১৯৭১: একটি জানুয়ারি ও চারটি ডিসেম্বর ডেসপাচ – ১
১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:২৩
হাইজ্যাক জানুয়ারি ১৯৭১
(একাত্তরের ৩০ জানুয়ারি ভারতীয় যাত্রীবাহী ফোকার ফ্রেন্ডশিপ উড়োজাহাজ হাইজ্যাক নিয়ে আরজিমান্দ হোসেন তালিবের দীর্ঘ রচনার কিছুটা সংক্ষিপ্ত অনুস্মৃতি: একই সঙ্গে একজন হাইজ্যাকারের সাক্ষাৎকারের অংশ এবং হাইজ্যাক নিয়ে উত্থাপিত বিতর্কগুলোও এই লেখাটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।)
ইতিহাস বদলে দিল একটি হাইজ্যাক। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭১। উড়োজাহাজটির নাম গঙ্গা। ভারতের অভ্যন্তরীণ রুটের ফোকার ফ্রেন্ডশিপ এফ-২৭ উজোড়াজাহাজ। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই গঙ্গাকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের বহর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে খারিজ করা হয়েছে, অর্থাৎ এটা আর চালানো হবে না। হয়েছিল। এর নাম ডিকমিশনড করা। এই ডিকমিশনড উড়োজাহাজ আবার কেন যে রিকমিশনড করে বহরে আনা হলো ভারত সরকার ছাড়া অন্য কারো জানার কথা নয়। শ্রীনগর থেকে জম্মুর পথে উড়োজাহাজটি হাইজ্যাক করা হলো।
হাইজ্যাকার দুজন হাশিম কুরেশি ও আশরাফ কুরেশি। তারা কি জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের পক্ষে কাজটা করেছেন? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে?
ফোকার ফ্রেন্ডশিপ উজোজাহাজ গঙ্গা
৩০ জানুয়ারি ১৯৭১, সেদিনের সকালটা কনকনে ঠান্ডা কিন্তু বেশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ফোকার ফ্রেন্ডশিপ উজোজাহাজ, নাম গঙ্গা তাদের নিয়ে আকাশপথে জম্মু যাত্রা করবে। শ্রীনগর এয়ারপোর্টের টারমাকে উড়োজাহাজ দাঁড়িয়ে। খোলামেলা এয়ারপোর্ট, তেমন প্রহরা নেই। যাত্রীদের কড়াকড়ি তল্লাশি করা হতো না, লাগেজেও কেউ তেমন হাত দিত না। দুটি বালকসহ উড়োজাহাজে আরো ২৭ জন যাত্রী। ইঞ্জিন চালু হলো, পাইলটরা উড়োজাহাজ রানওয়েতে নিয়ে গেলেন। বালকদের একজন ফাইয়াজের জন্য এ হচ্ছে উড়োজাহাজে চড়ার স্বপ্নপূরণ।
উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ঘুরছে। শ্রীনগরের মাটি থেকে জাহাজ উড়ে গেল শ্রীনগরের আকাশে। জাহাজের ডান দিকে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারিতে বসেছে দুজন বালক, খুবই উৎফুল্ল। জীবনে প্রথম আকাশপথে যাত্রার অভিজ্ঞতা-ঘাড় বাঁকিয়ে জানালার দিকে চোখ এনে দেখছে পর্বতমালা এবং পর্বত ঢেকে রাখা শ্বেত তুষার।
উড়োজাহাজ যখন জম্মু এয়ারপোর্টে নামতে যাচ্ছে, পেছন থেকে দুজন তরুণ ককপিটের দিকে ছুটে গেলেন।
হাতে পিস্তল থাকা তরুণ ককপিটের দরজায় লাথি মেরে পাইলটের দিকে এগোলো, অন্যজনের হাতের মুঠোয় গ্রেনেড। ককপিটের দরজা বরাবর উল্টোমুখী হয়ে একেবারে যাত্রীদের মুখোমুখি, তার হাত কাঁপছে। রিভলভার নিয়ে ককপিটে ছুটে যাওয়া তরুণের নাম হাশিম কুরেশি। আর গ্রেনেড হাতে আশরাফ কুরেশি।
হাশিম কুরেশি পাইলটের মাথায় বন্দুক ধরে আছে।
ক্যাপ্টেন কাচরু ও অন্যজন ক্যাপ্টেন ওবেরয় উড়োজাহাজ চালাচ্ছিলেন ।
এ ঘটনার পর পরই উড়োজাহাজ রানওয়ে স্পর্শ না করে আবার উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং মেঘের জাল ভেদ করে যেদিকে যেতে থাকে, স্পষ্টতই শ্রীনগর সেদিকে নয়। গঙ্গার জন্য দীর্ঘ সফরের নতুন সূচনা- এ সফরই পাল্টে দেবে উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রবাহ।
উড়োজাহাজ হাইজ্যাকারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। যাত্রীরা নিজেদের নিয়তির কাছে সমর্পণ করেছে। উড়োজাহাজ তখন পাঞ্জাবের আকাশে।
গঙ্গা যখন আরো নেমে রানওয়ে স্পর্শ করল, যাত্রীদের এতটুকুও ধারণা নেই, তারা কোথায় নেমেছে। আশরাফ ফাইয়াজকে একটু উঁচিয়ে টারমাকে পার্ক করা আরো উড়োজাহাজ দেখাল, বালকরা অবাক হলো, উড়োজাহাজে পিআইএ লেখা। উড়োজাহাজের লেজে তারা কখনো এমন অর্ধচন্দ্র দেখেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধাক্কা দিয়ে উড়োজাহাজের দরজা খোলা হলো। ফাইয়াজ ও তার ক্লাসমেট দেখল, দরজা দিয়ে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স নিচে ফেলা হয়েছে, সম্ভবত এগুলোকে নামার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সবার আগে লাফিয়ে নামলেন একজন হাইজ্যাকার, সম্ভবত হাশিম কুরেশি।
উড়োজাহাজের ভেতর খাওয়ার পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। যাত্রীদের জন্য কিছু পানির বোতল তোলা হলো। কয়েক মিনিট পর ঘোষণা শোনা গেল, ইচ্ছে করলে নারী ও শিশুরা নেমে যেতে পারে।
শিগগির সব যাত্রী নেমে এলে এয়ারপোর্টের দুটো বাসে তাদের টার্মিনাল ভবনে আনা হলো, সেখান থেকে নেয়া হলো লাউঞ্জে। চা, নাশতা ও আলিঙ্গনের বর্ষণ চলছে। তারপর পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তারা এসে যাত্রীদের সম্ভাষন জানালেন। আর এ দলের যিনি প্রধান, তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি এই মাত্রই ঢাকা থেকে ভারতের আকাশসীমা দিয়ে লাহোরে এসে অবতরণ করেছেন। তখন পাকিস্তানি উড়োজাহাজ এভাবেই আসা-যাওয়া করত।
উড়োজাহাজে থাকা ব্যাগেজ কেউ পায়নি; যা ছিল গঙ্গাতেই রয়ে গেছে। লাহোরের রাস্তা দিয়ে বাস যখন যাচ্ছে, নিরাপত্তা কনভয় বাস দুটিকে পাহারা দিয়ে এগোতে থাকে।
ভারত ও পাকিস্তান হাইজ্যাক নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ নয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর দুই দেশের সম্পর্ক তখনো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি। এদিকে গঙ্গা ও যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়ার আলোচনা চলছে। হাইজ্যাকারদের দাবি, ভারতের কারাগারে আটক জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের কয়েক ডজন সেনাকে মুক্তি দিতে হবে এবং তাদের পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে হবে।
দুদিনের উদ্বেগ ও লাহোরি আতিথেয়তার সমাপ্তি ঘটিয়ে গঙ্গার যাত্রীদের হোটেল গেটে অপেক্ষমাণ বাসে ওঠার নির্দেশ হলো। ফাইয়াজের কোনো ধারণা নেই, কোথায় যাচ্ছে।
দুদিন পর লাহোর এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের যে দূরত্ব, তার চেয়ে বেশি পথ যাত্রীরা সেই গাড়িতে পাড়ি দিয়েছে। তবুও বলা হয়নি গন্তব্য কোথায়। যখন বাস থামল, আমাদের বলা হলো, আমরা পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে এসে পৌঁছেছি। আমাদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে, হোসেইনওয়ালা সীমান্ত দিয়ে সবাই ভারতে ঢুকবেন।
হেঁটে যাত্রীরা সীমান্তরেখা অতিক্রম করে। তারা যখন নো ম্যানস ল্যান্ড অতিক্রম করছে, দীর্ঘদেহী ভারত ও পাকিস্তানি সীমান্ত প্রহরীরা তাদের গার্ড অব অনার দেয়। ভারত প্রান্তে পৌঁছালে ভালো চা-নাশতা দেওয়া হয়। মনে হলো, যুদ্ধে দুই পক্ষই জিতেছে।
আবার বাসে উঠিয়ে যাত্রীদের ফিরোজপুর বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে নেওয়া হলো। সেখানে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম সর্দার রিয়াসাত ডক্টর করণ সিং তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের কুশল জিজ্ঞেস করলেন এবং অভিজ্ঞতা শুনতে চাইলেন। ফাইয়াজ জানায়, তার কথা শুনে ডক্টর সিং কয়েকবার হেসে ওঠেন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ যাত্রীদের অমৃতসর নিয়ে যায়। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের স্টেশন ম্যানেজার ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা তাদের স্বাগত জানান। সেখানে যাত্রীদের দুই ভাগ করা হয়।
ঘটনার নাটকীয় মোড়: পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থা উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরিয়ে দিল। কাউকেই কাছাকাছি আসতে দেয়া হয়নি। এমনকি পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি আফজল আগাকেও নয়। তার আদি বাড়ি কাশ্মীরের শ্রীনগর।
হাশিম ও আশরাফ কুরেশি দুজনই গ্রেফতার হয়, তাদের বিচার হয় এবং বিশেষ আদালতে ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত হয়। ওদিকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বাধীনতার ডাক হয়ে আবির্ভূত হতে পারে।
নাটকীয় আরো কিছু ঘটতে থাকে।
ভারত তার আকাশসীমায় পাকিস্তানি উড়োজাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগ অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। শ্রীলংকা হয়ে পশ্চিম ও পূর্ব উপকূল পাড়ি দিয়ে আসতে হবে। আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা আসার পর পাকিস্তান গঙ্গা হাইজ্যাক ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। ভারতীয় উড়োজাহাজ হাইজ্যাকের ফাঁদ তৈরি করে দিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। পাকিস্তান এ ফাঁদে পা দিয়েছে, আর এটাকে কাজে লাগিয়ে গঙ্গা জ্বালিয়ে দেয়ার অপরাধে আকাশপথ রুদ্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
হাশিম ও আশরাফ চিহ্নিত হয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে। বিচলিত পাকিস্তান জম্মুু অ্যান্ড কাশ্মীর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট নেতা মকবুল ভাটসহ অন্যদের গ্রেফতার করতে শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে।
ভারতীয় বিশ্লেষকই জানাচ্ছেন:
১. উড়োজাহাজ হাইজ্যাক ছিল ‘র’-এর পরিকল্পনা।
২. গঙ্গা এয়ারলাইনসের প্রাচীনতম উড়োজাহাজের একটি, যা অপারেশন থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
৩. হাইজ্যাকে ক্ষতি ন্যূনতম রাখার জন্য গঙ্গাকেই আবার অপারেশনে আনা হয় এবং একটি অপারেশনই হাইজ্যাকে সমাপ্ত হয়।
৪. হাশিম কুরেশি শুরুতে ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্ট কিংবা ডাবল এজেন্ট ছিলেন।
৫. হাইজ্যাকার দুজন খেলনা পিস্তল ও ভুয়া গ্রেনেড দিয়ে হাইজ্যাক সফল করেন।
অবশ্য হাশিম কুরেশির দাবি, তিনি যা কিছু করেছেন, সবই করেছেন দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বাধীন কাশ্মীরের জন্য। খুশবন্দ সিং তার বইতে লিখেছেন, কাজটা । ভারতই করিয়েছে। এটাতো ঠিক, ২৫ মার্চের আগে হাইজাককে কেন্দ্র করে পাকিস্তানকে ভারতের আকাশপথ ব্যবহার করতে না দেবার এই সিদ্ধান্তই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোমর ভেঙ্গে দেয়। বাঙ্গালি দমনের জন্য, ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লড়াই করার জন্য উডোজাহাজে সৈন্য ও অস্ত্র পরিবহনের সম্ভাবনা একবারে হ্রাস পায়। যুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তানের পরাজয়ের ঘন্টা বেজে উঠলো।
[চলবে…]
১৯৭১ আন্দালিব রাশদী উড়োজাহাজ গঙ্গা জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ বিমান ছিনতাই মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা