মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথ
৫ আগস্ট ২০১৯ ২৩:৫৯
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।”
মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তার কাছে প্রতিভাত হয় এক অখণ্ড রূপে। তাই তার গানে জীবন-লীলার সুর বাজে ঠিক এভাবেই।
আজ বাইশে শ্রাবণ। কবির চির-প্রস্থানের দিন। কালের অমোঘ নিয়মে আবার ফিরে এলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চির-প্রয়াণের বেদনাবিধুর স্মৃতিবহ বাইশে শ্রাবণ। ১২৬১ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ কলকাতার ঐতিহ্যবাহী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আলোকিত করে যে ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ঠিক সেখানেই ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তথা বাংলা বাইশে শ্রাবণ চির-বিদায় নিয়েছিলেন এই মধুময় পৃথিবী থেকে।
১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করেন। তার জীবনের শেষ চারটি বছর কেটেছে শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে। ১৯৩৭ সালে একবার অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। এ সময় তিনি মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেন বেশ কিছু অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা। যদিও প্রথম জীবনে তিনি ভানুসিংহের পদাবলিতে লিখেছিলেন, “মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান … মৃত্যু অমৃত করে দান।”
জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ মহাপ্রয়াণের ৭৭ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ অনির্বাণ শিখার মতোই জ্বলছেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। বাঙালি প্রতিদিনই তাকে স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে। আজও পথ খুঁজতে হয় তারই স্ফুলিঙ্গ ধরে। বাঙালির সব উৎসবেই আছেন রবীন্দ্রনাথ।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা ছিল তার রচনা। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ তার রচনা। তাই তার প্রয়াণ দিবসে যতই ব্যথা থাক, জেগে ওঠে পুষ্পধ্বনি। তারই ভাষায় বলতে হয় “মৃত্যু হতে জাগো পুষ্পধনু/হে অতনু, বীরের তনুতে লহো তনু।” (উজ্জীবন)
নিজের জন্মদিন নিয়ে যিনি লিখেছিলেন, “ওই মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে…”, সেই রবীন্দ্রনাথই জীবনসায়াহ্নের জন্মদিনে মৃত্যুভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে লিখেছিলেন_ “আমার এ জন্মদিন মাঝে আমিহারা,/ আমি চাহি বন্ধুজন যারা/ তাহাদের হাতের পরশে/ মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে/ নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ/ নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ…।”
তার সেই আকাঙ্ক্ষার মতোই শুধু ‘বন্ধুজন’ নয়, সর্বস্তরের মানুষের শেষ আশীর্বাদ আর ভালোবাসার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে কেওড়াতলা শ্মশানঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কলকাতার সেদিনের (১৯৪১) বিবরণ তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় আর রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে কবির জীবনের সমাপ্তি হয়েছিল সর্বজনীন শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ মিছিল ছিল তার শবযাত্রায়।
মানুষের শেষ আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, পেয়েছেনও। এমনকি যারা ছিলেন তীব্র সমালোচক-নিন্দুক, তারাও নিন্দা প্রত্যাহার করে বিশ্বকবির অন্তিমযাত্রার খবরে বিষণ্ন হয়েছেন। সে যুগের দৈনিক আজাদ’র মতো ঘোরতর রবীন্দ্রবিরোধী পত্রিকা যে বিস্ময়কর শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়েছিল প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে, তা অকল্পনীয়ই বটে।
আশি বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে নানাভাবে ঋদ্ধ করে গেছেন। শুধু বাংলা ছোটগল্পের কিংবা বাংলা গানের ক্ষেত্রেই আধুনিকতার পথিকৃৎ বা জনকমাত্র নন, তিনি তৈরি করেছেন সাহিত্যের নানা পথ। সে জন্য একই সঙ্গে যিনি বাউল দার্শনিক আধ্যাত্ম চেতনায় বিশ্বাসী আস্তিক, আবার সেই তিনিই প্রবল বস্তুবাদী দর্শনে জাগ্রত, মানবমুক্তির লড়াইয়ে সামিল। যিনি বলেন, “আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে/তোমার সোনার তরী”; সেই সৌন্দর্যের সুদূর পিয়াসী কবিই কী অবলীলায় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন মানবতার অপমানের প্রতিশোধবাণী— “দিকে দিকে দানবেরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।”
ঔপনিবেশিক শাসকরূপী দানবের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে প্রস্তুতি লক্ষ্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও অবলীলায় কষ্টসহিষ্ণু এক সংগ্রামশীল মানুষ ছিলেন তিনি। কী গভীর মৃত্তিকাসংলগ্ন হলে উচ্চারণ করতে পারেন ‘দুই বিঘা জমি’র উপেনদের মতো শোষিত মানুষের দুঃখ! কী জীবনঘনিষ্ঠ কাব্যবোধ থাকলে প্রতীক্ষা করা যায়— “কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন/ কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন/ যে আছে মাটির কাছাকাছি/ সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।”
তার আশি বছরের জীবনের সবটুকু জুড়েই গভীর মানবপ্রীতির এই আকাঙ্ক্ষা নানাভাবে উৎকীর্ণ। গল্পগুচ্ছের গল্পমালায় পূর্ববঙ্গের পদ্মাতীরবর্তী মানুষের সুখ-দুঃখ আর নর-নারীর জীবনতৃষ্ণার যে নিখুঁত চিত্র, তার তুলনা নেই। কবিতায়, সঙ্গীতে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে, চিত্রকলায়— এমনকি স্মৃতিকথার মধ্যেও মানবতাবাদী উদার প্রগতিশীল রবীন্দ্রনাথের দ্রোহ আর প্রেম, বাউল দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শন মিলেমিশে একাকার। ‘সোনার তরী’, ‘মানসী’, ‘চিত্রা’র কবি হয়েও দুই দু’টি মহাযুদ্ধের ভয়াবহতায় আঁতকে ওঠেন। লেখেন ‘সভ্যতার সংকট’-এর মতো অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রবন্ধ। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘গোরা’র মতো উপন্যাস, নারীমুক্তির অমর বাণী ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্য আর ‘যোগাযোগ’-এর মতো প্রতিবাদী উপন্যাস।
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে বড় বেশি পার্থক্য দেখেননি রবীন্দ্রনাথ। একটি অধ্যায়ের পরিপূরক যেন অন্যটি। না হলে কিশোর বয়সে কেমন করে লিখলেন “মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান…/মৃত্যু অমৃত করে দান।” মানবের মাঝে বাঁচতে চেয়েছেন বটে পরিণত বয়সে পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার শর্তে “মরিতে চাহি না” বলে। কিন্তু প্রকৃতই খণ্ডের মাঝে যেমন অখণ্ডকে দেখতে চেয়েছেন, তেমনি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পূর্ণতার স্বরূপ উপলব্ধি করতে চেয়েছেন বারবার। নানা গানে, কবিতায় এমনকি ছিন্নপত্রে সে কথা লিখেছেন তিনি। ক্ষুদ্রতার অচলায়তন ভেঙে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছেন বলেই তিনি সগর্বে বলতে পেরেছেন— “এ বিশ্বরে ভালোবাসিয়াছি/ এ ভালোবাসাই সত্য এ জন্মের দান/ বিদায় নেবার কালে/ এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলির পরতে পরতে আছে বাঙালির যাপিত জীবন, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। আছে বাঙালির চিরদিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা। তার বহুমাত্রিক সৃজনশীলতা সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সব ক’টি শাখাকে স্পর্শ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তারই দেখানো পথে বাঙালি আজও খোঁজে নতুন পথ।
তার সাহিত্যের আবেদন বিশ্বজনীন। জীবদ্দশাতেই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংরেজি, ওলন্দাজ, জার্মান, স্প্যানিশসহ বেশ কয়েকটি দেশের ভাষায় রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলি অনূদিত হয়েছে। চেক ভারততত্ত্ববিদ ভিনসেন্স লেনসি, নোবেলজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক আন্দ্রে জিদ, রাশিয়ান কবি আনা আখমাতোভা, প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত একেভিত, মার্কিন ঔপন্যাসিক জোনা গেইলসহ অনেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেন রবীন্দ্র-রচনা থেকে। ১৯১৬-১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া তার ভাষণগুলো বিশেষ জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পায়। তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে দেশজ আদর্শলালিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে কবিগুরু প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন। প্রাচীন ভারতীয় তপোবনের আদলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তার বিপুল কর্মকাণ্ডের প্রধান সাক্ষী।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করেন তিনি ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি এবং এশীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্যদিয়ে। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, মণীন্দ্রনাথ নন্দী এবং অন্যান্য পণ্ডিত মিলে সাড়ম্বরে কবির জন্মোৎসব পালন করেন। নোবেল পুরস্কার জয়ের আগে এটাই ছিল কবির প্রতি স্বদেশবাসীর প্রথম অর্ঘ্য।
রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন জমিদার পরিবারে। জমিদারির তদারকিও করেছেন পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। জমিদারের নিষ্ঠুরতা নয়, গ্রামীণ-সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গভীর মমতাই উৎসারিত হয়েছে তার যাপিত জীবনে। নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে কুষ্টিয়ায় কৃষি ব্যাংক খুলেছিলেন দরিদ্র কৃষকদের ঋণ দিতে।
মানবতাবাদী এ কবি মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তার মতে, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন— “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।”
তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের সমান্তরালে পৌঁছে যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বিহারী লালের চেষ্টায় বাংলা কবিতায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও রবীন্দ্রনাথের হাতেই তা পূর্ণতা পায়। অন্যদিকে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াসে বিকশিত বাংলা গদ্যকেও তিনি পৌঁছে দেন সাফল্যের উচ্চ শিখায়। সাহিত্যবিশারদদের মতে, রবীন্দ্রনাথের কলমে বাংলা ছোট-গল্প যেখানে পৌঁছে আছে, এখনও পর্যন্ত কেউ তা অতিক্রম করতে পারেনি। বাঙালির জাতিসত্তা ও আধুনিক মানস গঠনেরও রূপকার তিনি। সংগ্রাম-সংকটে এবং নিত্যদিনের জীবনচর্চায় মিশে আছে তার গান ও বিভিল্প সাহিত্য। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া বাঙালির কোনো সাংস্কৃতিক উৎসবের কথা ভাবাই যায় না।
‘গীতাঞ্জলি’র জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তিনিই প্রথম এশীয় এবং নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে প্রথম বাঙালি। বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিবিসির শ্রোতা জরিপে চিরন্তন এ গানটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছে। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জন গণ মন’ তার রচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের সেই বিরল সৌভাগ্য অর্জনকারী ব্যক্তিত্ব, যার রচিত গান দুই দু্ইটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নিরন্তর বেজে চলেছে।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনে শান্তিনিকেতন পর্বের ছাপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে রচিত নৈবেদ্য কাব্য এবং নানা প্রবন্ধে প্রাচীন ভারতের ধ্যান ও তপস্যার রূপ ফুটে ওঠে। ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’ এবং ‘গোরা’ উপন্যাসে একদিকে জীবনের বাস্তবতা, মনস্তত্ত্ব এবং অন্যদিকে স্বদেশের নানা সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন তিনি। তবে এ পর্বে রবীন্দ্রমানসের একটি মহৎ দিক-পরিবর্তন ঘটে। জাতিগত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে চিরন্তন ভারতবর্ষকে কবি এখানেই আবিষ্কার করেন। এ সময়ে রচিত তার বিখ্যাত কবিতা ‘ভারততীর্থ’: “হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে / জাগো রে ধীরে-/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।” (গীতাঞ্জলি)- তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া।
১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘নাইট’ উপাধি দেয়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানাতে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ব্রিটিশরাজ প্রদত্ত নাইট উপাধি। তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ করার দাবিতে রাখিবন্ধন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে কবি তার মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং রাখিবন্ধনের দিনটিকে স্মরণ করে রচনা করেন একটি গান— “বাংলার মাটি বাংলার জল,/ বাংলার বায়ু বাংলার ফল/পুণ্য হউক,/ পুণ্য হউক,/ পুণ্য হউক হে ভগবান।”
হিংসাদীর্ণ পৃথিবীতে মানবতার কবি, মানবমৈত্রীর বাণীবাহক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমময় সুকুমার বৃত্তির চর্চা আজ বড্ড প্রয়োজন। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার মহত্তম বাণীর স্রষ্টা কবিকে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। মানবতার লাঞ্ছনায় যিনি ১০৩ বছর আগে ‘নাইট’ উপাধির মতো গৌরবটিকা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন তেমন মহৎ কবির কি মৃত্যু হয়! তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকবেন চিরকাল মানুষের সুগভীর ভালোবাসায়।