র্যাগিং
২৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৬:৪৬
সিন্ডিকেটের সভা চলছে। জরুরি সভা। জঙ্গলগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এই সভা ডেকেছেন। সভার একমাত্র এজেন্ডা, র্যাগিং। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা এটি। র্যাগিং সমস্যা কোন প্রক্রিয়ায় বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা উদ্বিগ্ন।
সভায় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আক্কাছ মিয়া বলেন, ‘এই এলাকাটি একদা জঙ্গলাকীর্ণ ছিল বলে নামকরণ করা হয় জঙ্গলগঞ্জ। জায়গাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মতে, যদি বই পড়তে হয়, তবে এই তার স্থান। তৎকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনে হয়েছিল এই স্থানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা গেলে শিক্ষার্থীরা সবুজ-শ্যামল পরিবেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি প্রকৃতির মতো নিঃস্বার্থ ও ভালো মানুষ হবে। তাই এলাকার নামের সঙ্গে মিলিয়ে এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হয় জঙ্গলগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়।’
ড. আক্কাছ মিয়ার কথা শেষ হলে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার বক্তব্য শুরু করেন, ‘ভাবা হয় এক, হয় আরেক। জঙ্গলের সংস্পর্শে এসে কোনো কোনো শিক্ষার্থীর ভেতরে লুঙ্গিয়ে থাকা জঙ্গলের আচরণগুলো আড়মোরা দিয়ে ওঠে। তারা সুবোধ শিক্ষার্থী হওয়ার বদলে হয়ে ওঠে জন্তু-জানোয়ার। আর জানোয়ার ছাত্রদের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই এই বখাটে দলের হাতে কেউ না কেউ র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে। এ পর্যন্ত র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ছয়জন বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন, একজন চোখ হারিয়েছেন আর দুইজন হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য। ক্যাম্পাসে যেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে’।
ভিসি-প্রক্টর আর কয়েকজন রাজনীতিবিদ কাম শিক্ষক ছাড়া সবাই ড. আক্কাছ মিয়ার কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেন, ‘অবশ্যই র্যাগিং করতে হবে।’
ক্যাম্পাসের র্যাগিং সমস্যা অনেক পুরোনো। প্রায়ই ঘটছে। কিন্তু গতকাল পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে। ভিসির দায়িত্ব নয়, ওপরের নির্দেশ পালনের জন্য সিন্ডিকেটের এই সভা।
বখাটেদের দ্বারা প্রথম বর্ষের পঁচিশজন ছাত্র র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন। এই খবর প্রভাবশালী দৈনিকে ছাপা হওয়ায় ওপরমহল, নিচের মহল এবং সমতল মহলসহ সবাই নড়েচড়ে বসেছেন। ওপর নড়েছে তাই ননষ্টপ নড়ছে ভিসির চেয়ার। ভিসি তার নড়বড়ে চেয়ার স্থির করতে বেশ তৎপর। ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলার দায়িত্ব যেহেতু প্রক্টরের, তাই সভার মধ্যেই তিনি প্রক্টরকে জেরা শুরু করেন।
বিশ্বদ্যিালয়ে যা ঘটে, তা পত্রিকায় যায় কী করে, আপনি আছেন কী জন্য?
জি স্যার, অঘটন ঘটা সমস্যা না। তবে তা পত্রিকায় রিপোর্ট হওয়া সমস্যা।
এই তো ঠিক আছে, যা হবে ক্যাম্পাসের মধ্যে হবে, বখাটেরা অঘটন ঘটাবে আবার তারাই মিটমাট করবে। কিন্তু আমাদের প্রিয় বখাটের দল করল কী? র্যাগিংয়ের খবর পত্রিকায় গেলো কীভাবে? শুনুন, পত্রিকায় এভাবে খবর উঠতে থাকলে আপনার আমার পদ কি আর থাকবে? মনে রাখবেন, পদ আছে বলেই আলিশান বাংলো, গাড়ি, সুযোগসুবিধা, পাইকপেয়াদা সব।
বাড়ি-গাড়ির বিষয়টি সামনে আসার পর প্রক্টর যেন চুপসে গেলেন। তিনি ভিসিকে বললেন, ‘স্যার, বিষয়টি আমি দেখছি।’
‘আচ্ছা, দ্যাখেন’ বলে সভায় উপস্থিত সবর উদ্দেশে ভিসি বলেন, ‘প্রক্টর সাহেব যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছেন, আমরা কিছুদিন অপেক্ষা করি। কী বলেন?’
সর্বসম্মতিক্রমে সভার কার্যক্রম মুলতবি ঘোষণা হয়।
প্রক্টর নামে শিক্ষক হলেও ফুলটাইম রাজনীতিবিদ। তিনি কৌশল আঁটলেন। ভুক্তভোগী ছাত্র, বখাটের দল ও মিডিয়াকর্মীদের ডাকলেন। একসঙ্গে একই স্থানে।
‘কী হয়েছে, বলো। সব খোলাখুলি বলবে। একদম ভয় পাবে না।’ বলে প্রক্টর বখাটের দলকে লক্ষ করে ইশারা করেন। বখাটের দল সক্রিয় হয়ে ওঠে, ‘হ্যাঁ বলো, কে র্যাগিং করেছে?’
হলে-ক্যাম্পাসে থাকতে হলে ভূক্তভোগীরা সামনাসামনি কথা বলতে পারবে না, এটা প্রক্টর জানেন, বখাটেরাও জানে। জানে র্যাগিংয়ের শিকার সাধারণ ছাত্ররাও।
‘না স্যার, কিছু হয়নি।’ একে একে সব ভুক্তভোগীর একই প্রতিক্রিয়া।
‘তাহলে পত্রিকায় এসেছে কেন?’ প্রক্টর বললেন।
‘স্যার, সেটা পত্রিকার লোক বলতে পারবে, তারা কোথায় এ তথ্য পেয়েছে?’
কুচক্রীর দল এবার সক্রিয় হয়ে ওঠে, ‘স্যার, সব দোষ মিডিয়ার, কাজেই এই মুহুর্তের জরুরি কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিকে ঠ্যাঙানি দেওয়া। কী বলেন স্যার?’
প্রক্টর সাহেব প্রফেসর মানুষ। তার মাথা ঠাণ্ডা। অবশ্য ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ছাড়া প্রক্টর নামক পদে থাকাও যায় না। তিনি মিডিয়াকর্মীদের উদ্দেশে বললেন, ‘দেখলেন তো, ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
বখাটেরা বললো, ‘স্যার, মিডিয়ায় একটা প্রতিবাদলিপি পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’
‘তোমরা যা বলবে তাই হবে। হল-ক্যাম্পাস দেখভালোর জন্য তোমাদেরই তো দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। হলে কে উঠবে, কে কোন কক্ষে থাকবে, সবই তোমাদের দায়িত্ব।’ প্রক্টর মুখে এসব বলেন, আর মনে মনে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের নায়ক তোমরা। তোমরা নতুন ছাত্রদের র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন করো, ছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করো। আবার তোমরাই সেগুলো যেন ভিসি-প্রক্টর পর্যন্ত না গড়ায়, তার ব্যবস্থাও করো, সবাইকে শাসিয়ে রাখো। এমনকি তোমরা সমর্থন দাও বলেই আমরা পদে থাকতে পারছি।’
জনৈক বখাটে নেতা বলেন, ‘কিন্তু স্যার, সাংবাদিক হালাগো জন্য তো পারি না। ওদেরকে…।’
‘সাংবাদিক ইস্যুটা আপাতত বাদ দাও।’ প্রক্টর বলেন। আর মনে মনে তিনি বলেন, ‘শুধু এই জায়গাটিতেই আমরা ধরা।’
বখাটের দল উল্লাস করে প্রক্টরের অফিস ত্যাগ করে। ভুক্তভোগীরাও চলে যায়।
বিকেলে প্রক্টর সাহেব ভিসির সঙ্গে দেখা করেন। প্রক্টর বেশ ফুরফুরে।
‘স্যার, বুদ্ধি থাকলে কোনো সমস্যাই সমস্যা না।’
‘কীভাবে?’ ভিসি অবাক হন।
অভিযোগকারী আর অভিযুক্তদের একসঙ্গে ডেকেছি। অভিযোগকারীরা ভয়ে কথাই বলতে পারেনি। কেমন হলো স্য্যার?’
‘দারুণ। দারুণ। এই জন্যই তো শিক্ষদেরও রাজনীতি জানতে হয়। রাজনীতি না করলে এসব পদ-পজিশন এমনিই মেলে? মেলে না। এই দেখুন, ড. আমজাদ সারাদিন লাইব্রেরিতে পরে থাকেন, বই পড়েন, গবেষণাপত্র লেখেন, তাকে কয়জনে চেনে? নাকি তাকে ভিসি পদ দেওয়া হয়েছে? হয়নি। এই জাতীয় প্রফেসরদের এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিপদ দেওয়া হয় না। পদ পেতে হলে চালাকি জানতে হয়, তেল দিতে জানতে হয়।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ভিসি জানতে চান, ‘আচ্ছা, কী নিয়ে যেন আলাপ হচ্ছিল?’
‘স্যার, র্যাগিং নিয়ে।’
‘ভিসি পদে বসার পর গত চার বছরের অন্তুত পঞ্চাশ বার ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের খবর শুনেছি। কিন্তু এই বিষয়টা কী? আমাকে একটু খোলাসা করে বলেন তো।’
ভিসির আহাম্মকিতে ক্ষুদ্ধ প্রক্টরের ইচ্ছে হচ্ছিল তার পাছায় একটা লাথি দিয়ে বলেন, বিশাল বাগানবাড়িসহ আলিশান বাংলোতে আরামে ঘুমাও আর সব সুবিধা ভোগ করো, অথচ র্যাগিং বোঝো না। কিন্তু প্রক্টর সেদিকে গেলেন না। তিনি ভিসিকে র্যাগিংয়ের বিষয়টা বোঝানোয় মনোযোগ দিলেন।
‘তাই নাকি? তাই নাকি?’ ভিসি আগ্রহ বোধ করলেন, ‘আচ্ছা, হলগুলোতে কি প্রায় রাতেই এ ঘটনা ঘটে?’
‘জ্বি স্যার, প্রায় প্রতিরাতেই ঘটে।’
‘আচ্ছা, আমি একদিন সচক্ষে দেখতে চাই যে, কেমন করে র্যাগিং হয়?’
ভিসির আবদার বলে কথা। প্রক্টর মহোদয় একদিন রাতে ভিসিকে নিয়ে গেলেন র্যাগিং দেখাতে। রাত প্রায় বারোটা। তারা দুজন আবুল কাসেম হলের পেছনে ওঁৎ পেতেছেন সচক্ষে র্যাগিং দেখার জন্য। প্রক্টরের পরামর্শমতো তাদের বস্ত্র বলতে লুঙ্গি, গেঞ্জি আর গলায় গামছা। চারদিকে সুনসান নীরবতা।
ভিসি সাহেব বুড়ো মানুষ। তার কাশির সমস্যা আছে। রাতের আধারে জঙ্গলে ঢুকে তার প্রচণ্ড কাশি উঠলো। তিনি কাশতে শুরু করলেন। হলে প্রায়ই ছাত্রদের লুঙ্গি-গামছা চুরি যায়। রাতে জঙ্গলে কাশি শুনে ছাত্ররা ভাবলো লুঙ্গি চোর এসেছে। তারা সবাই ‘লুঙ্গি চোর, লুঙ্গি চোর’ বলে লাঠিসোঁঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ভিসি আর প্রক্টরের ওপর।
ভিসি বুড়ো মানুষ দৌড়াতে পারেন না। ধরা পড়লেন হাতেনাতে। প্রক্টর বললেন, ‘আমি প্রক্টর আর উনি আমাদের ভিসি স্যার।’
‘নিজেদের ভিসি-প্রক্টর দাবি করে! শালারা শুধু লুঙ্গি চোর নয়, এদের মাথাও খারাপ আছে দেখছি।’ এক ছাত্র বলে।
ভিসি প্রক্টর সাধারণ ছাত্রদের খোঁজ-খবর নেয় না বলে তারা ভিসি-প্রক্টরকে সেভাবে চেনেও না। চেনে বখাটেরা। তবে টাকা-পয়সার গন্ধ নেই বলে লুঙ্গিচোর ধরাপড়ার খবর বখাটেদের টানে না।
আরেকজন বলে, ‘দে, শালাদের প্যাদানি দে।’
সদ্য লুঙ্গি হারানো এক ছাত্র বলে, ‘চোরের সাত দিন আর গৃস্থের একদিন। দে আমার লুঙ্গি দে।’
বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের তোপের মুখে ভিসি-প্রক্টর একে একে গেঞ্জি, গামছা ও লুঙ্গি ছাত্রদের কাছে হস্তান্তর করে।
এবার লুঙ্গিচোরের উৎপাতে অতিষ্ঠ ছাত্ররা সমস্বরে বলে, ‘চোরদের মাথায় নর্দমার পানি ঢাল।’ ভিসি-প্রক্টর ‘না না’ বলে থামানোর চেষ্টা করে। এবার ছাত্রদের গর্জন শোনা যায়, ‘হয় নর্দমার পানিতে গোসল করবি নয়তো পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেব।’
দুজন পরস্পরের দিকে তাকায় অর্থাৎ হাত-পা খোয়ানোর চেয়ে নর্দমার পানি ভালো। ভিসি-প্রক্টরের গায়ে নর্দমা থেকে কয়েক বালতি ময়লা পানি এনে ঢালা হয়। বিবস্ত্র ভিসি-প্রক্টর কোনোমতে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নেন। সারা শরীরের নর্দমার দুর্গন্ধ। ভিসি সাহেব শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও অপমানিত। ভিসি দায়িত্বশীল পদ, এই দূরবস্থার মধ্যেই হঠাৎ ভিসি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন। তিনি প্রক্টরকে বলেন, ‘আমরা যে র্যাংগিং দেখতে এলাম, তা তো দেখা হলো না।’
‘দেখা হয়ে গেছে, স্যার’
‘কোথায়, কীভাবে?’
‘র্যাগিংয়ে এসবই করা হয়!’
‘কোন সব?’
‘আমাদের সঙ্গে যা করা হয়েছে, এগুলো!’
ভিসি আঁৎকে ওঠে বলেন, অ্যাঁ।’
প্রক্টর বলেন, ‘অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ।’