চৈতন্যবাজারের পাগলিটা মা হয়েছে
২৩ নভেম্বর ২০১৯ ১৬:৫৪
চৈতন্যবাজারে একটাই আলোচনা। ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন, পাগলিডারে এই কামডা করল কে? কার বাচ্চা জন্ম দিল বুবি পাগলি!
এই বাজারে কোথা থেকে কিভাবে পাগলি মেয়েটা এসেছিল কেউ জানেনা। একদিন শীতের সকালে সবুর মিয়া দোকানের ঝাঁপ খুলতে এসে দেখে সামনের বেঞ্চিতে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে একটা মেয়ে। যেখানে রোজ শুয়ে থাকে একটা তিন ঠ্যাং ওয়ালা কুকুর সে জায়গাটা দখলে নিয়েছে মেয়েটা। আর কুকুরটার জায়গা হয়েছে বেঞ্চির নিচে। অর্ধ উলঙ্গ যুবতী মেয়ের এই শুয়ে থাকার দৃশ্য শিহরণের পরিবর্তে ভয়ার্ত করে তোলে সবুরকে। চিৎকার দিতে দিতে ছুটে যায় দুশো গজ দূরের মালিকের বাড়িতে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে, ও খালু এইডা কি! ও খালু গো এইডা কি!
সবুরকে নিয়ে দৌড়ে দোকানের কাছে গিয়ে ভুঁড়ি সামলাতে না পেরে উপুর হয়ে মেয়েটির সামনে পড়ে যায় দোকানের মালিক আদম শেখ। ততোক্ষণে চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসেছে মেয়েটা। আদম শেখ মাথা তুলে বলে, ও তাইলে জিন্দা মাইয়া! জিজ্ঞেস করে, তুই কেডা। বাড়ি কই? কি করছ এইহানে?
কোন কথার উত্তর দেয় না মেয়েটা।
ইতিমধ্যে আদম শেখের দোকানের সামনে জড়ো হয়ে গেছে অনেক লোক। কতো জিজ্ঞাসা কতো জনের! কিন্তু মেয়েটির মুখে কোন কথা নেই। শুধু নিঃশব্দ হাসিই তার একমাত্র ভাষা। সে হাসিরও কোন অর্থ উদ্ধার করার সাধ্য নেই কারো।
মেয়েটি বাজারের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। তার পিছু নেয় কিছু ছোকড়া ছেলে। আদম শেখ বলল, মাইয়াডা বোবা পাগলি। কিন্তু আইলো কইত্তোন?
তারপর থেকে এই চৈতন্যবাজারই বুবি পাগলির ঠিকানা । এই বাজারেরই কোন দোকানের বারান্দা, বেঞ্চি বা রাস্তায় হয় তার মাটির বিছানা। ছেলে ছোকড়ারাও আর তাকে ক্ষেপায় না। কারো কাছে সে হাত পাতে না। তবু অনেকেই তাকে উচ্ছিষ্ট খাবার বা দুয়েকটা টোস্ট বিস্কুট দিতে কার্পণ্য করে না।
শুরুর দিকে আকবর চেয়ারম্যান একটা গুঞ্জন তুলেছিল বটে। তার সন্দেহ হচ্ছিল, মেয়েটি কোন গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট কিনা। উপজেলা চেয়ারম্যান আকবর আলীর বাড়িতে তিন বছর আগে তার ছেলের প্রাইভেট টিউটর মেয়েটির যে অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল সেটা নিয়ে তার একটা অস্বস্তি তো আছেই। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তার সে সন্দেহটাও উধাও হয়ে যায় । বুবি পাগলির ভাবভঙ্গিতে সন্দেহ আঁচ করার মতো কোন উপাদানই মেলেনি বলে অনেকটা নিশ্চিত বোধ করে আকবর চেয়ারম্যান।
দুই।
চৈতন্যবাজারের পূর্ব মাথায় ছোট জঙ্গলটির ভেতর থেকে গাছের পাতা ভেদ করে আসা শব্দে থমকে দাঁড়ায় তিন যুবক। এই অশুভ সন্ধ্যায় জঙ্গলের ভেতরে শিশুর কান্না! শেয়াল কুকুর কোন মায়ের সদ্যপ্রসূত সন্তানকে জঙ্গলে নিয়ে যায়নি তো!
রবিন আর রিয়াজের আগ্রহ কম থাকলেও আরমান পা বাড়ায় জঙ্গলের দিকে। তার দেখাদেখি পা ফেলে বাকি দুই বন্ধুও। কয়েক পা এগিয়েই চমকে উঠে তিন বন্ধু। আকাশের দিকে মুখ করে চিৎকারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে এক নবজাতক। তার পাশে নিস্তেজ যে নারিদেহটি পড়ে আছে সেটা বুবি পাগলি। মায়ের সঙ্গে নাড়ির বাঁধনে এখনো আটকা পড়ে আছে নবজাতক। দুই বন্ধুকে থাকতে বলে আরমান দৌড়ে বেড়িয়ে যায় জঙ্গল থেকে। হতবিহ্বল দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই একটা ভ্যান গাড়ি নিয়ে হাজির আরমান।
নাড়ি অবিচ্ছিন্ন নবজাতক ও বুবি পাগলিকে ভ্যানে তুলে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে ছুটে তিন বন্ধু । ভ্যানওয়ালা প্যাডল মারে আর তিন বন্ধু ঠেলে পেছন থেকে। উপজেলা হাসপাতালে পৌছতে বেশিক্ষণ লাগেনি তাদের। ইএমও জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চার বাবার নাম কি? একে অপরের দিকে তাকায় তিন বন্ধু।
আরমান বলে, জানি না। রাস্তার পাশে এই অবস্থায় দেখে আমরা ওনাকে নিয়ে আসি।
নবজাতকসহ বুবি পাগলিকে হাসপাতালে ভর্তির সময় দেখে ফেলে চৈতন্যবাজারের ঝাড়ুদার বড়ু বিবি। বিস্ময়ের সীমা থাকে না তার। কপালে হাফ ডজন ভাঁজ ফেলে বলে, ওরে পোড়া কপালি তুইও এই কাম করলি!
মুহূর্তের মধ্যে পুরো চৈতন্যবাজারে ছড়িয়ে পড়ে বুবি পাগলির একটি ছেলে সন্তানের মা হওয়ার খবর। আদম শেখের দোকানের সামনে অনেকগুলো বিস্মিত চোখ। কারো মনে পড়ে না বুবি পাগলির পেট বড় হওয়ার কথা। চোখের সামনে প্রতিদিন নোংরা কাপড়ে ঘুরে বেড়ানো একটা পাগলি মেয়ের পেট বড় হওয়ার দিকে কারোই নজর পড়েনি। অবশ্য এখন সবুর মিয়ার মনে পড়ছে, হ্যাঁ বুবির পেটটা গত কিছুদিন একটু বড় বড়ই ঠেকছিল। কিন্তু এমন চিন্তা মাথায় আসেনি যে ওই পেটে কারো ঔরস পড়তে পারে। আসলে চৈতন্যবাজারের সবাই ভুলেই গিয়েছিল ওটি একটি নারীর শরীর । ওই শরীরেও রক্তের প্লাবন আসে মাসে মাসে। বুবির মা হওয়ার খবরে হুঁশ আসে সবার। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারে না কেউ, বুবি পাগলিটার পেট বাঁধালো কে! এই বাজারের যতো চেনা মুখ, একে একে সব মুখে একবার মন ফেলে দেখে নেয় আদম শেখ। এমনি কি রাতের ঝাড়ুদার লুলা লালুর মুখটাও তার ভাবনা এড়িয়ে যেতে পারে না। না, কাউকেই এতোটা নিচে নামাতে পারে না সে। একটা পাগলি মেয়ে। বোবা। নোংরা দুর্গন্ধময় শরীর। কে যাবে ওর কাছে! মানবিক বিষয়টা না হয় দূরেই থাকুক। ঘেন্না বলতেও তো একটা ব্যাপার থাকে।
তিন।
ডিসি সাহেবের চোখ কপালে উঠে গেছে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ফুটফুটে নবজাতকের বড় বড় চোখ দুটো তাকে উতলা করে। তার জেলায় এই কাজ! এই ফেসবুক জেনারেশন বড় ডেঞ্জারাস। যদি দাবি উঠে এই সন্তানের বাবাকে খুঁজে বের করার? একেবারেই অযৌক্তিক দাবি। কিন্তু যদি কেউ করে বসে! যদি বেসামাল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়! তাছাড়া মানবিক ব্যাপারটা তো আছেই। তিনি শঙ্কিত বোধ করেন, যদি মারা যায় পাগলিটা!
ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেই ডিসি সাহেব ফোন করেন আকবর চেয়ারম্যানকে। সব শুনে চেয়ারম্যান ডিসি সাহেবকে আশ্বস্ত করে বলেন, স্যার এ নিয়ে আমাদের বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। ওই পাগলিটারে আমিও প্রেগন্যান্ট করি নাই, আপনিও করেন নাই। আপনি হাসপাতালে যান। আমিও আসতাছি। মহৎ কাজের সুযোগ বারবার আসে না।
জোছনার আলোর প্লাবন নেমেছে আজ। চৈতন্যবাজার থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পথে গাড়ির জানালার গ্লাস নামিয়ে চাঁদের আলোয় রাস্তার দুই পাশের অবারিত মাঠের আলো আঁধারিতে ডুবে যায় আকবর চেয়ারম্যানের মন। কেমন উদাস উদাস লাগে। ফোনটা হাতে নেন। ফেসবুক ওপেন করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নবজাতকের বড় বড় চোখে চেয়ে থাকা মুখ। বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে ভাবেন, কোথায় দেখেছি এই চোখ!
অস্বস্তি কাটাতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া ড্রাইভার রবিউলকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার ছেলে মেয়ে কয়টা রবিউল মিয়া?
এতোক্ষণে চাঁদের বাঁধ ভাঙা রূপালী আলো ড্রাইভার রবিউলকে স্পর্শ করতে না পারলেও এই একটা প্রশ্ন তাকে দারুণভাবে আবেগ তাড়িত করে তোলে। কাশি দিয়ে গলার আর্দ্রতা কাটিয়ে বলে, সেই ভাইগ্য নাই স্যার। বিয়ের আট বছর পরেও বউয়ের কোল খালি। তাবিজ-কবজ, হুজুর-দরবেশ, পানিপড়া-ডিমপড়া কিছুই বাদ রাহে নাই বেচারি । পরে ডাক্তারী পরীক্ষা করে দেহি দোষটা আমারই।
রবিউল ড্রাইভারের কথা শুনে আকবর চেয়ারম্যানের চোখে মুখে কেমন এক দ্যুতি খেলে যায় । যে কেউ খেয়াল করলে এই চাঁদের আলোতেও ঠিক ধরে ফেলতে পারতো সে ঔজ্জ্বল্য। রবিউলকে হঠাৎ চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করে, বুবি পাগলিটার একটা ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছে। ওই চাঁদটার চেয়েও সুন্দর। ওই পাগলি তো এই বাচ্চাটারে পালতে পারবো না। তুই দত্তক নিবি? একেবারে সোনার টুকরো ছেলে।
এইবার রবিউল ড্রাইভার কাশি দিয়েও তার গলার আর্দ্রতা গোপন করতে পারে না। ধরা গলায় বলে, স্যার সত্য সত্য আইন্না দিবেন! আমরা সারাজীবন আপনার জন্য দোয়া করুম।
ডিসি সাহেব ও আকবর চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে আছেন বুবি পাগলির বেডের কাছে। চিকিৎসক তাদের নিশ্চত করে জানাচ্ছেন, নবজাতক ও মা সুস্থ আছেন।
আকবর চেয়ারম্যান বারবার শুধু বুবির ছেলেটার দিকে তাকাচ্ছেন। এতো মায়া যে কোন নবজাতকের চোখে মুখে থাকতে পারে তা ছিল তার কল্পনার বাইরে। যতবার নবজাতকের চোখে চোখ পড়ে ততবারই চমকে উঠেন তিনি। মনে হয় এই চোখ তার কতো দিনের চেনা! হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় জাতিস্মর শব্দটা।
আদম শেখ, সবুর মিয়াও এসে হাজির হয়েছে হাসপাতালে। আদম শেখ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে বুবি পাগলির দিকে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা পরিচ্ছন্ন কাপড়ে বুবিকে দেখে অবিশ্বাসের চোখে তাকায় সবুর মিয়াও। বাইশ তেইশ বছরের এই পাগলিটা যে এতো সুন্দর, এতোটা মোহনীয় তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তাদের।
পাশে দাঁড়ানো তিন যুবকের দিকে তাকিয়ে ডিসি সাহেব বলেন, তোমাদের মতো মানবিক মনের ইয়াং ছেলে-মেয়েরা আছে বলেই দেশটা এখনো আশার আলো দেখে। তোমরা যা করেছ তার সঠিক প্রশংসা জানানোর মতো যুৎসই শব্দ আমার জানা নেই।
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে আরমান, রবিন ও রিয়াজ।
হঠাৎ নীরবতা ভেঙে আকবর চেয়ারম্যান বলে উঠেন, বুবি পাগলি তো এই ছেলেকে নিরাপদে পালতে পারবে না। তাই এই শিশুর ভবিষ্যতের স্বার্থে তাকে দত্তক দিলে কেমন হয়? আমার ড্রাইভার রবিউল নিঃসন্তান। ওর ইচ্ছা এই শিশুটিকে দত্তক নিয়ে তাকে সন্তান স্নেহে মানুষ করা।
ডিসি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত সায় দেন আকবর চেয়ারম্যানের কথায়। সঙ্গে যোগ করেন, আর বুবিকে একটা আশ্রমে দেয়ার সব ব্যবস্থা নেব আমি।
বেশ ফুরফুরে মেজাজেই গাড়িতে উঠে আকবর চেয়ারম্যান । যাক, সব ভালোয় ভালোয় সামাল দেওয়া গেছে। কেউ প্রশ্ন তুলেনি, বুবি পাগলির সন্তানের বাবা কে!
ফেরার পথে চাঁদের আলোটা একটু বেশিই ঝলমলে মনে হয় আকবর চেয়ারম্যানের কাছে । আশ্বিনের স্বচ্ছ আকাশ ভেদ করে আসা আলোর সাগরে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে তার।
তিন দিনেই পাশে শুয়ে থাকা ছেলেটার জন্য কেমন কেমন লাগে বুবি পাগলির। কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকায়। এই ছোট্ট শিশুটি কোথা থেকে কিভাবে এলো ভেবে পায় না সে। আর বুবি পাগলিই বা কেন এই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে শুয়ে থাকে সেটাও বুঝে আসে না তার।
চার।
চৈতন্যবাজারের কোলাহলে আবার মিশে যায় বুবি পাগলি। এতোদিন বাজারটাকে কেমন খালি খালি লাগতো আদম শেখের। হাসপাতাল থেকে পরে আসা পরিচ্ছন্ন কাপড়ে এই এক সপ্তাহেই ময়লা লেগে সেই চেনা চেহারায় ফিরে এসেছে পাগলিটা। আদম শেখ দুই বেলা নিয়ম করে পাউরুটি আর বিস্কুট দেয় বুবিকে। কেমন একটা মায়া অনুভব করে তার জন্য ।
রবিউল ড্রাইভারের সংসারে চলছে আনন্দের বন্যা। ডিউটির বাইরে এক মিনিটও বাইরে থাকে না সে। চৈতন্যবাজারের বাবুর মসল্লা চা না খেলে যার দিনটাই অপূর্ণ রয়ে যেত সেই রবিউল আজ সাত দিন বাবুর দোকানের ধারে কাছেও যায়নি। রবিউলের বউ দর্জি দোকানের কাজটাও ছেড়ে দিয়েছে। তার দিন রাত একাকার বাড়ির নতুন অতিথিকে ঘিরেই। এরই মধ্যে রবিউলের ছেলেটাকে একদিন এসে দেখে গেছেন আকবর চেয়ারম্যান। কোলেও নিয়েছেন। বলেছেন, দেখ রবিউল, তোর ছেলের একদিন দেশ জোড়া নাম হবে।
আকবর চেয়ারম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাচা থেকে বেরিয়ে আসা লাউয়ের ডগার মতো নুইয়ে পড়ে রবিউল আর তার বউ।
পাঁচ ।
পুরো চৈতন্যবাজারে সুনসান নীরবতা। কিছুক্ষণ আগেই সবাই দোকান খুলেছে। এখনো সূর্যের আলোর ঝলমলে ভাব ছড়িয়ে পড়েনি। অথচ সবাই দোকানের ঝাঁপ ফেলে হাঁটছে আকবর চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। কেউ কেউ খানিকটা ফিসফাস করছে অবশ্য। মুখ বন্ধ থাকলেও সবার চোখে গভীর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কামডা করলো কে! কেন করল!
কালকেও তো মটর বাইক নিয়ে গোটা তিনেকবার চক্কর দিলো চৈতন্যবাজারের ওপর দিয়ে। এমন তরতাজা পোলা। মাত্র কলেজে পড়ে। তারে কে এমন নৃশংসভাবে গলা কেটে খুন করলো!
দোকান বন্ধ করে দ্রুত পা ফেলে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় আদম শেখ। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আকবর চেয়ারম্যানের বাড়িতে যেতে হবে। নিজের মেয়েটা আত্মহত্যা করার পর তার স্ত্রী আর বাড়ির বাইরে যায় না বললেই চলে। কিন্তু আজ তাকে নিয়েই যাবে আদম শেখ। এমন তরতাজা পোলাটা খুন হল! কি করে যে বেঁচে থাকবে আকবর চেয়ারম্যান!
দরজা খোলা ঘরে স্ত্রীকে না দেখে পাশের রান্না ঘরে উঁকি দেয় আদম শেখ। কে শুয়ে আছে ওখানে? বুকের মধ্যে হিম শীতল আতঙ্ক অনুভব করে সে। বুবি পাগলি এখানে শুয়ে আছে কেন! আরেকটু কাছে গিয়ে দেখে রক্তমাখা বটিদা হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে বুবি পাগলি। আদম শেখের শরীর কাঁপতে থাকে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নেয় সে। বুবি পাগলির হাত থেকে বটি দা নিয়ে টিউবওয়েলের পানিতে ধুয়ে ফেলে। রক্তের চিহ্ন পর্যন্ত রাখা যাবে না।
বটিদাটা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে হবে। ঘরে ঢুকে বটিদাটাকে মাচার নিচে রেখে কাঠের বড় বাক্সটা খোলে আদম শেখ। খুঁজে খুঁজে বের করে মেয়ের সবচেয়ে পুরনো একটা জামা। মাটির মেঝেতে দুমড়ে মুচড়ে ঘষে ময়লা করে জামাটাকে। তারপর বুবি পাগলির রক্তমাখা জামাটা খুলে পরিয়ে দেয় নিজের মেয়ের জামাটা। এতো কিছুতেও ঘুম ভাঙে না বুবি পাগলির । আদম শেখ গিয়ে দক্ষিণের মজা পুকুরটার পানির নিচে কাদার মধ্যে গুঁজে দেয় বুবির জামা।
আকবর চেয়ারম্যানের বাড়িতেই সবুর মিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আদম শেখের স্ত্রী। তার পাশে গিয়ে হাত ধরে দাঁড়ায় আদম শেখ।
একমাত্র ছেলের রক্তাক্ত নিথর দেহের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে আকবর চেয়ারম্যান। চারদিকে আহাজারি। এতো মানুষের সমস্বরে এমন বিলাপ চৈতন্যবাজারবাসী আগে কখনো শুনেছে কিনা কেউ মনে করতে পারেনা। এমন করুণ বিলাপে চোখের জল ধরে রাখা কঠিন। চেয়ারম্যানের ছেলে কোন একদিন বিনা কারণে চড় মেরেছিল বলে মনে মনে রাগ পুষে রাখা সবুর মিয়ার চোখও ভিজে যায় জলে। তারও চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
মাটির মূর্তির মতো অনড় দাঁড়িয়ে থাকা আকবর চেয়ারম্যানের চোখ গিয়ে পড়ে ছেলের চোখে। দেখে মনে হয় না সে চোখযুগল কোন মৃত মানুষের । কেমন স্নিগ্ধ মায়া মাখা চোখে চেয়ে আছে প্রিয় পুত্র। এইবার সকল বাঁধ ভেঙে প্লাবনের মতো ধেয়ে আসে আকবর চেয়ারম্যানের চোখের জল। জলে ভেজা সেই ঝাপসা চোখে হঠাৎ এক বিস্ময় এসে ভর করে। ছেলের চোখের দিকে এমন করে কোন দিন তাকিয়ে দেখেননি তিনি। আজ দেখেই তার মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দে একটি কথাই বেড়িয়ে আসে, এই চোখ!