উড়াও শতাবতী (২১) || মূল: জর্জ অরওয়েল || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
১৭ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:৫৫
<<আগের অংশ || শুরু থেকে পড়ুন>>
আঙ্কল ওয়াল্টারের যৎকিঞ্চিৎ জানাশোনা ছিলো নানা মহলে- তিনি এগিয়ে এলেন আগবাড়িয়ে। বললেন, তার এক বন্ধুর বন্ধু রাসায়নিক উৎপাদনের একটি কারখানা চালান- সেখানে হিসাব বিভাগে গর্ডনের একটা ‘ভালো’ চাকরি হতে পারে। চাকরিটা নিঃসন্দেহে ভালো ছিলো। কোন সদ্য স্কুল ছেড়ে আসা তরুণের জন্য দারুণ একটা শুরু হতেই পারে এই চাকরিটি। মন লাগিয়ে করলে একদিন এই কারখানারই হোমরা-চোমড়াও কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু গর্ডনের তা মনে ধরলো না। দুর্বল মানুষেরা ঠিক যেমনটা করে- সেও তাই করলো। পুরো পরিবারের কাছে সেটাই ছিলো আতঙ্কের। চাকরিটা পেতে সামান্য চেষ্টাটুকুও করলো না গর্ডন।
এ নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি কম হলো না। পরিবারের কেউ বুঝতেই পারছে না- গর্ডন কেন এমনটা করলো। তাদের কাছে একটা ‘ভালো’ চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা ফিরিয়ে দেওয়া ধর্ম অবমাননার মতো কোনও অন্যায়। সে অবশ্য ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করলো- এ ধরনের কাজ তার পছন্দ নয়। তাহলে কী চায় সে? কোন ধরনের কাজ পছন্দ? সবারই সে প্রশ্ন। এ অবস্থায় অতি শান্তভাবে পরিবারের সবাইকে সে জানিয়ে দিলো- লেখালেখি করতে চায়। কিন্তু লিখে কী পেটের ভাত জুটবে? কীভাবে জুটবে? সে প্রশ্নও সকলের। সেতো অবধারিত ভাবেই সত্য- ফলে পরিবারের এমন প্রশ্নের কোনও উত্তর তার কাছে ছিলো না। তবে মনের গভীরে একটা ধারণা সে পোষণ করতো- হ্যাঁ কবিতা লিখেই একসময় সে তার জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। তবে সে ছিলো এতটাই অনিশ্চিত ভাবনা যে, মুখ ফুটে তা বলাও সম্ভব ছিলো না। কোনও ব্যবসায় সে নামছে না, অর্থ সংক্রান্ত জগতে তার পদধুলি কখনোই পড়বে না, সে ব্যাপারটি সুনিশ্চিত। একটা কাজ সে করবে বটে, তবে সেটি ‘ভালো’ কোনও চাকরি হবে না। গর্ডনের এসব কথা কিংবা ভাবনার মানে কেউ বুঝতে পারে না, এমনকি মাথায়ও ধরে না।
মা খুব কাঁদতেন, জুলিয়াও সারাক্ষণ তাকে বুঝাতো, চাচা-ফুপুরা (তখনও তাদের জনা ছয়-সাতেক বেঁচে ছিলেন) নানা কটুকথা শোনাতেন, আঘাত করতেন কথার বানে। তিন দিনের মাথায় এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো। রাতের খাবার খেতে বসেছিলো সবাই। হঠাৎ খাবারের মাঝেই মায়ের ভীষণ কাশি শুরু হলো। সেই কাশির দমকের মাঝেই নিজের হাতটি বুকে চেপে ধরে তিনি উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। মুখ থেকে তার বের হতো শুরু করলো রক্তের ধারা।
গর্ডন ভয় পেয়ে গেলো। না সে যাত্রায় মা তার মরে যাননি বটে তবে তাকে মৃতই মনে হচ্ছিলো। সবাই মিলে ধরাধরি করে তাকে উপরের তলায় নিয়ে গেলো। গর্ডন ছুটে গেলো ডাক্তারের কাছে। এরপর কিছুদিন মা তার মৃত্যুযমের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকলেন। খটখটে ড্রয়িং রুমে বসে টানা ছাত্র পড়ানো আর যখন তখন রোদ-ঝড়-বৃষ্টি-তুষারপাত যাই হোক হেথায় হোথায় যাওয়া আসা- এসবই ছিলো রোগটা এতটা গাঢ় হয়ে বসার কারণ। অসহায়ের মতো ঘরে বসে থাকলো গর্ডন, ভীতিকর এক অনুভূতির পাশাপাশি একটা অপরাধবোধও কাজ করছিলো তার মনের ভেতর। পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও তার মন বলছিলো- আসলে তার কারণেই মা নিজেই নিজেকে মেরে ফেলতে বসেছেন। তার স্কুল ফি জোগাতেই মা নিজেকে এতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে টেনে নিয়ে গেছেন। এতকিছুর পর মায়ের মতের বিরুদ্ধে যেতে আর তার মন সায় দিচ্ছিলো না… কিংবা বলা চলে আসলে সে পারলো না। বাধ্য ছেলের মতো আঙ্কল ওয়াল্টারের কাছে গেলো আর জানালো- ওরা যদি দেয় এখন তবে লাল শিসা তৈরির কারখানার চাকরিটা সে করবে। আঙ্কল ওয়াল্টার তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বললেন, সেই বন্ধু আবার তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বললেন এবং অতঃপর গর্ডন গেলো চাকরির ইন্টারভিউতে। সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন এক বুড়ো। মুখভর্তি অগোছালোভাবে বসানো কতগুলো কৃত্রিম দাঁতের সেই বুড়ো তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন বটে, তবে চাকরিটি তার হয়ে গেলো। প্রথমে পরীক্ষাধীন থাকবে। পরে ভালো করলে স্থায়ী চাকরি। শুরুতে সপ্তাহে পঁচিশ পাউন্ড মাইনে। এরপর ছয়টি বছর ওই ফার্মে চাকরি করে গর্ডন।
অ্যাকটন থেকে ওরা পরে প্যাডিংটন ডিস্ট্রিক্টে চলে যায় আর সেখানে অনেকটা বিচ্ছিন্ন রেড ব্লকে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে শুরু করে। মা তার সাথে করে পিয়ানোটিও নিয়ে আসেন। আর মাঝে মধ্যে শরীরে শক্তি বোধ করলে ছেলেমেয়েদের পিয়ানো শেখানোর কাজটি করতেন। গর্ডনের বেতনও ধীরে ধীরে বাড়লো এবং তা দিয়ে ওরা তিনজন মিলে কোনওরকম চালিয়ে নিতে পারতো। তবে অর্থের ব্যাপারে সেই বালসুলভ স্বার্থপরতাটা তার তখনও ছিলো। অফিসে তার অবস্থান একেবারে খারাপ ছিলো তা না। যেটুকু বেতন কিংবা মজুরি সে পায়, আদতে সেটুকুরই যোগ্য সে… এর চেয়ে বেশি কামাইয়ের যে একটা ধাত থাকে সেটা তার নেই। তবে কর্মক্ষেত্রে তার এই যে অবস্থান, তাতে তার পক্ষে কিছু বিষয় একটু সহজই হয়েছে। এই অর্থহীন অফিস-জীবনটাকে মাঝে মধ্যে পাশে ঠেলে সরিয়ে রাখতে পারে। এতেই সে খুশি। কারণ সেতো জানেই এই কাজ কোনও কালেই তার জন্য স্থায়ী কিছু নয়। ঈশ্বর জানেন কিভাবে ও কখন, তবে সে নিশ্চিত করেই জানে কোনও না কোনওভাবে, কোনও না কোনও দিন এই সব ভেঙ্গেচুরে একদিন বেরিয়ে যাবে। আর লেখালেখিই হবে তার মূল কাজ, মূল পেশা। তা থেকেই জুটবে তার জীবিকা। আর যখন সে লেখক হবে তখন এইসব পয়সার ভাবনা তাকে ছুঁতেও পারবে না। আশেপাশে যাদের সে দেখে, বিশেষ করে বুড়ো-হাবড়াদের দেখে তার মনটা মুষড়ে যায়। এরা সব পয়সার পুজারি। পয়সাই এদের কাছে ঈশ্বর। নিজের পায়ে দাঁড়াও, ভালো আয় করো, বাড়ি কেনো, শতাবতী দিয়ে সাজাও এই সবই তাদের কাছে বড়। স্ট্রাব’র লিটল ম্যান কার্টুন চরিত্রের মতো ছোট্ট বোলার হ্যাট পরা গোবেচারা টাইপ মানুষগুলো সন্ধ্যা সোয়া ছ’টা বাজতেই ঘরে ঢুকে পড়ে, সান্ধ্যভোজ সেরে টিনজাত পিয়ার জুসে চুমুক দেয়, ঘণ্টা আধেক বিবিসি, সিম্ফনি কনসার্ট শোনে আর অতপর হলেও হতে পারে বিছানায় সঙ্গমের নামে কিছুটা ধস্তাধস্তি করে হাফিয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কী এক ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে এরা! নাহ! নিশ্চিত করেই সে জানে জীবনের মানে এটা নয়। জীবনকে তারাই উপভোগ করতে পারে যারা নিজেকে এই সবের বাইরে বের করে আনতে পারে, অর্থ- আর অর্থ থেকে উৎসারিত তাবৎ লালসা থেকে দূরে সরে যেতে পারে। এমন একটা কিছু নিজের জন্য করার মনোভাব পুষে রেখে তবেই এগুচ্ছে গর্ডন। মনে মনে অর্থের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণাই রয়েছে তার। তবে এখনও তা গোপণ রয়ে গেছে। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে তার এই ভাবনা, তা এখনো অফিসে কেউ ধরতে পারেনি। এখনো তাদের কেউ জানে না যে সে কবিতা লেখে। অবশ্য ধরা পড়ে যাওয়ার মতো অনেক যে সে লেখে তা নয়। ছয় বছরে সে গোটা বিশেক কি তারও কম কবিতাই তার ছাপা হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। সেভাবে দেখলে কোনও অফিসের কেরাণি কিংবা সেনাদলের কোনও সৈনিকেরও এর চেয়ে বেশি কবিতা পত্রিকার পাতায় স্থান পেয়েছে।
keep the aspidistra flying উড়াও শতাবতী জর্জ অরওয়েল মাহমুদ মেনন