চন্দ্রদ্বীপের মায়ায়…
৭ জানুয়ারি ২০২০ ১২:৪৬
বরিশাল বা প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ নগরী ঘোরাঘুরি শেষ। গ্রাম না দেখলে কি আর দেশ দেখা হয়! এবার অবশ্য ঠিকঠাক নদীও দেখা হলো না। যে ঠান্ডা আর কুয়াশা, তাতে লঞ্চের ডেকে বসে আড্ডার বাহাদুরি অন্তত দেখানো গেল না।
আমরা সাতজন গুটিশুঁটি দিয়ে সারারাত আড্ডা দিলাম, তবে সেটা লঞ্চের উষ্ণ কেবিনে। মধ্য বয়স আমাদের (এটা আমাদের জন্য চমক, নিজেদের বয়স নিজেরাই বিশ্বাস করি না, আর বছর দশ-পনেরো ধরে এই একটা জিনিসে আমাদের বিরক্তি ধরেনি, তা হলো নিজেদের সঙ্গ। কোন ফিলোসফি ছাড়া, কোন উদ্দেশ্য ছাড়া কীভাবে যে নিজেদের সঙ্গের উপর নিজেদেরই এত আকর্ষণ তা আসলে বোঝার ব্যাপার নয়)।
একদিনের বরিশাল ভ্রমণের এই যাত্রায় গ্রাম দেখা হলো না, তাই শহরের একই রকম কাকলী শুনে সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের ফিরতি গমন। তবে বরিশাল পুরোপুরি শহরও নয়, শহরের ভেতর আটকে পড়া গ্রাম আছে বেশ!
তবে একটা কথা বলতেই হয়, বরিশাল শহরটা পরিস্কার। জলাধারেও ময়লা নেই, আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ জ্ঞানে তা ছিলো একটা চমক।
সকাল-সন্ধ্যা রেস্তোরাঁয় সকালের জলখাবার সেরে পাশের অনামী লেনে গিয়েছিলাম চা পান করতে। ‘অনামী লেন’, নামটা শুনেই মনটা নরম হয়ে ছিল কিছুক্ষণ। এর কারণও আছে, দলের বেশিরভাগ চট্টগ্রামের মানুষ আমরা। এখানে জায়গার নাম বাজার, বাদ কিংবা পুর দিয়ে শেষ হয়, বাণিজ্যের শহর বলে কথা! তাই অনামী লেন, নামটাই আমাদের বিহ্বল করে।
এরপর ব্যাটারিচালিত হালকা যান টমটমে চেপে এদিক-সেদিক ঘুরি আমরা। এর ওর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে মাহেন্দ্র নামের বিশেষ যান ভাড়া করে রওনা দিই দুর্গাসাগরের দিকে। কুয়াশামাখা দিনে যখন দুর্গাসাগর পৌঁছি তখন প্রায় মধ্যাহ্ন। মন জুড়ানো একটা টলটলে জলের দিঘী, তার মাঝে দ্বীপের মতো একটা জায়গা আর কিছু গাছ, দিঘীর চারপাশে হাঁটার রাস্তা। জানতে পারি, কবে কোন এক জমিদার খাবার পানির সমস্যার সমাধান করতে খুঁড়েছিলেন এই দিঘী। সেটি এখন পর্যটন কেন্দ্র, তার জলে অবারিতভাবে সাঁতার কাটে হাঁসের দল। এই হাঁসেরাই জীবনবাবুর কবিতায় ঘুরে বেড়াতো কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমার জানা নেই।
দুর্গা সাগরের পাড়ে বাঁধানো সিমেন্টের বেঞ্চিতে আমরা বসে থাকি। মানে আমি, প্রিন্স, সুজন, আসিফ, আরিফ, সৌরভ আর নীরা। সেখান থেকে আমাদের উঠতে ইচ্ছা করে না। আমরা পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলাই, আমরা মন খারাপ ভাগ করে নিই, আমরা স্মৃতির খাতা খুলে বসি। এই জলভরা দিঘী, তার ওপরে ঝুলে থাকা কুয়াশা, পানিতে হাঁসের জলকেলি, গোলাপি শাপলার সুখ, ঝরে পরা পাতার আওয়াজে আমরা বিভ্রান্ত হই। মনে হয় এটুকুই বুঝি পৃথিবী। তারপর কেউ একজন বাড়িতে রেখে আসা সন্তানের গল্প বলে, আমরা হেসে উঠি, আমরা আসলে বাস্তবে ফিরে আসি। দুর্গাসাগরের মায়া ফেলে আমরা বাইরের পৃথিবীতে পা বাড়াই।
দুপাশে অবারিত মাঠ আর ধানক্ষেত পাড়ি দিয়ে যাই গুঠিয়া মসজিদে। বিশাল এলাকা নিয়ে রঙিন মসজিদ, আকাশগামী মিনার আর নকশাকরা বিরাট কাঠের দরজা। প্রচুর পর্যটক আসেন এখানে। তারা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আর সিঁড়িতে বসে ছবি তোলেন। মসজিদের সামনেই পুকুর, সেখানে ওজু করেন অনেকে। চমৎকার বাঁধানো ঘাট। তবে সেই ঘাটে নারীদের বসা নিষেধ, সুন্দর সাদা ঘাটের বাঁধানো বেঞ্চি কেবল পুরুষদের জন্য। ‘এখানে মহিলা বসা নিষেধ’ লেখা ঘাটে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন পুরুষরা। আসিফের ছবি তোলার পর্ব শেষ হলে আমরা সেই মসজিদ প্রাঙ্গণ ছেড়ে আসি।
ঝটিকা সফরের পরের গন্তব্য শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ি। ছোট ছিমছাম একটা বাড়ি, তার সদর দরজা অবশ্য বন্ধ। পাশেই তৈরি করা হয়েছে জাদুঘর। সেখানে গিয়ে দেখা মেলে শেরে বাংলার অসংখ্য ছবির। আর ছিল তার ব্যবহৃত কিছু জিনিস। কাঁচের বাক্সবন্দি হয়ে ছিল একটি কুমিরের বাকল, সেটা কে যেন শেরে বাংলাকে উপহার দিয়েছিল। শের-ই-বাংলার ব্যবহৃত কিছু আসবাবও ছিল। যেমন, একটা সিঙ্গেল খাট, আরাম চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল ইত্যাদি। অবশ্য শেরে বাংলা এতো ছোট খাটে কিভাবে ঘুমাতের সেই প্রশ্ন তোলে বন্ধু প্রিন্স। এই প্রশ্নে সে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে জাদুঘরের কর্মীকে। আমরাও হাহা হিহি করতে করতে চাখারে বাংলার বাঘের স্মৃতির নড়বড়ে সংরক্ষণ দেখে শহরের পথ ধরি।
এখানে একটা জিনিসের কথা না বললেই অন্যায় হবে। সেটা হলো গরম গরম রসগোল্লা। শের-ই-বাংলার বাড়িকে হাতের ডানে রেখে দুই মিনিট হাঁটলেই একটা ছোট বাজার। সেখানের একটা আধভাঙা দোকান। তার পেছনের অংশে ভাঙাচোরা বেঞ্চে বসে খাওয়া কনডেন্সড মিল্কের চা, সিঙ্গারা আর গরম রসগোল্লা। যার স্বাদ লেগে লাগবে আরও বহুদিন।
আবার সেই মাহেন্দ্রতে চেপে শহরে ফিরি, কিছুক্ষণ বসে থাকি বিবির পুকুর পাড়ে। নগরীর মধ্যমনি হয়ে থাকা একটা জলাধার কিভাবে এতো পরিস্কার থাকে সেই আলোচনা করি, সন্ধ্যায় তিরিশ গোডাউনে হাঁটি, চটপটি-ফুচকা আর গরুর দুধের অতি সুস্বাদু চা পান করি। তারপর পিঠে ব্যাগপ্যাক দিয়ে একদল নারী-পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে লঞ্চঘাটে যাই। উঠে পড়ি যন্ত্রের শহরের পথের যাত্রায়।
এই পুরো সময় আমাদের মনে উঁকি দিয়ে গেছেন জীবনানন্দ দাশ। ম্লান বেতফল জলের নদী না দেখেই ফিরতি যাত্রায় তাই বুকের ভেতর খচখচ করে। কিন্তু ফিরতে তো হয়ই।
তবু ফিরে যাওয়া কষ্টের। মানুষ মূলত যাযাবর, যখন থেকে ঘর বানিয়ে এক জায়গায় থাকতে শুরু করেছে তখন থেকেই বৈচিত্র্য হারিয়েছে সে। যদিও এর জন্য অন্য সংস্কৃতিকে দুষেছে, রক্তারক্তি করেছে মানুষ।
এসব ভাবতে ভাবতেই থিতু হতে ঘরে ফিরে যাচ্ছি, অথচ নিজের ভেতরে আমি জানি, যাযাবর থেকে কয়েক পুরুষেও আমার একটুও বিবর্তন হয়নি। আমি আসলে এখনো যাযাবর, আমি সেটাই বিশ্বাস করি।
গুঠিয়া মসজিদ দুর্গাসাগর বরিশাল ভ্রমণ সকাল সন্ধ্যা রেস্টুরেন্ট