প্রাণে মিললো প্রাণ, খুললো প্রাণের দ্বার
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৯:২১
মাকসুদা আজীজ
বইমেলা আসলেই বাংলাদেশের মানুষের প্রাণ জেগে উঠে নব উল্লাসে। শুধু বই কেনা নয়, বই কেনাকে উপলক্ষ করে সমগ্র মাস জুড়েই চলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে উৎযাপন যার শুরু হয় বইমেলার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।
আমাদের এই ভাষা উৎযাপনের যে সৌভাগ্য সে সৌভাগ্য জুটেনি পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মানুষেরই তেমনি একজন লেখক ড. জয়েস অ্যাসউন টেনটেন। ক্যামেরুনের এই লেখক এসেছেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় যোগ দিতে।
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় তিনি বলেন, আমি তোমাদের দেশে এসে আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছি। আমি তোমাদের শহীদ মিনারে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে আমি আমার জন্য কেঁদেছি। আমার দেশের মানুষদের জন্য কেঁদেছি। তোমরা নিজেদের ভাষা নিয়ে যে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছ, আমরা সেটা পারিনি।
এই লেখক বর্তমানে আমেরিকায় প্রবাস জীবন যাপন করছেন, সেখানে তিনি একটি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন। রবীন্দ্রনাথের লাইন, উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই দিয়ে শুরু করেন তার বক্তব্য। উপস্থিত দর্শক ভিনদেশীর দরাজ গলায় এই লাইন শুনে আনন্দের ধ্বনিতে মুখর করে তুলেন বাংলা একাডেমির প্রান্তর।
এই সাহিত্যিক, শিক্ষক একজন দক্ষ লাইব্রেরিয়ানও। তিনি জোর দেন আদিবাসীদের ভাষাতেও বই প্রকাশের বিষয়ে জোর দেন। জোর দেন সেগুলো ভাষান্তর করে চিন্তাগুলোকে অন্য ভাষার মানুষদের মনে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে। সব শেষে তিনি আবেগী গলায় নিজ ভাষায় স্মরণ করেন তার ভাষার মানুষদের যারা দেশের জন্য দিয়েছে প্রাণ।
বর্ধমান হাউজের সামনে শীতের অপরাহ্ণে নরম আলো আর পাখিদের কলকাকলির সাথে সুললিত কণ্ঠে কথা শুরু করেন যুক্তরাজ্যের লেখক এগনিস মিডোসম। তার ভাষণটাই যেন ছিল একটি কবিতা। তিনি শব্দ আর ছন্দের মিল রেখে তিনি বাংলাদেশের মানুষদের বলেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
মিডোসম বলেন, আপনারা যা জানেন আমি তা জানি না। আমার বাড়ি পুড়ে নাই, ১৯৭১ সালে আপনারা যে পরিস্থিতিতে ছিলেন আমি তা জানি না। আপনারা আমাকে বদলে দিয়েছেন, আপনারা আমাকে একটা গিফট দিয়েছেন যা আমাকে বদলে দিয়েছে, এটি হচ্ছে একটি শিক্ষা। আপনারা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে ছাই থেকে মাথা তুলে দাড়াতে হয়। নিজের সবচেয়ে ভালোতে পৌঁছাতে হয়, কীভাবে আরও শক্তিশালী, ঋদ্ধ ও সুউচ্চ হতে হয়। আপনারা আমাকে যে জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছেন তা আমি আমার লোকেদের দিবো।
আপনারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে শিক্ষা দিয়েছেন তা আমি লোকেদের বলব। আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত আমরা একজন শরণার্থীকে সহ্য করতে পারি না আর তমরা এত মানুষকে জায়গা দিয়েছ। আমি এ শিক্ষা আমার লোকেদের দিবো।
প্রাণের বই মেলায় প্রাণ বিলিন করতে এসেছিলেন মিশরীয় লেখক ও সাংবাদিক ইব্রাহীম এলমাসরি।
এলমাসরি তার বক্তব্য শুরু করেন অতুল প্রসাদের বিখ্যাত গান, মোদের গরব মোদের আশা আমরই বাংলা ভাষা লাইনদুটি আবৃত্তি করে। পড়ন্ত বেলায় তার আরবি উচ্চারণে ভাঙ্গা বাংলায় আবৃত্তিও ঠিক মিশে যাচ্ছিলো প্রাণের ঐক্যতানে।
রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের মানুষের প্রশংসা করে তিনি বলেন, সাংবাদিক হিসেবে আমি জানি বাংলাদেশের মানুষ কেমন। আমি জানি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ কত ভালো ব্যবহার করেছে। আমি তোমাদের ধন্যবাদ দিতে চাই।
শুধু বইয়ের জন্য মেলা আয়োজনে অভিভূত এলমারিস বলেন, বই মানুষের প্রিয় বন্ধু। কুরআনেও বলা হয়েছে পড় পড় পড়।
বাংলাদেশের মানুষের অতিথিয়তার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি খুব খুশি যে আমি এখানে আসতে পেরেছি। এটা আমার ঢাকার প্রথম সফর। অনেকেই আমাকে অনুভূতি জানতে চেয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমি আমার পরিবারে আমার দেশে আমার মানুষের মধ্যে আছি।
সবার পরে মঞ্চে উঠেন সুইডিশ কবি অর্নি জনসন, ১১ বছর আগে আরও একবার ঢাকায় আসা এই কবি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনী বই সম্পর্কে জানি। আমরা তোমাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানি আমরা তোমাদের ইতিহাসের সাথে আমরাও জড়িয়ে আছি। তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমরাও তোমাদের পাশে ছিলাম।
সুইডিশ রাইটিং ইউনিয়নের দূত এ ইউনিয়নের কার্যক্রম সম্পর্কে জানিয়ে বলেন, পড়ার অভ্যাস খুব জরুরি। পঠন চিন্তার উদ্দীপনা জাগায়, নতুন কিছু ভাবার, নতুন স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা তৈরি করে। তাই নতুন কিছু তৈরি করতে বই পড়া খুব জরুরি।
জনসন আরও বলেন, আমরা তোমাদের সাথে সাহিত্য চুক্তি করতে চাই। তোমাদের সাথে ভাবের বিনিময় করতে চাই যেন আমরা সকলে মিলে একটা সুন্দর পৃথিবী তৈরি করতে পারি।
কথায় কথায় বিকাল নামে, শুরু হয় বইমেলার মূল আনুষ্ঠানিকতা। বাংলা একাডেমির সামনে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায় ভিনদেশীদের এই প্রাণের শব্দ। ভাষার ব্যবধান সেই প্রাণের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে না। বরং বই মেলার দুয়ার খুলে সে প্রাণ ছড়িয়ে যায় আরও বহুদূর। এই প্রাণের মিলন নতুন কিছু করার, এমন মিলনই এই পৃথিবীকে সুন্দর করে।
সারাবাংলা/এমএ