ড্রেসকোড
১০ আগস্ট ২০১৯ ১৪:০৪
অত্যাশ্চর্য, আচমকা বা অপ্রত্যাশিত কোনো কিছু দেখলে বা শুনলে অনেকের চক্ষু চড়কগাছ হয়, কেউ আকাশ থেকে পড়ে, কেউ আবার টাসকি বা ভিরমি খায়!
বাদলের কথা শুনে আমার একসঙ্গে সব হলো। পুরোই ‘জগাখিচুড়ি’ পরিস্থিতি।
বাদল যখন বলল, ‘বুঝলি, দামি ড্রেস পরে অত গর্ব করার কিছু নেই। কারণ জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়গুলো কাটে বিনা ড্রেসে!’ কথাটা শুনে লজ্জায় আমার দুই কান ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় থাকা করমচার মতো লাল হয়ে গেল প্রায়।
ঢোক গিলে বললাম, ‘মানে?’
বাদল হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে লাজুক ব্যাটা, আমি একদম শিশুবেলার কথা বুঝিয়েছি!’
‘যত্তসব ফালতু আলাপ।’ মুখে বললেও মনে মনে বাদলের যুক্তি মেনে না নিয়ে উপায় থাকে না।
বাদল কে?
আমার আর সাহেদের মিউচ্যুয়াল শত্রু!
আমরা তিন অবিবাহিত চাকর, মানে চাকুরিজীবী, একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকি। পরিচয়ের প্রথম তিনমাসেই অবশ্য বাদল আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। তারপর, একেকটি দিন কাটছে আর আনুপাতিক হারে তার সঙ্গে শত্রুতা বাড়ছে।
ঘটনার শুরুটা ড্রেস নিয়ে।
একদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরে দেখি বাদল আমার কালো রঙের একটা জামার কলার উল্টিয়ে কী যেন দেখছে।
‘অমন করে কী দেখছিস?’
‘দেখছি না, খুঁজছি।’ আমার দিকে না তাকিয়েই বাদল বলল।
‘কী খুঁজছিস?’
‘কোড নম্বর।’
‘শার্টের কলারে কোড? কীসের কোড?’
‘ওই তো, ড্রেসের।’
ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমি দশ সেকেন্ড সময় নিই। কিন্তু মাথা খাটিয়েও বাদলের কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে বলি, ‘ড্রেসের আবার কোড নম্বর থাকে নাকি?’
‘হু। থাকে তো। তুই জানিস না।’
‘তোকে কে বলল?’
‘আরে শোন,’ এতক্ষণে আমার দিকে তাকায় বাদল, ‘আজ রাতে ঢাকা ক্লাবে একটা পার্টির দাওয়াত পেয়েছি। ওরা এসএমএস দিয়ে জানিয়েছে পার্টির ড্রেসকোড কালো। তাই…’
‘হা হা হা…।’ বাদলের বোকামি দেখে হাসি থামাতে পারি না। কিন্তু তার কার্যকলাপ দেখে মেজাজটাও কন্ট্রোল করতে পারলাম না।
‘তাই বলে আমার কালো জামার ভাঁজ নষ্ট করবি? জানিস না, এই বাজারে স্ত্রী এবং ইস্ত্রি দুটারই খরচ বেশি। একটা শার্ট ইস্ত্রি করাতে লাগে ৮ টাকা…’
‘কী-ই-ই? তুই আমাকে ৮ টাকার খোঁচা দিলি? আজ আমার কালো ড্রেস নেই বলেই…’
‘তাহলে ওদের ফিরতি এসএমএসে লিখে দে : আমার তো কালো ড্রেস নেই, কারণ আমি নিজেই কালো।’
‘কালোকে কালো বলিও না’ উপদেশটি না মানার কারণে ওই মুহূর্তেই বাদলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব মিনিমাম এক ফুট দূরে সরে গেল। শত্রুতা ঘনিষ্ঠ হলো!
অবশ্য যে বেকুব শার্টের কলারে ড্রেসকোড খোঁজে, তার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যা হোক, ওই ঘটনার সপ্তাহখানেক পর বাদলের সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়ল একলাফে প্রায় আট ফুট।
বৃহস্পতিবার রাত মানেই চাকুরিজীবী ব্যাচেলরদের ‘স্বর্গরাত’! তেমনই এক ‘মহান বৃহস্পতিবার’ ডিনার সেরে ত্রিমুখী আড্ডায় আমরা। প্রসঙ্গ পোশাক মানে ড্রেস।
সাহেদ বলল, ‘…শোন, সভ্যতার শুরু হয়েছে তখন থেকেই, যখন মানুষের শরীরে ড্রেস ‘অ্যাড’ হয়েছে।’
‘কিন্তু আমি তো জানি সভ্যতার সূচনা হয়েছে আগুন আবিষ্কারের মধ্যে দিয়েই…’ বাদল বাগড়া দেয়।
প্রিয়াংকা চোপড়ার একটা ‘হট’ ছবিতে ‘হিট’ করে মানে লাইক দিয়ে আমি বললাম, ‘হু, মানুষ কতটুকু সভ্য বা অসভ্য সেটা কিন্তু তার শরীরে থাকা ড্রেসই প্রমাণ করে!’
‘কথা সত্য।’ সাহেদ সায় দেয়।
‘কিন্তু কথা আছে…’ মোবাইলের মনিটর থেকে আমি চোখ ফেরাই পাশে থাকা বাটির দিকে। মুড়িমাখানো চাবাতে চাবাতে বলি, ‘বাদলের মতো যারা নিজের একাধিক পোশাক থাকতেও অন্যের পোশাকে বদ-নজর দেয়, তারাও স্বল্পমাত্রার অসভ্য!’
‘রায়হান, তুই কিন্তু বহুত বাড় বাড়ছিস।’ রাগে ফোস ফোস করে ওঠে বাদল, ‘নায়িকাদের বিকিনি পরা ছবিতে যে লুকিয়ে লুকিয়ে লাইক মারছিস, সেটা কিন্তু আমি ঠিকই দেখেছি। শালা ক্যারেক্টার লেস।’
‘অ্যাহ! ওরা স্লিভলেস পরলে কিছু হয় না, আমি লাইক দিলেই ক্যারেক্টার লেস! না?’
‘অ্যাই, তোরা থাম তো।’ রেফারির মতো হাত উঁচিয়ে সাহেদ বলে। সেদিন ব্যাংকে কী ঘটনা হয়েছে শোন।
সাহেদ ব্যাংকার। এবং আমাদের বাসার ম্যানেজার। টাকা-পয়সার হিসাব-নিকাশ সে-ই সামলায়। তাই ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার ভান করি আমরা!
‘সেদিন ব্যাংকে এক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ আমার দুই ডেস্ক দূরে একটি মেয়েকে দেখলাম। গায়ে জিন্স, টি-শার্ট। পুরোই ছেলেদের লুক! আমি কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সামনে বসা গ্রাহককে বললাম, ওই মেয়েটিকে দেখেন। বোঝাই যায় না সে যে মেয়ে। আমি বুদ্ধিমান বলেই দেখে বুঝতে পেরেছি।’
‘ইয়ে, ভদ্রভাবে কথা বলুন। ও আমারই মেয়ে!’
আমি খুবই বিব্রত হয়ে বললাম, ‘স্যরি আংকেল! আমি আসলে বুঝতে পারিনি যে আপনি ওর বাবা!’
‘অ্যাই, আপনি মশকরা শুরু করেছেন নাকি? আমি ওর বাবা নই, মা!’
হা হা হা… হো হো হো…। নিজের বোকামির গল্প বলে সাহেদ নিজেই হাসতে থাকে। সঙ্গে যোগ হয় আমার আর বাদলের হাসি।
‘ব্যাংকে তো তোরা ড্রেসকোড মেনে অফিস করিস।’ আমি বললাম, ‘কিন্ত আমরা যারা মিডিয়াতে কাজ করি, শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করি, তারা কিছু পোশাক-আশাক নিয়ে কিছুটা উদাসীনই থাকি।’
‘সেইটা তোরে দেখলেই বোঝা যায়।’ বাদল টিপ্পনি কাটে।
‘হ, এজন্যই তো আমার শার্ট ধার নেওয়ার অভ্যাস তোর!’
‘যাহ, সামনের মাসে তোকে একটা শার্টই কিনে দেব!’
‘আষাঢ়ে কথা বলা বাদ দে। তারচেয়ে বরং রাজীবের কথা শোন।’
‘রাজীবটা কে?’ সাহেদ-বাদল একসঙ্গে বলে ওঠে।
‘আমার ছোটবেলার বন্ধু।’ বালিশে মাথা রেখে আয়েশ করে শুয়ে আমি বলতে থাকি, ‘বাদলের মতো রাজীবও কিছুদিন আগে একটা পার্টির দাওয়াত পেয়েছিল। আমন্ত্রণপত্রে ছোট্ট করে লেখা ছিল: অবশ্যই লাল টাই পরে আসতে হবে।’
‘তারপর?’ বাদল বেশ উৎসুক ভঙ্গিতে জানতে চায়।
‘তারপর আর কি। জীবনে প্রথম কোনো ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টির দাওয়াত। মিস করা যাবে না। যথাসময়ে রাজীব পার্টিতে গিয়ে দেখে, সবাই লাল টাইয়ের সাথে জামা-প্যান্টও পরে এসেছে!’
‘হায় হায়! কী বলিস? এটা কি সত্যি?’ সাহেদ চোখ বড় বড় করে জানতে চায়।
‘হু। গল্প হলেও সত্যি। রাত হয়েছে, ঘুমা।’ এই বলে আমি মুড়ি চাবানো বন্ধ করে কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
চোখ বুজতেই বাদল আর সাহেদের মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। আমি জানি, ওরা আমার গল্প বিশ্বাস করতে পারে কিন্তু আমাকে নয়!
খায়রুল বাবুই : লেখক ও অনুষ্ঠান নির্মাতা।