আছে এবং নাই ও কিযীপাঠের নানা দিক
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২১:৩৫
আচ্ছা ‘নাই’ এর সাথে কি আরেকবার দেখা হবে ‘আছে’র? ‘আছে এবং নাই’ গল্পটির দ্বিতীয় শেষ প্যারা পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে ঠিক এই প্রশ্নটিই মাথায় এলো। কেবল পাঠক বললে ভুল হবে, একটু সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই পড়তে শুরু করেছিলাম ‘আছে এবং নাই’। ফলে মনে মনে ভাবছিলাম, যদি আরো একবার দেখা করানো হয়, ধরেই নেবো লেখক আরোপিতভাবে তার এই গল্প রচনা করেছেন, অকারণে কলেবর বাড়িয়েছেন। আর তা হলে বেশ কষে সমালোচনা করা যাবে। কিন্তু তা হয়নি। অতি সাবলীলভাবে, পরিমিতবোধের চূড়ান্ত প্রকাশ দেখিয়ে দ্বিতীয় দেখাতেই ‘আছে’ এবং ‘নাই’ কে নিয়ে গল্পটি শেষ করেছেন কিযী তাহনিন।
কিযী লেখেন ভালো। তার অনেক লেখা সারাবাংলায় ছাপা হয়েছে, কিযী’র জানালা থেকে কলামে। আছে এবং নাই’রও একটি দুটি গল্প সে জানালাপথ গলিয়ে সারাবাংলার পাঠকের কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু বই হয়ে ‘আছে এবং নাই’ যখন বেরুলো বলে খবর পেলাম সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে, তখন কেনো যেনো বইটি হাতে পাওয়ার ইচ্ছা তীব্রভাবেই কাজ করছিলো। সেটি হয়তো কিযীপাঠে আমার পূর্বমুগ্ধতা একটি কারণ হতে পারে। তবে মূল কারণ বোধ করি এটাই- কিযী তাহনীনের লেখা পড়লে সেটা কেবলই আনন্দপাঠ হয়ে থাকে না, লেখাগুলো খুব ভাবায়।
গল্পকার নিজেই অফিসে এসে বই দিয়ে গেলেন, সে আমি তার মুগ্ধ পাঠক বলেই। বই হাতে পেয়ে দেরি না করে পড়তে শুরু করলাম। আর প্রথম গল্পটি পড়েই এই ধারণায় উপনীত হলাম যে, হ্যাভস ও হ্যাভ নটসদের মধ্যে মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব-সম্পর্ক এই গল্পে ফুটে উঠেছে। এবং দারুণ হয়েছে।
প্রথম গল্পটির নামেই বইয়ের নাম। ভেবেছিলাম- আছে এবং নাই বিষয়ক গল্পের নটে গাছটি বুঝি এখানেই মুড়লো। কিন্তু পাতা উল্টে দ্বিতীয় শিরোনামে যখন ‘আছে- নাই’র আকাশ দেখার গল্প’ কথাটি পড়লাম, ভাবলাম- ও আচ্ছা! এতো দেখি একই গল্প টেনে নিয়ে যাওয়া! পাঠক মাত্রই নড়ে চড়ে বসবে। আমারও সে দশা। ধুম করে পড়ে ফেললাম দ্বিতীয় গল্পটিও। ভাবলাম এটাতো গল্পের বই নয়! এতো রীতিমতো উপন্যাস ফেঁদেছেন গল্পকার কিযী।
সেই ঘোর নিয়ে যখন একের পর এক পড়লাম আছে নাই’র হাওয়াই মিঠাই বসন্ত, আছে নাই’র অন্যদিনের বন্ধুদিন কিংবা আছে নাই’র নতুন দেখা… তখনও উপন্যাসের পাঠক হয়েই পড়ছিলাম বইটি। কিন্তু এই নতুন দেখার কাহিনীটি ঘোর ভাঙ্গালো।গল্পকারকে ঔপন্যাসিক ভাবাটা ভুল শুধু নয় ঘোর অন্যায়! ফলে ঘোর যেমন ভাঙলো, ভুলও ভাঙলো। এবার দৈবচয়নে পাঠ শুরু। ছোট ছোট গল্প এক একটা পড়তে সময় লাগলো না। বুঝে নিলাম- এ কোনও উপন্যাস নয় নিপাট গল্পের বই। ছোটগল্প। এবং আছে এবং নাই এর প্রতিটিই আলাদা আলাদা গল্প। তবে একটি সূতোয় গাঁথা।
এই বইয়ে আছে আর নাই কে মাথায় রেখে কিযী কত কী যে লিখেছেন, তার ইয়ত্তা নাই। সমাজ সঙ্কটের নানা দিকই উঠে এসেছে গল্পে। তাতে তিনি নাই’র মধ্যে যা আছে তা যে আছে’র মধ্যে নেই তাও স্পষ্ট করে দেখাতে পেরেছেন। বোঝাতে পেরেছেন, নাইদেরও থাকে অনেক কিছু, যা আছেদের থাকে না।
বইটির শেষ প্রচ্ছদে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যথার্থই লিখেছেন, গল্পগুলি শেষ হয় এক-একটা আত্মদর্শনের মধ্য দিয়ে। অনেক সময় সূক্ষ্ম অনুধাবনকে কিযী যখন মূর্ত করেন, মনে হয় তিনি একটি কবিতা লিখছেন।
আরেব্বাহ! গল্পের বইকে একবার মনে হলো উপন্যাস, সেখান থেকে আবার গল্প। আর দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই লেখাগুলোকে বলছেন কবিতা। একেই বুঝি বলে সাহিত্য সৃষ্টি। আর সেটাই দারুণ দক্ষতায় করেছেন কিযী তাহনীন।
বই যখন দিতে এসেছিলেন, ধরেছিলাম কথার প্যাঁচে। এই যে গল্প-টল্প লিখছেন, এগুলো কী লিখতে হবে বলে, বই মেলায় বই আনতে হবে বলে লেখা? গল্পকারের দাবি- না, গল্পগুলো প্রথমে আমার মনে আসে! মনের ভেতরে ঘুরপাক খায়। খেতে থাকে খেতে থাকে। অবশেষে একবার বসে লিখে ফেলি।
ছোট বাক্যে, ছোট ব্যাঞ্জনায় বড় বড় ভাব প্রকাশ করছেন, এমনটাই দেখি আপনার লেখায়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও লিখেছেন আপনার গল্পগুলো প্রচলিত চিন্তা ও ফর্মের বাইরে গিয়ে লেখা। কীভাবে লেখেন?
ছোটবেলা থেকেই লিখি, কিন্তু তা কখনো কোনও ফর্ম মেনে নয়, কিংবা ভেবে চিন্তে ফর্মের বাইরে গিয়েও নয়, এমনটা হয়ে যায়। আমার লেখাটাই বুঝি এমন।
সাহিত্য সৃষ্টিতে এমন ছোট ছোট বাক্যে লেখা একটা ধরণ। বড় বাক্যে, বড় অনুচ্ছেদে, বিরাম চিহ্নের ব্যবহারে একবাক্যে অনেক কথা বলারওতো একটা ধরণ আছে, আপনার লেখার তার অনুপস্থিতিই দেখি। সেটাও কী ইচ্ছা করে?
সেটা ঠিক জানি না। আমি আসলে সাবলীল করে, বোধগম্য করে লিখতে চাই। কঠিন দিকগুলো এড়িয়ে যেতে চাই, সে কারণেই বোধ হয় এমন হয়। তবে বড়বাক্যে কিংবা একবাক্যে অনেক কথা বলেও লেখাকে সাবলীল করে তোলা যায়, বোধগম্য করে রাখা যায়। অনেক সাহিত্য সৃষ্টিতে আমরা তেমনটা দেখেছি। আমি কখনো চেষ্টা করিনি, তবে করে দেখা যেতে পারে। আশা করি সেটাও আমি পারবো।
খুব প্রয়োজন রয়েছে কি? কিযীর লেখার একটি ধরণ আছে। মোটে দুটি গল্পগ্রন্থই তার ছাপা হয়েছে। তাতেই সে ধরণটা পাঠকদের সাথে পরিচিত হয়েছে, সমাদৃতও হয়েছে। কেউ যদি ‘ইচ্ছের মানচিত্র’ পড়ে থাকেন, আবার অনেক পরে ‘আছে এবং নাই’ পড়েন তাহলে লেখায়, ভাষায়, বাক্য বিন্যাসে আর শব্দ চয়নেই কিযীকে খুঁজে পাবেন। সেটাই বোধ করি এখন সাহিত্য রচয়িতার জন্য সবচেয়ে বড় কথা।
কিন্তু আমার মতো যারা একবার গল্পগুলো পড়েই ভাববেন, কিযীকে বুঝে ফেলেছেন, তারা আমার মতোই ভুল করবেন। কারণ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, কিযীর গল্পগুলো অনেকবার পড়ার জন্য।
আর সেটাই বুঝি কিযীপাঠের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ।
ও- আচ্ছা! জানিয়ে রাখি- ‘আছে এবং নাই’ প্রকাশ করেছে সমাবেশ। পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ। লেখক নিজে এসে বইটি দিয়ে গেছেন পড়ার জন্য- তার প্রতিদান হিসেবে এইটুকু বিজ্ঞাপন করা যায় বৈকি!