একটি অপঠিত কবিতা ও নক্ষত্র কথা
২৭ জানুয়ারি ২০২০ ২১:৪৪
আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। আমার স্যার। স্যার সম্পর্কে কিছু লেখা, স্যারের সৃজনশীলতা নিয়ে কিছু বলা সত্যিই কঠিন কাজ। অনেকটাই দুঃসাধ্য। হয়তো ধৃষ্টতার সামিলও। তবে ‘নক্ষত্র নিভে যায়’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার পর ভীষণ তাগিদ অনুভব করেছি কিছু একটা লেখার।
বিশেষ করে অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে একটি কবিতা পাঠের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে স্যার যখন আর পারলেন না… অপঠিতই থেকে গেল একটি কবিতা। তখন সিদ্ধান্তে স্থির হলাম। ভালো হোক, মন্দ হোক একটি অপঠিত কবিতার কথা লেখা আমার কর্তব্য।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ছোট্ট একটি জমায়েত। তাতে উপস্থিত বেশির ভাগই শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী। উদ্দেশ্য একটি কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন।
বইটি লিখেছেন আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। লেখকের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম দুর্যোগের বিষয়ে সবাই অবগত। একটি বিয়োগান্তক ঘটনা একজন মানুষের জীবনকে কিভাবে ক্ষণে ক্ষণে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে, দগ্ধ করতে পারে তার প্রতিচ্ছবি আমরা প্রায়ই দেখতে পাই স্যারের অবয়বে, শূন্যে ছড়িয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে।
নুষ্ঠানের শুরুতে একজন বিদগ্ধ আলোচক বললেন, ‘আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী বেদনা বহন করেন। বেদনা ধারণ করেন। তবে ছড়িয়ে দেন ভালোবাসা, জীবনবোধ।’ কী অসাধারণ মূল্যায়ন! স্যার কিভাবে, কতদিন ধরে কী গাঢ় নীল বেদনা বহন করছেন তা সবারই জানা। একটি সম্পর্ক, একটি দৃশ্যমান ছিঁড়ে যাওয়া বন্ধনের (প্রকৃত বন্ধন অনন্তকালের) প্রতি মানুষ কতটা অনুরাগ প্রকাশ করতে পারে, কিভাবে প্রকাশ করতে পারে তা স্যারকে না পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারা সম্ভব নয়।
‘নক্ষত্র নিভে যায়’ একটি কবিতার বই। একটি জীবনের গল্প। জীবন অনুভূতির প্রকাশ। এই গল্পের অন্যতম চরিত্র প্রয়াত অধ্যাপক ড. সিতারা পরভীন। স্যারের সহযাত্রী, স্যারের জীবনসঙ্গী। জীবনের চলার পথে প্রাণসঙ্গীর হঠাৎ ভিন্ন পথে চলে যাওয়া ছিন্ন ভিন্ন করেছে তাঁর জীবনের ছক। যারই খণ্ডচিত্র পাওয়া যাবে ‘নক্ষত্র নিভে যায়’ বইতে।
‘খোয়ানো শব্দের লেশ’ ও ‘শোক ও দ্রোহের শ্লোক’ এই দুই ভাগে বিভক্ত বইটিতে স্থান পেয়েছে ৮৮টি কবিতা। যাতে আছে ‘শেষ চুম্বন’ এর মতো মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তির প্রকাশ। যেখানে একজন বেদনার্ত মানুষ ঈর্ষা করছেন পথের অতি সাধারণ ধূলিকণাকে। ভিন দেশের, অজানা-অচেনা পথের যে ধূলিকণা পেয়েছিল লেককের প্রিয় মানুষটির অনুভবের শেষ নির্যাস, শেষ আলিঙ্গন, আবেগের শ্রেষ্ঠতম মন্থন, উষ্ণতার শেষ চুম্বন। (পড়তে পারেন ‘শেষ চুম্বন’, পৃষ্ঠা: ১৯)
আবার অন্য অংশে আপনাকে স্পর্শ করতে পারে একজন অ্যালবার্টের স্বপ্নের কথা। যে অ্যালবার্ট চার দশক ধরে বন্দি অ্যাঙ্গোলার জেলখানায়। নয় ফুট বাই ছয় ফুট সেলে যার জীবন কাটে। প্রতিদিন বন্দি ২৩ ঘণ্টা। যে অ্যালবার্ট বয়ে বেড়াচ্ছে মাকে গুডবাই বলতে না পারার হেভিওয়েট। (পড়তে পারেন ‘অ্যালবার্ট এখনো স্বপ্ন দেখে’, পৃষ্ঠা: ৭৯)
একইসঙ্গে এই কবিতার বই আপনাকে স্বল্প পরিসরে হলেও পরিচয় করিয়ে দেবে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, পাবলো নেরুদা, হিমাদ্রী শিখরের কাজী নজরুল, একজন অনন্য রবীন্দ্রনাথ ও বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ঢাকা শহরের সঙ্গে। আর যারা স্যারকে চেনেন, সিতারা ম্যাডামকে জানেন, জানেন তাদের জীবনের অসমাপ্ত গল্পটা তারা এই বইয়ে খুঁজে পেতে পারেন ভিন্ন এক জীবনবোধ।
অনুষ্ঠানে সব গুণী ও বিদগ্ধ আলোচক কবিতার কথা বলেছেন। কবির কথা বলেছেন। তবে মূল কথাটি, প্রকৃত অভিব্যক্তিটি প্রকাশ করার কথা ছিল কবির নিজের। তিনি চেষ্টা করলেন। ‘দূর আলাপনের ব্যবস্থা নেই’ পাঠ করবেন বলে ঘোষণাও করেছেন। কিন্তু তিনি পারলেন না। হল ভর্তি শ্রোতার সামনে জীবনের গভীরতম বেদনাদায়ক অনুভূতি তিনি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হলেন। ততক্ষণে মিলনায়তনে উপস্থিত শ্রোতাকূল আচ্ছন্ন হয়েছেন, বেদনার্ত হয়েছেন অন্য চিন্তায়। কারো অশরীরী উপস্থিতির অনুভবে।
শ্রোতাদের অনেকের চোখের কোণে তখন জল। সবাই যেন আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীর সেই
অপঠিত কবিতাটি পাঠ করছেন মনে মনে…
‘সান্ধ্য ভ্রমণে অচমকা প্রশ্ন
করেছিলাম তোমাকে
কত দিন বাঁচতে ইচ্ছে হয় তোমার?
তুমি উত্তর দাও নি
বড় অস্বস্তি হয়েছে আমার।
কিছু একটা বলতে পারতে,
‘বহুদিন বাঁচতে ইচ্ছে হয়
কিংবা বেশি বেঁচে কী লাভ,
তুমি উত্তর দাও নি।
কদিন পরে ভোরে
হুড়মুড়িয়ে উঠে বললে
বাজে স্বপ্ন দেখেছি
কী স্বপ্ন বলো নি,
অস্থির ছিলে তুমি।
এরপর গেলে দূরে,
দূর আলাপন হয়েছে বার দুই,
ভীষণ ক্ষীণ ছিল কণ্ঠ তোমার,
শঙ্কা বিঁধেছিলো বুকে আমার।
এক গভীর রাতে
বেজে উঠল টেলিফোন,
না, তোমার কণ্ঠ নয়,
অন্য কণ্ঠ
শীতল অনুভূতিহীন।
শোনা গেল
আরও দূরে গেছো তুমি,
যেখানে অরণ্য আছে
অরণ্যের ধারে হরিণীরা ঘোরে,
হরিদ্রাভ ফুলে ছেয়ে আছে মাঠ,
সমুদ্র আছে নীলাভ পাহাড় আছে,
আছে অজস্র পরিযায়ী পাখির ভীড়,
যা যা তুমি ভালোবাসতে
তার সবকিছু আছে সেখানে,
কবে ফিরবে ঠিক নেই।
সেই থেকে অপেক্ষা,
ছায়াচ্ছন্ন অধ্যায়টা
পড়ার চেষ্টা করছি,
তুমি স্বল্পভাষী ছিলে,
কিন্তু এতটা না,
এই দূরটা একটু বেশি দূর,
ধারে কাছে কোথাও
দূর আলাপনের ব্যবস্থা হয়তো নেই।’ (পৃষ্ঠা:১৩)
অপঠিত এই কবিতাটি মর্মে বেদনা জাগায়। প্রিয়জন বিয়োগের ভিন্ন আবেশ অনুভূত হয়। এক সাথে সামনে তুলে আনে একটি প্রিয় মুখ। একটি নক্ষত্র, একটি সিতারা, একজন সিতারাকে। যে সিতারা নিভে যায়, আবার নেভে না। যে নক্ষত্র দিনের আলোয় আড়ালে থাকে, আবার রাতে আলো ছড়ায় স্বমহিমায়। এই নক্ষত্র, এই সিতারার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিগুলো চির সজীব থাকুক। এই নক্ষত্রের সঙ্গে দূর আলাপনের যোগাযোগ স্থাপিত হোক, এই পৃথিবীতে অথবা নক্ষত্রলোকে। একজন কবির প্রতি এই শুভ কামনা। (শেষ)
লেখক: অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী ও সিতারা পারভীনের ছাত্র।