Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উড়াও শতাবতী (৬) মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন


২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৭:৪১

<< শুরু থেকে পড়তে

বাইরে পিচ্ছিল সড়ক আরও ধূসর ও বিষণ্ন লাগছে। কোণার দিকে, কোথাও থেকে ঘোড়ার খুড়ের খট খট শব্দ আসছে, শীতল ফাঁপা শব্দ। বাতাসে ভেসে আসা চিমনির ধোঁয়াগুলো দিক পাল্টে বৃষ্টিভেজা ছাদগুলোর উপর ছড়িয়ে পড়ছে। আহ! শার্পলি দ্য মেনাসিং উইন্ড সুইপস ওভার দ্য বেন্ডিং পপলারস, নিউলি বেয়ার। অ্যান্ড দ্য ডার্ক রিবনস অব দ্য চিমনিজ ভিয়ার ডাউনওয়র্ড টামটি টামটি (সামথিং লাইক ‘মারকি’) এয়ার।

খারাপ না। তবে কবিতার তাড়নাটা একটু গতি হারিয়েছে। চোখ গিয়ে ফের পড়লো সড়কের ওপারে বিজ্ঞাপনী পোস্টারগুলোর উপর। এগুলো দেখে তার হাসিই পায়। এত দুর্বল, এত প্রাণহীন, এত অখাদ্য। কিন্তু ভাবখানা যেন দেখেই যে কেউ আকর্ষণ বোধ করবে! পিশাচিনীর সুন্দর সাজের মতো।

এগুলো তাকে হতাশই করে। টাকার গন্ধ! আসলে সর্বত্রই টাকার গন্ধ। এক ফাঁকে লুতুপুতুকে এক নজর দেখে নিলো। কবিতার তাক থেকে ততক্ষণে সে সরে গেছে। বরং রাশান ব্যালের ওপর দামি একখানা বই তার হাতে। ঠিক হাতেও না, গোলাপি আঙুলগুলো উঁচু করে তার ওপর আলগোছে ধরে রাখা। কাঠবেড়ালি যেভাবে বাদাম ধরে রাখে সেভাবে ধরে সে-ও বইয়ের ছবিগুলোই যেন অধ্যয়ন করছে। গর্ডন এদের ধরনটা ভালোই জানে। পয়সাওয়ালা ‘শিল্পীসুলভ’ তরুণ। নিজে শিল্পী নয় ঠিক, তবে শিল্পের কদর বোঝে। স্টুডিওতে যায়, স্ক্যান্ডালের খোঁজ-খবর রাখে। সুদর্শন বালক, তবে তারমধ্যে লুতুপুতু ভাবটাই প্রকট। ঘাড়ের কাছে ত্বক বেশ রেশমি-মসৃন ঠিক ঝিনুকের খোলের ভেতরটার যেমন। বছরে পাঁচ শ’র কম আয় নিয়ে এমন ত্বকের অধিকারী হওয়ার সুযোগ নেই। ওর মধ্যে একটা আকর্ষণ রয়েছে, এক ধরনের চাকচিক্যও বর্তমান, পয়সাওয়ালাদের ঠিক যেমনটা থাকে। অর্থ আর চাকচিক্য সে তো একে অপরের। কেউ কাউকে আলাদা করতে পারবে না।

বিজ্ঞাপন

র‌্যাভেস্টোনের কথা মনে পড়লো গর্ডনের। কেতায় দুরস্ত, ধনে অঢ্য বন্ধুটি তার। অ্যান্টিক্রাইস্ট’র সম্পাদক। গর্ডনকে কাছের বন্ধু বলেই জ্ঞান করে সে। তবে দেখা হয় কালেভদ্রে। আর রোজমেরি! সেও। গর্ডনের গার্লফ্রেন্ড। মনে হয়ে গেলো তার কথাও। কথায় কথায় ভালোবাসার বুলি আওড়ায়, বলে খুব ভালবাসি তোমাকে। কিন্তু গর্ডন খুব জানে, সে-ও ওই একইরকম। এ পর্যন্ত কোনো একটি দিনও তার সঙ্গে বিছানায় যায়নি। আসলে অর্থ, আরও একবার তার মনে হলো, অর্থই সব। মানবকুলের সকল সম্পর্কই আসলে টাকা দিয়ে কিনতে হয়। তোমার পকেট ফাঁকা থাকলে, পুরুষরা তোমাকে পাত্তা দেবে না, নারীরা তোমাকে ভালোবাসবে না। যেটুকু ভালোবাসা কিংবা যত্ন দেখবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। আসলে কি! বোধ হয় ওরাই ঠিক আছে। অর্থহীনেরা অপ্রেমযোগ্য। আমি যতই ভালো মানুষের মতো, দেবদূতের মতো কথা বলি না কেন, আমার পকেট ফুকো হলে সেসব কথার কোনোই মূল্য নেই। আবারও বিজ্ঞাপনের পোস্টারগুলোর দিকে চোখ যায় গর্ডনের। এবার সত্যিই ওগুলোর ওপর প্রকট ঘৃণাবোধ কাজ করছিল তার। বিশেষ করে ভিটামল্ট’র বিজ্ঞাপনটি। ‘এক টুকরো ভিটামল্ট খাও, সারাদিন পাহাড় চরে বেড়াও!’ যৌবনবতী এক তন্বি, আর নবীনদর্শন এক যুবা, পাহাড়ে চরে বেড়ানোর মাল-মাত্তা হাতে, চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, সাসেক্সের একটি প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্য বেয়ে বেয়ে উঠছে তারা। মেয়েটির চেহারা দেখো! এক ধরনের উজ্জ্বল উচ্ছ্বাস ছড়ানো চোখেমুখে। দাপুটে বাতাস ঠেলে ঠেলে এগুচ্ছে। পরনে টাইট খাকি শর্টস। এ ধরনের মেয়েরা বেশ আমুদে হয়, ভ্রমণে প্রচুর মজা লোটে। কিন্তু তাতে তার কী এসে যায়! আর ওই ‘কর্নার টেবল’র বিজ্ঞাপনটি। ওটিতেও তার চরম ঘৃণা। ইসসস.. ‘কোনার টেবিলে বসে খাচ্ছি বোভেক্স সহকারে’। প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ নিয়ে বিজ্ঞাপনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো গর্ডন। বেকুবের মতো হাসি হাসি চেহারা, আত্মতৃপ্ত এক ইঁদুরমুখো যুবক। তেলে লেপটানো কালো চুল আর ফালতু একজোড়া চশমা পরে প্রভুভক্তের কাচুমাচু চেহারা করে বোভেক্স সহকারে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। সে খুব করে জানে এত কিছুর পরেও এই যুবক যে অর্থশালী সেটাই ফুটে ফুটে উঠছে এই বিজ্ঞাপনচিত্রে।

বিজ্ঞাপন

মুখগুলো সরে গেলো মন থেকে। বাতাসটা হলদেটে রঙ নিয়েছে। বিকট শব্দ তুলে চৌরাস্তা পার করলো একটি ট্রাম। আর তখনই প্রিন্স অব ওয়েলসের ঘড়িতে তিনটার ঘণ্টা বাজলো। বৃদ্ধ এক যুগল, গৃহহীন কিংবা ভিখারি গোছের হবেন। লম্বা তেলচিটচিটে মাটি পর্যন্ত ছড়ানো ওভারকোট গায়ে ধীরে ধীরে তার দোকানের দিকেই এগিয়ে আসছে। চেহারা দেখেই বুঝে নিলো বই খোঁটাখুটিই এদের অভ্যাস। বাইরের বাক্সগুলোর ওপর একটি চোখ ফেলে রাখাই ভালো। বুড়ো লোকটা কয়েক গজ দুরে থামলেন আর বুড়ি দরজা অবধি এগিয়ে এলেন। দরজায় ধাক্কা দিতেই সেটি খুলে গেলো আর, ধূসর বর্ণের ঝুলে থাকা চুলগুলোর মধ্যে থেকে চোখ তুলে নজর ফেললেন গর্ডনের দিকে। পরশ্রীকাতরতায় ভরা সে দৃষ্টি।
‘তুমি বই কেনো নাকি?’ প্রশ্নেই প্রত্যাশা ঝরে পড়লো।

‘মাঝে-মধ্যে। তবে নির্ভর করে বইটি কী, কেমন, তার ওপর।’

‘আমার কাছে ভালো কিছু বই আছে,’ বলতে বলতে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন বুড়ি। ক্যাচ শব্দে দরজাটা বন্ধ হলো পেছনে। ওদিকে লুতুপুতু তার কাঁধের ওপর দিয়ে একবার বক্রদৃষ্টি ফেললো আর আস্তে করে কোনার দিকে এক কিংবা দুই পা সরেও গেলো। বুড়ি এবার ওভারকোটের নিচ থেকে একটি তেলচিটচিটে ছোট্ট ব্যাগ বের করে আনলেন। আর বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে গর্ডনের দিকে একটু ঘেঁষে দাঁড়ালেন। পুরনো রুনি পড়া রুটির গন্ধ নাকে লাগলো তার।
‘নেবে নাকি এগুলো?’ ব্যাগের মুখের বাঁধন খুলতে খুলতে বললেন তিনি। ‘আধা ক্রাউনে অনেকগুলো বই পাবে।’
‘কী বই ওগুলো? দয়াকরে আগে দেখতে তো দাও!’

‘খুব ভালো বই,’ বলেই ব্যাগটির উপর ঝুঁকে পড়ে নিঃশ্বাস টানলেন বুড়ি। এবার পুরোনো রুটির গন্ধটি আরও প্রকট হয়ে নাকে লাগলো গর্ডনের।

‘এই দেখো! বলে একগাদা বই দুই হাতে ঠিক গর্ডনের মুখ পর্যন্ত তুলে আনলেন। শার্ল এম ইয়ংয়ের ১৮৮৪ সংস্করণের সবগুলো উপন্যাস, দেখে মনে হলো অনেক অনেক বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিলো এগুলো। এক পা পিছিয়ে গেলো গর্ডন। আর হঠাৎ একটু ক্ষেপেও গেলো।

পরের অংশ>>

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর