জরাসন্ধ, যেন এক ভুলে যাওয়া নক্ষত্র
২৪ মে ২০২০ ০৯:৩০
কাঁচা আর পাকার মধ্যে ব্যাবধানটা কালগত। কাল পূর্ণ হলেই কাঁচা লঙ্কায় পাক ধরে, কাঁচা মাথা পাকা চুলে ভরে যায়। সংসারে একটি বস্তু আছে যার বেলায় এ নিয়ম চলে না। তার নাম চাকরি। সেখানেও কাঁচা পাকে; কিন্তু কালধর্মে নয়, তৈলধর্মে। সরকারী, আধা-সরকারী কিংবা সওদাগরি অফিসে গিয়ে দেখুন, পক্ক কেশ সিনিয়র যখন কাঁচা রাস্তায় হোঁচট খাচ্ছেন, তৈল সম্পদে বলীয়ান কোন ভাগ্যবান জুনিয়র তখন অনায়েসে পাড়ি দিচ্ছেন কনফার্মেশনের পাকা সড়ক। গিরীনদা বলতেন, চাকরি হচ্ছে পাশার ঘুটি। পাকবে কি পচবে, নির্ভর করছে তোমার চালের উপর। মূল্যবান কথা। চাল অবশ্যই চাই। কিন্তু তার সঙ্গে চাই প্রচুর তেল।
আমার সহকর্মী রামজীবন বাবু তৈল প্রয়োগে অপটু ছিলেন; অদক্ষ ক্রিয়াতে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন নি। তাই কালপ্রভাবে তাঁর গুম্ফদেশে শ্বেতবর্ণের আভা দেখা দিল কিন্তু চাকরির কৃষ্ণত্ব ঘুচল না। সেজন্য রামজীবনের নিজের কোন ক্ষোভ ছিল না। কোন অভিযোগও কোনদিন করতে শুনিনি কতৃপক্ষের নামে।
‘ওরা কি করবে?’- কর্তাদের পক্ষ টেনেই বরং বলতেন রামজীবন; ‘জায়গা কোথায়? যক্ষের মতো যারা ঘাটি আগলে বসে আছেন, তাঁরা দয়া করে সরবেন, তবে তো? জেল সার্ভিসে পেনশন অতি বিরল ঘটনা। পঞ্চত্ব-প্রাপ্তির দুর্ঘটনা বরং শুনতে পাবে দু-একটা; কিন্তু পঞ্চান্নপ্রাপ্তির কোন বালাই নেই। অন্ততঃ পঁয়ষট্টি পেরোবার আগে। কালে-ভদ্রে দু-একটি পোস্ট যদিও বা পাওয়া গেলো, আগে বাবা জীবন, তারপরে তো রামজীবন।‘ (লৌহ কপাট থেকে)।
ঠিক এভাবেই সাহিত্যিক “জরাসন্ধ” তাঁর কর্মজীবনকে সাহিত্যের পাতায় তুলে এনেছিলেন অত্যন্ত সফলতার সাথে। বাংলা সাহিত্যের আর কোন লেখকের লেখায় তাঁর নিজের কর্মজীবনের চালচিত্র এমন প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্যে উঠে আসেনি।
জরাসন্ধ ১৯০২ সালের ২৩ মার্চ ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার ব্রাহ্মণডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে ১৯২৬ সালে দার্জিলিংয়ে ডেপুটি জেলার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৬০ সালে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে অবসরে যান। এই সময়ে বিভিন্ন জেলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কয়েদীদের জীবনাচরণ তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। আর এই বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়েই ১৯৫২ সালে প্রকাশ হয় জরাসন্ধ ছন্দনামে সাড়াজাগানো গ্রন্থ লৌহ কপাটের ১ম খণ্ড। যদিও এর আগে তিনি তাঁর প্রকৃত নাম চারুচন্দ্র চক্রবর্তী নামেই কিশোর গল্প গ্রন্থ লিখে পরিচিতি অর্জন করেন। তাই “লৌহ কপাট” প্রকাশের পর জরাসন্ধ আর চারুচন্দ্র চক্রবর্তী যে একই ব্যাক্তি, অনেক পাঠকেরই তা বুঝতে অসুবিধা হয়। লৌহ কপাট-প্রথম খণ্ড পাঠক সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। চারখণ্ডের লৌহকপাটের তিনটি খণ্ডই তাঁর চাকরিজীবনে লেখা। চতুর্থ খণ্ডটি লেখেন অবসর নেওয়ার পরে এবং কারো কারো মতে সেটিই সর্বশ্রেষ্ঠ খণ্ড। ‘লৌহকপাট’ ছাড়াও আরও প্রায় কুড়িটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন। ‘তামসী’, ‘পাড়ি’, ‘সীমারেখা’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘পরশমনি’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘তৃতীয় নয়ন’, ‘রঙ চঙ’, ‘পলাশ ডাঙার ঝড়’, ‘আবরণ’, ‘একুশ বছর’ ‘ছায়াতীর’, ‘ছবি’, ‘সপ্তষি’,‘মল্লিকা’ ‘অশ্রু বন্যা’ ‘রবিবার’, ‘পরিসর’, ‘যমরাজের বিপদ’ ইত্যাদি। তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘নিঃসঙ্গ পথিক’। এছাড়াও তার লেখা ছোটগল্প এবং ছোটদের জন্য লেখা গল্পও বেশ কিছু আছে।
সাহিত্যিক জরাসন্ধ তৎকালীন পূর্ব বাংলা বর্তমানে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এক ক্ষণজন্মা কৃতি সন্তান। কিন্তু বাংলাদেশের পাঠক সমাজের কাছে জরাসন্ধের সাহিত্য যতটা উজ্জ্বল, তাঁর ব্যাক্তি পরিচয় ততটাই অন্ধকারে। বেশিরভাগ পাঠকই জানেন না যে তিনি বাংলাদেশে জন্ম নেয়া একজন সাহিত্যিক। এমন কি তাঁর জন্মস্থান ফরিদপুরের ব্রাহ্মণডাঙ্গা গ্রামের মানুষেরও তাঁর সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। জরাসন্ধ-যেন এক ভুলে যাওয়া নক্ষত্র।
এই মহান সাহিত্যিক ১৯৮১ সালের ২৫ মে মৃত্যুবরণ। তাঁর এই মৃত্যু দিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিকট প্রত্যাশা থাকবে কম করে হলেও এই মহান সাহিত্যিকের জন্মভূমিতে তাঁর নামে একটি পাঠাগার এবং সংগ্রহশালা নির্মাণ করে তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা। এবং একই সাথে তাঁর জীবনাচরণ এবং সাহিত্যকর্ম, সেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন আবহমান বাংলার সংস্কৃতি এবং শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস, তা মানুষকে জানানোর ব্যাবস্থা করা।
পরিশেষে ২৫ মে এই মহান সাহিত্যিকের মৃত্যুদিনে রইল অতল শ্রদ্ধা।
চারুচন্দ্র চক্রবর্তী জরাসন্ধ লৌহকপাট সাহিত্য সাহিত্যিক জরাসন্ধ