একটি রুবি আর লেমন-কোলার টুকটুকে লাল গল্প
৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:৩৩
মোসলেউদ্দিন তরফদারের মনটা খারাপ। আসলে দিন খারাপ। বেশ কয়দিন ধরেই, দিন খারাপ। মনও। শরীরটাও।
মোসলেউদ্দিন তরফদার এসেছেন ডাক্তারের কাছে। অনেকদিন ধরে দু’হাত জুড়ে ব্যথা। যেন কেউ বিষ মাখিয়ে দিয়েছে। ডাক্তার এক্স-রে করে জানালেন, ডান হাতে টান লেগেছে। ব্যায়াম করতে হবে নিয়মিত, ফিজিওথেরাপি নিতে হবে।
“হাতে এমন বাজে টান লাগলো কেমন করে, মোসলে সাহেব?”
-“জ্বি, আসলে…”
“ভাৱি কিছু টানাটানি করেছেন?”
-“জ্বি না, আসলে মোবাইলে অনেক টাইপের কাজ করতে হয়”
“আপনি কি টাইপিস্ট?”
-“আরে না ভাই, আমি আমার ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। টাইপিস্ট হবো কেন?”
“তো?”
-“আমি স্ট্যাটাস টাইপ করি তো অনেক, ফেসবুক স্ট্যাটাস।”
“ও, কয়টা পোস্ট টাইপ করেন?”
-“ঘটনার উপর, যেদিন যেমন ঘটনা ঘটে। ২/৩টা থেকে শুরু করে ৭/৮ টা হয়ে যায়। দিনে ১০ টার রেকর্ড আছে। আবার কমেন্টের উত্তর ও দিতে হয়।”
“লিখতে যেয়ে টান খেয়েছেন?:
-“না, তবে সেদিন সেলফি উঠাতে যেয়ে, হাত বেশি উঁচু করে ফেলেছিলাম, হালকা একটা টান খেয়েছি, হাতের রগে।”
অতঃপর ডাক্তার নিষেধাজ্ঞা দিলেন, একদম সেলফি তোলা বন্ধ। একদম। যতদিন হাত ঠিক না হয়। টাইপ প্রয়োজন না হলে না।
অনেক বলে কয়ে মোসলে সাহেব ডাক্তারকে রাজি করালেন যে, বাম হাত দিয়ে মাঝে মাঝে টাইপ করবে, বাম হাতে ব্যথা কম। আর উনি দিব্যি বাম হাত দিয়ে টাইপ করতে পারেন, একদম চটপট করে।
তো ওই যে দিনটিন খারাপ যাচ্ছে। ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পথে, মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে, হাতে নিয়ে বসে ছিলেন রিক্সায়। সিগনালে থামবার মুখে একটি বাইক এসে বেকায়দায় এমন ধাক্কা দিলো পেছন থেকে, উনি পড়লেন না, পড়লো মোবাইল ফোনটা। হায় মোবাইল। এ টুকরো সে টুকরো কুড়িয়ে জোড়া দিয়ে, মোবাইলের জান ফেরানো গেলোনা। মোবাইল আর ফিরলোনা। বেয়াদব বাইকওয়ালা ততক্ষণে হাওয়া।
ওদিকে, চাকরির অবস্থা তথৈবচ। বেশ যেমন তেমন অবস্থা। রফিক সাহেব পিছে লেগেছে, যাতে ম্যানেজার এর পদটা মোসলে সাহেব না পেয়ে সে পায়। নানা কাজে ফাঁসাচ্ছে। তার মধ্যে এক ওয়ার্কশপে যেয়ে, না বলে কয়ে উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার সাথে দূর থেকে টুপ করে সেলফি তোলার অপরাধে তার বিরুদ্ধে নালিশ গিয়েছে বসের কাছে। একদম যা-তা অবস্থা মোসলে সাহেবের।
এর মধ্যে হাত নাড়ানো যায়না। ফেসবুকে অনেকদিন পোস্ট না দেয়ায় জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। আগের মতন মানুষজন খোঁজ খবর নেয়না। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল ধরনের সিচুয়েশন চলছে তার জীবনে।
তবে দিনতো সমসময় খারাপ যায়না, শুভদিন আসে। বন্ধু জব্বার কাজের মানুষ। তার সামগ্রিক ঘটনা বিবেচনা করে,ভেবে চিন্তে বললো – “বন্ধু তোর শুভদিন আসন্ন। দিন সমসময় সমান যায়না। ”
বন্ধু জব্বার বিচক্ষণ । জীবনে আয়- উন্নতি করেছে। তার পরামর্শে, মোসলে সাহেব যেয়ে পৌঁছালেন মৌমাছি শপিং কমপ্লেক্সের সাত তলায় – শুভদিন নামক দোকান, মানে অফিসে।
শুভদিনের মালিক, পেশায় জ্যোতিষ বটে। কিন্তু জ্যোতিষ শাস্ত্রের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা তার। আসেপাশের দেশ থেকে নামি-দামি লোক গোপনে এসে দেখা করে যায় তার সাথে।
জ্যোতিষী সাহেব কম কথা বলেন, যা বলেন খাপে খাপ একদম। চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন – ঝামেলায় আছেন মোসলে সাহেব। কথা বলাবলি করে, যাচাই বাছাই করে বোঝা গেলো, সিংহ রাশির জাতক মোসলে সাহেবের একটা পাথর বড্ড প্রয়োজন। টকটকে রক্তবর্ণ, সোনায় বাঁধা আংটি। তবে আয় উন্নতি ফিরবে, ফিরবে জনপ্রিয়তাও।
জ্যোতিষী সাহেব দয়ালু মানুষ। দাম কষাকষি করে, সোনায় বাঁধা রুবির আংটি ৪০ হাজার টাকায় রাজি হলেন। বাইরে হলে এই আংটি ৬০ হাজারের কমে না।
মোসলে সাহেব একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ল্যাপটপ কিনবেন বলে টাকা পয়সা জমিয়েছিলেন। মোবাইল থেকে ফেসবুকে ঢুকতে সবসময় সুবিধা হয়না। তা যা হোক, আগে ভাগ্য ফিরুক। কত ল্যাপটপ আসবে ধীরে ধীরে।
জমানো টাকা নিয়ে এক সপ্তাহ পরে, ‘শুভদিন’ এ গেলেন আংটি নিতে। জ্যোতিষ সাহেব তার হাতে আংটি দিলেন। আংটি তো নয়, যেন টকটকে রক্ত জবা। কি সুন্দর! কি সুন্দর! আহা! ৪০ হাজার টাকা জোতিষির হাতে দিয়ে নিজ আঙুলে আংটি পরলেন।
জ্যোতিষ সাহেব এক গ্লাস লেমন কোলা খেতে দিয়েছেন মোসলে সাহেবকে। এত দামি কাস্টমার। হাতে আংটি পরে লেমন কোলায় চুমুক দিতে যেয়ে মোসলে সাহেব আবারও এক যা-তা কাণ্ড করে বসলেন। কোলা টেবিলে পরে ভেসে একাকার। হাতে আংটি ভিজে চুপেচুপে ।
লেমন কোলার ঝাঁঝালো গুনেই হোক, রুবি পাথরের কাঁচা রঙের কারণেই হোক, লাল আংটির রং ধুয়ে মুছে একদম ফকফকে সাদা। এতো রুবি নয়, এক নুড়িপাথর মাত্র।
মোসলে সাহেবের জীবনে এর পরের ঘটনা অতটা খারাপ নয়। ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করে, জ্যোতিষের ভণ্ডামির কারণে আরো ৩ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে, পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। এই গল্প ফেসবুকে পোস্ট করে, বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। গল্প ভাইরাল হয়ে গেছে। জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
আর ‘শুভদিন’ জ্যোতিষ দোকানে নতুন সাইন বোর্ড ঝুলানো হয়েছে, “এই দোকানে কোলা জাতীয় কোনো ঝাঁঝালো পানীয় নিয়ে প্রবেশ নিষেধ।”
কিযী তাহনিন: লেখক ও উন্নয়নকর্মী