হুমায়ূন আহমেদের ক্রীড়ানুরাগ
১৮ জুলাই ২০১৯ ১৬:৩৩
[অসাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর একটি বই ‘ফাউন্টেন পেন’ উৎসর্গ করেছিলেন ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে। আমার বন্ধু হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিন ১৯ জুলাই। তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। ১৯৯৯ সালের ইংল্যান্ড ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্মৃতি মনে পড়ছে। দৈনিক জনকণ্ঠে তখন আমি নতুন। ৯৮ সালের শেষ দিকে যোগ দিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার অপরাধে (?) আমাকে একটা কঠিন দায়িত্ব দেওয়া হল। আর সেটি হচ্ছে, ক্রিকেটের ওপর তার একখানা কলাম আদায় করে দেওয়া। আমি ক্রীড়া বিভাগের রিপোর্টার ছিলাম না। তারপরও শিকার হলাম জুলুমের! সে যে কী কঠিন কাজ, ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। যাহোক, সেই অসম্ভবকে আমি সম্ভব করেছিলাম। জননন্দিত কথাশিল্পীর বেশ কয়েকটি লেখা আদায় করে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম সেবার। অতিথি কলাম শিরোনামে লেখাগুলো ছাপা হয়েছিল।
ওই কলামগুলো হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কোনো বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে যাননি। ২৭ মে ১৯৯৯ তারিখে জনকণ্ঠে প্রকাশিত কলামটি হুমায়ূন অনুরাগী পাঠকদের জন্য এখানে তুলে দেওয়া হল। এই লেখা এখনো পর্যন্ত অগ্রন্থিত]
. . .
এবার অস্ট্রেলিয়া
বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী
হুমায়ূন আহমেদ
আজ আবারো আমাদের খেলা। আমরা খেলব ক্যাঙ্গারু দেশের সঙ্গে। এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করছি। মন বলছে কোনো একটা অঘটন ঘটে যাবে। একেকটা খেলা হচ্ছে, আমাদের রানের সংখ্যা বাড়ছে। প্রথমবারের ১১৬, তারপর ১৮২, শেষবারে ১৮৫। সহজ অঙ্কের নিয়মে আমরা এবার ২০০ করব। কেউ কেউ বলতে পারেন, খেলা কোনো অঙ্ক নয়। তাদের কথা ঠিক আছে, কিন্তু মন মানছে না যে! মন বলছে, আমরা ২০০ অতিক্রম করব এবং আমাদের বোলাররা খাঁটি রয়েল বেঙ্গলদের মতো ঝাঁপ দিয়ে পড়বে।
একটু অন্যরকম হিসাব করি। অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য এই খেলা জেতা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাদের শুধু জিতলেই হবে না, রান রেটে ভালো কিছু করতে হবে। করতে না পারলে বিদায়। কাজেই যথেষ্ট ‘টেনশান’ নিয়ে খেলবে। ইনশাআল্লাহ এই টেনশানই তাদের কাল হবে। বাংলাদেশ অতি দুর্বল টিম এটাও তাদের মাথায় থাকবে। খেলার মধ্যে তাচ্ছিল্য থাকবে। অস্ট্রেলিয়ানরা তাচ্ছিল্য করতে ভালোবাসে। এই তাচ্ছিল্যের খেলাই তাদের কাল হবে। আমাদের নামী-দামী ব্যাটসম্যানরাও হয়তো চক্ষুলজ্জার খাতিরেও দু’একটা রান করবেন। আকরাম সাহেব পুরো খেলায় কিছু করবেন না, তা তো হয় না! কিছু নিশ্চয়ই করবেন।
আমি বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের কোনো কর্তা ব্যক্তি হলে আকরাম সাহেবকে ডেকে বলতাম, ভাই আপনি দয়া করে চোখ থেকে কালো চশমাটা খোলেন। মুখের চুইংগাম ফেলে দিয়ে মন লাগিয়ে খেলেন। জুনিয়র ব্যাটসম্যানদের উপদেশ দিয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারছি, মাঠ থেকে বল কুড়াতে গেলে ভুঁড়িতে চাপ পড়ছে। একটু কষ্ট তো করতেই হবে।
আমি কি রূঢ় কথা বলে ফেলেছি? হ্যাঁ বলেছি। মনের দুঃখে বলেছি। আকরাম সাহেব যদি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তেমন কিছু করেন সঙ্গে সঙ্গে সব ভুলে যাব এবং পরবর্তী আন্তর্জাতিক খেলায় তাঁকে দলে না নেয়া হলে খুবই হৈ চৈ করব। বাংলাদেশের মানুষ খারাপটা মনে রাখে না। দ্রুত ভুলে যায়।
বাংলাদেশের বোলাররা ভালো দেখিয়েছেন। আমার কাছে বোলারদের বিনয়ী মনে হয়েছে। সব সময় দেখা যায়, ভালো বোলাররা এক ধরনের অহঙ্কারে ভোগেন। বাংলাদেশের বোলাররা এই অহঙ্কার থেকে মুক্ত। তার চেয়ে বড় কথা, আত্মবিশ্বাসের অভাব তাদের মধ্যে নেই। তাদের বল করা দেখে বার বারই বলতে ইচ্ছে করে, শাবাশ!
বাংলাদেশের সমর্থকদের একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। সমর্থকরা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কিংবা বাংলাদেশ চিরঞ্জীব হোক ধ্বনি দিচ্ছেন না। তারা বলছেন,‘বাংলাদেশ। বাংলাদেশ।’
খেলা শেষ করে এরা যখন দেশে ফিরবেন, তখন স্লোগানের ধরন বদলাবে। ‘বাংলাদেশ চিরঞ্জীব হোক’ বা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠবে। দেশের বাইরে আমাদের একটাই পরিচয়, বাংলাদেশ।
পুনশ্চ: আমার কাছ থেকে জনকণ্ঠের জন্য লেখা নিতে এসেছেন কবি হাসান হাফিজ। লক্ষ্য করলাম, তাঁর গলা ভাঙা। হাঁসের মত ফ্যাঁস ফ্যাঁস করছেন। কি ব্যাপার জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, বাংলাদেশ জেতার পর এমন চিৎকার দিয়েছি যে গলা শেষ। শুধু আমার একার নয়। আমাদের অফিসের সবারই গলা ভাঙা।
সারাবাংলা/পিএম
অস্ট্রেলিয়া আকরাম খান ক্রীড়ানুরাগ জনকন্ঠ লেখক হাসান হাফিজ হুমায়ূন আহমেদ