা তিন দিনও নিরুদ্দেশ থেকেছে। চন্দ্রাবতী কেক কেটেছে, মিথিলা হ্যাপি বার্থ ডে গেয়েছে, আমি তালি দিয়েছি। চন্দ্র বলল, আমি শয়তানটার জন্য সারা রাত জেগে থাকব, যখন আসবে বাকি কেক ওর মুখে মাখিয়ে দেব।
২৪, ২৫, ২৬ করতে করতে ৩০ জুন চলে এলো। বাবু নেই, জিডি করিয়েছি। ৩০ জুন বিকেলের দিকে নম্বর লুকোনো কোনো ফোন থেকে মিথিলাকে কল করে বলেছে, মা চিন্তা কোরো না। চলে আসব।
১ জুলাই তরুণ জঙ্গিদের দখল করে নেওয়া একটি রেস্তোরাঁয় সরকারের বাহিনী যখন পাল্টা আক্রমণ চালায়, ওদের সবাই নিহত হয়।
মিথিলা বলে, এদের মধ্যে বাবু নেই তো?
বাবু থাকবে কোত্থেকে? সবারই তো নামধাম, ছবি সব কাগজে বেরিয়েছে। শনাক্ত করা যায়নি কেবল একজনকে।
মিথিলা বলল, আবদুল খালেক, তুমি একটু যাওনা প্লিজ।
মিথিলাকে বাইরে একটি ভাঙা সিঁড়িতে বসিয়ে রেখে আমি মর্গে গিয়েছি, গুলিতে চেহারা ও শরীরটা এমনই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে যে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু রক্তাক্ত শার্টটা তো আমারই কেনা, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আমরা একই রঙ এবং ডিজাইনের দুটো শার্ট কিনেছি। বাবু সেটা পরেই তো বেরিয়েছিল। এ তো সেই শার্ট আমি জানি। আমি চিনতে পেরেছি, এটাই আমাদের বাবু।
কিন্তু লাশের কাছ থেকে বেরিয়ে আমি স্পষ্টভাবে বলেছি, না, আমি দেখেছি, আমাদের বাবু নয়।
মিথিলা বলল, ভালো করে এপিঠ-ওপিঠ করে দেখেছ তো?
কী যে বলো, বাবুর জন্য এপিঠ-ওপিঠ করতে হবে কেন? আমাদের ছেলে না?
মিথিলা বললো, আচ্ছা। এবার ফিরুক, হয় অন্য কোনো দেশে পাঠিয়ে দেবে, নয় হাত-পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবে। এত বড় একটা ছেলের ভার আর আমি নিতে পারছি না।
চন্দ্রা বাবুর রুম থেকে তার আঁকা একটি অসমাপ্ত পোর্ট্রেট নিয়ে আসে। মুখের কিছু কাজ বাকি কিন্তু ছবির নাম পুরোই লিখেছে। পোর্ট্রেট অব মাই সুইট সিস্টার অন হার থার্টিন্থ বার্থ ডে।
মিথিলা বলল, শয়তানটা তো ভালো ছবিই আঁকে। আমার একটা পোর্ট্রেট করে দিতে বলোতো।
আমি মিথিলাকে রিপোর্টটা পড়ে শোনাই।
মুনমুন বলে, তাহলে আমি আর বেশি দিন নেই।
ধ্যাৎ, এটা তো কমন ব্রেস্ট প্রবলেম, ক’টা কেমোথেরাপি আর ডজনখানেক রেডিয়েশন। প্রবলেম সলভড।
সত্যি!
হ্যাঁ, আমাদের নায়িকা তুশকার হয়েছিল না। কটা কেমো আর রেডিয়েশনের পর দেখলে না আবার শুটিং শুরু করেছে।
সত্যি!
অবশ্যই সত্যি।
আমি মিথিলার জন্য আরও একটি প্রতারণার জাল বুনি। বলি, মিথিলা তুমি কাউকে বোলো না, বাবু কিন্তু ওদের গ্রুপেই ছিল, কিন্তু সেদিন ওর ভীষণ মাথাব্যথা থাকায় ওকে অপারেশনে নেয়নি।
বাবু মাথাব্যথাটা আমার কাছ থেকে পেয়েছে। জন্মসূত্রে পাওয়া রোগ। ভাগ্যিস বাবুর মাথাটা ধরেছিল। কিন্তু তুমি জানলে কেমন করে?
একটা আননোন নম্বর থেকে আমাকে ফোন করে বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবা, মা ঠিক আছে তো?
মিথিলার চোখেমুখে আলোর প্রদ্যোতন। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, তুমি ওর গলা বুঝতে পেরেছ তো?
এক শ বার।
তুমি কী বলেছ?
আমি বলেছি, তোর কান ছিঁড়ে ফেলব, শয়তান।
মুনমুন বললো, আবদুল খালেক আবার ফোন করলে আরও কড়া কথা শোনাবে, কেমন?
সারাবাংলা/পিএম