Tuesday 08 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উড়াও শতাবতী (২২) || মূল: জর্জ অরওয়েল || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন


১৩ জানুয়ারি ২০২০ ১৭:৫৪ | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১২:০০
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আগের অংশ || শুরু থেকে পড়ুন

মা যখন মারা যান তখন সে চব্বিশে পড়েছে। পরিবারটা তদ্দিনে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছিলো। কমস্টকদের আগের প্রজন্মের মোটে চারজন তখন বেঁচে- দুই ফুপু অ্যাঞ্জেলা ও শার্লো, চাচা ওয়াল্টার। এছাড়াও আরেক চাচা তখন বেঁচে ছিলেন যিনি ঠিক পরের বছরই গত হন। মায়ের মৃত্যুর পর গর্ডন ও জুলিয়া ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দিলো। ডটি স্ট্রিটে একটা আসবাবপত্রে সাজানো কামরা ভাড়া করলো গর্ডন (ব্লুমসবুরিতে বসবাস তার সাহিত্যকর্মের জন্য ভালো হবে এমন ভাবনা থেকেই)। আর জুলিয়া আর্ল’স কোর্টের দিকে বাসা নিলো তার দোকান থেকে কাছে হয় এই ভাবনায়। জুলিয়া ততদিনে প্রায় ত্রিশের কোটায়। আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে শুকনো-পাতলা, তবে গায়ে শক্তি-সামর্থ যথেষ্ঠ। আর চুলও ততদিনে কিছুটা ধুসর হয়ে উঠছে। এখনও দিনে বারো ঘণ্টা করে কাজ করে। আর ছয় বছরে তার মজুরি সপ্তায় মাত্র দশ শিলিং বেড়েছে। চায়ের দোকানটির মালিকিন তার বান্ধবীসম। আর সেই সুযোগে সবচেয়ে প্রিয়, প্রিয়তমা এসব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে জুলিয়ার ঘাম ঝরিয়ে কাজ আদায় করে নেয়। মায়ের মৃত্যুর চার মাস যেতে একদিন হঠাৎ নিজের কাজটি ছেড়ে দিল গর্ডন। ফার্মকে কোনও কারণ না দেখিয়েই কাজ ছাড়লো। ওরা ভাবলো হয়তো ভালো কিছু পেয়ে গেছে সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত। ওরা তাকে বেশ যুৎসই একটা রেফারেন্সপত্রও দিলো অন্য চাকরি পেতে কাজে দেবে এই ভেবে। কিন্তু নতুন একটি চাকরি খোঁজার কথা ভাবনাতেও আনলো না গর্ডন। ভাবলো ওসব ভাবলে চলবে না, অর্থই সব অনর্থের মূল। এবার থেকে খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচবো।

বিজ্ঞাপন

এমনটা নয় যে, সচেতনভাবেই সে অপেক্ষা করছিলো, মা চলে গেলে তবেই চাকরিটা ছাড়বে। তবে এও সত্য মায়ের মৃত্যুই তাকে চাকরিটা ছাড়ার পথ পরিষ্কার করে দিল। আর বলাই বাহুল্য তার এই সিদ্ধান্তে পরিবারে আরেক দফা ঘৃণা-সমালোচনা-কটুকাটব্যের ঝড় বয়ে গেলো। ওরা ভাবলো গর্ডন নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে। বারংবার চেষ্টা করেও সে ওদের বোঝাতে পারলো না ভালো চাকরির নামে এই দাসত্ব তার পছন্দ নয়। ওদের সবার একটাই প্রশ্ন- তাহলে তুমি বাঁচবেটা কীভাবে? খাবেটা কী? এসব নিয়ে সে ভাবতেই যে চায় না, তা ওদের বলেছে। তবে কী করে খেয়ে পরে বাঁচবে সে কথা ওদের কোনওভাবেই বলতে চায়নি। মনের গভীরে তখনও তার সেই সুপ্ত বাসনা- একদা লিখেই চলবে তার জীবন, অর্জিত হবে জীবিকা। তদ্দিনে র‌্যাভেলস্টোনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়ে গেছে। অ্যান্টিক্রাইস্টের সম্পাদক। তো এই র‌্যাভেলস্টোনই তার কবিতা এক-দুটো ছাপছেন, আর মাঝে মধ্যে অন্য কারো বই রিভিউ করার কাজও দু-চারটা যুগিয়ে দিচ্ছেন। তার সাহিত্য প্রতিভাও ততদিনে ঠিক সেই ছয় বছর আগের মতো আর প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই। তার মানে এই নয় যে- লিখেই খাওয়া জুটবে এমন ইচ্ছার বাস্তবায়নও পথ পেয়ে গেছে। তবে, ওই যে অর্থের জগৎটা থেকে বের হয়ে আসার বাসনা- সেটা তার পুরোই পূরণ হয়েছে। দিব্যচোখে সে একটি অর্থবিবর্জিত, একাকীত্বের জীবন যাপনের দীর্ঘ পথ দেখতে পাচ্ছে। তাতে তার একটা বোধ স্পষ্ট হয়েছে- সত্যিই যদি তুমি অর্থের ঝনঝনানি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারো- তোমার জীবনের পথচলা তাতে কোনওভাবেই থেমে থাকবে না। পাখি যেমন দুটো ডানা মেলে আকাশে ভেসে থাকে তেমনি এক মুক্তবিহঙ্গের জীবন সেটা। আকাশের মুক্তবিহঙ্গকে ঘরভাড়া গুনতে হয় না সেকথা সে ভুলে গেলো। যে কবি ক্ষুধা পেটে বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় পড়ে থাকে- তার সেই ক্ষুধা কোনও অস্বস্তির কারণ হয় না- নিজেকে নিয়ে এমনটাই ভাবনা তার।

পরের সাতটি মাস ছিলো ভয়াবহ। ওরা সবাই মিলে ভীষণ ভয় দেখালো; তার সকল চেতনাবোধকে প্রায় ভেঙ্গে দিলো। আর সেও শিখে নিলো বেঁচে থাকতে হলে রুটি-মাঞ্জারিনের দরকার আছে। লিখে পেট চালাতে চাইলে তোমাকে না খেয়েই থাকতে হবে। পরিধানের কাপড়গুলো ভাঁজ খুইয়ে কুঁচকে শ্রীহীন হবে। তিন সপ্তাহের ভাড়া যখন বাকী পড়বে, তখন কান পেতে থাকা বাড়িওয়ালীকে এড়িয়ে পা টিপে টিপে ভাঙতে হবে ঘরে ফেরার সিঁড়ি। ঠিক এসবই ঘটে গেলো গর্ডনের জীবনে। উপরন্তু সাত মাসে বস্তুত তার লেখা হলো না কিছুই। দারিদ্র চিন্তাশক্তির হন্তারক। সেও বুঝে নিলো, হতে পারেন হতদরিদ্র তাও আপনার দুটো টাকাই দরকার। প্রাকারান্তরে আপনি আসলে অর্থের এক নির্বোধ দাস। অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না আপনার-সাচ্ছন্দ্য না আসছে। মধ্যবিত্তের মগজে ভীষণ ফালতু এ শব্দটিই সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খায়। একরাতে ঝগড়াঝাটি নোংরামির পর্যায়ও ছাড়িয়ে গেলো, আর এক ঝটকায় ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। এরপর একটানা তিন দিন ও চার রাত সড়কেই কাটলো তার। রাতেই বাঁধের ধারে এক বৃদ্ধের সাথে দেখা। তারই পরামর্শে পরের তিনটি সকালই তার কেটেছে বিলিংসগেটে। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে বিলিংসগেট থেকে মাছের ট্রলি ঠেলে ইস্টচিপে নিয়ে যাওয়ার কাজ। একটি ট্রলি ঠেলে উঠালেই দুই পেন্স। কিন্তু সে কাজে তার দুর্বল পেশিগুলো ব্যাথায় মুষড়ে যেতো। সে কাজেও লোকের কমতি ছিলো না, ফলে সুযোগ পেতে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষ করতো হতো কখন নিজের পালা আসে। সেভাবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ভোর চারটায় শুরু করে সকাল নয়টা নাগাদ আট পেন্স হয়ে যায়। এভাবে তিনটি ভোর কাটিয়ে সে কাজ ছাড়লো গর্ডন। আর সম্ভব হচ্ছিলো না। অবশেষে ঘরে ফিরে গেলো আর কিছু ধার-কর্জ করলো একটা ভালো কাজ খুঁজে নেবে এই ভরসায়। কিন্তু কাজ পাওয়া কী এত সহজ? এরপর মাস কয়েক তাকে পরিবারের গলগ্রহ হয়েই বেঁচে থাকতে হালো। জুলিয়া তার জমানো শেষ পেনিটি পর্যন্ত গর্ডনের জন্য ব্যয় করলো। কী ভীষণ ন্যাক্কারজনক এক ব্যাপার। তার সকল সুন্দর ভাবনার এই পরিণতি। অর্থের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘোষণার একটাই ফল, আজ বোনের অনুগ্রহে তার জীবন ধারণ। সে জানে জুলিয়া মোটেই তার নিজের জমানো অর্থটুকু শেষ হয়ে গেলো বলে চিন্তিত নয়, বরং তার চেয়ে বেশি কষ্ট তার এই ভেবে যে, ভাইটির কোথাও কিছু হলো না। তবে গর্ডনকে নিয়ে এখন তার অনেক প্রত্যাশা। সকল কমস্টকদের মধ্যে সে একাই সাফল্য বলে আনতে পারবে এমনটা ভাবে জুলিয়া। এখনও তার মনে আশা একদিন পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করবে তার ছোট ভাইটি। কিন্তু গর্ডনের নিজের চাতুর্যের অন্ত ছিলো না। এমন নয় যে, চেষ্টা করলে কিছু টাকা সে কামাই করতে পারতো না। সে চেষ্টাটিও না করে গোটা দুই মাস সে হাইগেট এলাকায় ফুপু অ্যাঞ্জেলার ছোট্ট কামরা ঘরটিতে পড়ে থাকলো। বেচারি ফুপু, যে নিজেই নিজের ভাত যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তার ওপরই অত্যাচার চালালো গর্ডন। তবে এই সময় কাজ যে গর্ডন খোঁজেনি, তা নয়। বলা যায় ভীষণভাবেই খুঁজেছে। চাচা ওয়াল্টার এবার আর সহায়তা কিছু করতে পারলেন না। ব্যবসা জগতে তার প্রভাব কখনোই এতবেশি কিছু ছিলো না, আর এখনতো তা শূন্যের কোটায়। অবশেষে, এক অপ্রত্যাশিত পথে ভাগ্যের চাকা ঘুরলো। জুলিয়ার নিয়োগকর্তার এক বন্ধু, তারও এক বন্ধু- তারই ভাই গর্ডনকে একটা কাজ পাইয়ে দিলেন। নিউ অ্যালবিয়ন পাবলিসিটি কোম্পানির হিসাবরক্ষণ বিভাগের কাজ। দ্য নিউ অ্যালবিয়ন ছিলো সেইসব প্রচারধর্মী প্রতিষ্ঠানের একটি যেগুলো যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গজিয়ে উঠেছে, আর ছত্রাকের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বলা যেতে পারে, ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের প্রেক্ষাপটেই এর উত্থান। ছোট একটা উদীয়মান ফার্ম। ফলে বাছ-বিচার ছাড়াই যে কোনও কিছুর প্রচার-প্রচারণার কাজ, যা পায় তা-ই হাতে নেয়। ওটমিল, গমজাতীয় পণ্য এসবের বেশ কিছু পোস্টার ডিজাইন করেছে ওরা। তবে মূল কাজ হচ্ছে নারীদের ব্যবহার্য্য বিভিন্ন ফিতা-ঝালর ইত্যাদি আর প্রসাধনী সামগ্রীর বিজ্ঞাপন তৈরি। এছাড়া সপ্তাহে দুই পেনি দরে ছোটখাটো বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করে। যেমন ধরুন মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক প্রতিকারে হোয়াইটাররোজ পিল, প্রফেসর রারাটোংগো জানাচ্ছেন আপনার রাশিফল, শুক্রের সাত রহস্য, রাপচার্ডদের জন্য নতুন আশা, আপনার বাড়তি সময়ে সপ্তায় বাড়তি পাঁচ পাউন্ড আয়, সিপ্রোলাক্স হেয়ার লোশন সকল অপ্রত্যাশিত অনুপ্রবেশকারী ধ্বংস করে ইত্যাদি। কমার্শিয়াল আঁকিয়ের সংখ্যাই বেশি। এখানেই রোজমেরির সঙ্গে গর্ডনের প্রথম পরিচয়। চলবে…

উড়াও শতাবতী কিপ দ্য অ্যাসপিডিস্ট্রা ফ্লাইং গর্ডন গর্ডন কমস্টক জর্জ অরওয়েল মাহমুদ মেনন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর