শরৎবাবুর নাটকীয় নীল চিঠির বাক্স
২ জানুয়ারি ২০২০ ১৬:১৫
‘মাছ মিষ্টি এন্ড মোর’ বলে একটি ছবি দেখেছিলাম বেশকিছু বছর আগে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ডায়লগ মনে গেঁথে আছে ‘ছেলেরা মেলোড্রামা খুব পছন্দ করে, সেই আবহমানকাল থেকে। তাই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় is the most popular writer, even today.’ নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলেছিলাম।
তো মেলোড্রামা অল্পদস্তুর কে না পছন্দ করে- তা ছেলেই হোক কিংবা মেয়ে। আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জনপ্রিয় আজও-কালও। পরশুও থাকবেন। থেকে যাবেন।
যে শহরে এলাম ছুটি কাটাতে, সেটি তো শুধু শহর নয়। প্রিয় কিছু অস্তিত্বের বেঁচে থাকার শহর। ইচ্ছে থাকলে তো উপায় হয়। আমি তাই খুঁজে নিয়েছিলাম পথ, উপায়- পৌঁছে গেলাম ম্যাপ ধরে ধরে, অশ্বিনী দত্ত রোডে। কত পথ, বাঁক খুঁজে, আমি খুঁজে নিয়েছি, যা খুঁজছিলাম।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসভবন। ১৯৩৪ সাল থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এখানেই বাস করেছেন। ঢোকার মুখে লোহার গেটের পাশে, চিঠির বাক্স। নীল রঙের চিঠির বাক্স। আমি কখনো নীল রঙের চিঠির বাক্স দেখিনি আগে। আমি দাঁড়িয়ে দেখি, শরৎবাবুর নীল রঙের চিঠির বাক্স। কি ভীষণ নাটকীয় এক চিঠির বাক্স, নীল।
নিরঞ্জন বাবু আমাকে গেট থেকে এসে নিয়ে গেলেন ভেতরে, তিনি বাড়ির কেয়ারটেকার। আমার মনে হলো যেন এ বাড়ির আস্ত অতীতকে শরীরের বলিরেখার ভাঁজে ধারণ করে নিরঞ্জনবাবু বেঁচে আছেন। বয়স তার দৃঢ়তাকে টলাতে পারেনি একটুও ।
ঢোকার মুখে শরৎবাবুর মূর্তি অতিক্রম করে, মূল দালানে প্রবেশ করে বাম পাশে নিরঞ্জন বাবুর ছোট্ট অফিসরুম, আর সামনে এক চিলতে বারান্দা। অফিস বারান্দা তো প্রতিদিনের, একইরকম, পরিচিত, ছিমছাম। অফিস ছাড়িয়ে সামনে যাই। ডান পাশের দরজা দিয়ে ঢুকলে বড়সড় এক ঘর।
সে ঘরে ঢুকলাম, যে ঘরে নাকি রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্কিমবাবু এসেছিলেন এ বাড়িতে। বৈঠকখানা। লোকে বলে।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি। এমন করে দাঁড়িয়ে থেকেও যে কত কিছু ছুঁয়ে ফেলা যায়- সময়, অতীত, গল্প, ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলাম। দেয়াল জুড়ে ছবি, রবিবাবুর, শরৎবাবুর । কিন্তু সেই ঘরের গন্ধে যে মাদকতা তা স্বয়ংসম্পূর্ণ, ঘোর তৈরির জন্য। দেয়ালে ঝুলে থাকা বহুবার দেখা ছবি আমাকে আর টানেনা ।
শরৎবাবু ড্রামা পছন্দ করেন বটে। দোতলায়, শরৎ বাবুর যে ঘরটি তালাবন্ধ থাকে, তা খুলে দেবার পর, আমি ঢুকি। চমকে উঠি। দু পা পিছিয়ে যাই। ঢোকার মুখ বরাবর বাম দিকের দেয়াল ঘেঁষে ইজি চেয়ারে শুয়ে আছেন শরৎ বাবু আর পায়ের কাছে তার প্রিয় কুকুর।
পুরো ঘরে আমি একা একদম। আমাকে রেখে নিরঞ্জন বাবু নিচে নেমে গেছেন ততক্ষণে। কাছে যাই। এমন নিখুঁত করে, সাজানো এক পুতুল, যেন আস্ত শরৎ বাবু, আর তার প্রিয় কুকুর। যেন আরামকেদারায় শুয়ে শরৎবাবু দেখছেন এ জীবনের নাটক। চমক লাগে। তাই বলি, শরৎ বাবু, ড্রামা বড্ড পছন্দ করেন। তখনো, এখনো।
আমি স্মৃতির গন্ধ পাই। স্মৃতি, অন্যের গল্পে, শরৎ বাবুর গল্পে। যে স্মৃতির ধারক আমি নই। কিন্তু স্মৃতির গভীরের মনি-মানিক্যকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ঘরটিতে ঘুরে বেড়াই। আমি ছুঁয়ে বেড়াই, শরৎ বাবুর লেখা চিঠি প্রিয়জনদের কাছে। টুকরো লাইনগুলো বিঁধে যায় মগজে, মনে-
‘আমার হাতের লেখা বই। এ ছাড়া আর নেই। এ যেন তোমারই কাছে থাকে। তাহলেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো। – দাদা, ভাদ্র ১৩৩৩’।
নীল রঙের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট, কেমন জ্বলজ্বলে । দাগ পড়েনি একটু ও । ওই দূরবীনখানা, তা দিয়েই দেখতেন । দূরে, কাছে? জীবন? নাকি আরও দূরে? আমি তাকিয়ে দেখি । দেখি জুলাই ২৯, ১৯৩৬ সাল। দেখি University of Dacca থেকে পাওয়া Degree of Doctor of Literature এর সার্টিফিকেট খানা। এখনো কেমন রয়ে গেছে, বেঁচে আছে, ফুলতোলা আতরদানি, চশমা, আর এক আস্ত শঙ্খ- যেন তুলে নিয়ে নতুন করে আবার শুরু করা যায় তাদের সাথে।
আমি দেখি। দেখতে দেখতে ফিরে আসি, নিজের কাছে। নিচে নামি। টানা করিডোরে আলো ছায়ার খেলা। আমার হাতে থাকা শরৎ রচনাবলির (জন্মশতবার্ষিকী সংকলন) মতনই রঙিন, পুরনো।
নিরঞ্জন বাবু বলেন, ‘সেই, ২০০৩ সালের ১৩ই মার্চ, কাজ করে যাচ্ছি এখানে। ৭০ এর বেশি হলো বয়স আমার।’
বলি, থাকবেন?
তিনি বলেন, ‘যতদিন পারি। শরৎবাবুর থেকে আমার মুক্তি নেই।’
আমরা হাসি। আমি ফিরি। বের হবার মুখে, নীল ডাকবাক্সে চোখ পরে আবার । আবারও মনে হয় বড্ড নাটকীয় এই চিঠির বাক্স, দুপুর রোদের আলোমাখা। আমি কখনো, নীল চিঠির বাক্সে চিঠি ফেলিনি।
লিখি এবার, কাগজ-কালিবিহীন চিঠি, মনে মনে। পুরে দেই নীল চিঠির বাক্সে, ভাবনায়। আমার এ গল্প, সিনেমা হলে ব্যাকগ্রউন্ডে ভূপেন হাজারিকা বাজতো, ‘শরৎবাবু, এ চিঠি দিলাম তোমার কাছে …’। সিনেমা নয়। তাই গান বাজেনা। তবু আমি লিখি-
‘শরৎবাবু, এ চিঠি পাবে কি-না জানি না আমি ….’
আহা শরৎবাবু, তোমার থেকে আমার মুক্তি নেই ….