বিন্যাকুড়ির আকাশ-পাতাল
২৪ মে ২০২০ ১৫:৪০
বিন্যাকুড়ির আকাশে আজ মেঘ জমেছে। ওই যে তোতা মিয়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা, সদাচঞ্চল বিন্যাকুড়ি। নাম শুনলে মনে হয়, যেন কখনো কুড়ি পার না হওয়া এক সবুজ কোনো আদিবাসী নাম বুঝি বিন্যাকুড়ি। কিংবা ঝর্ণা? অথবা নিসর্গ? কিন্তু বিন্যাকুড়ি হলো উত্তরের দিনাজপুরে জুড়ে যাওয়া, পৃথিবীর সেই স্থান, যাতে এখনো চিড় ধরেনি, না বয়সের, না ক্ষরার কিংবা স্রোতের। আদতে দেখতে গেলে চিরিরবন্দরের এক বাজার মাত্র বিন্যাকুড়ি।
আর তার কোণে দাঁড়িয়ে থাকে বলিরেখার আঁকলে বাকলে রাজার মতন দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছ। নাম তার তোতা মিয়া। বটগাছের নাম তোতা মিয়া কেন এই নিয়ে কোন প্রশ্ন জাগেনি কারো। এমন নামই শুনে আসছে সবাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, গাছের নাম তোতা মিয়া। এটাই ধারা।
বিন্যাকুড়ির কথা মানুষের মনে পড়ে, তোতা মিয়ার পাশ ঘেঁষে যে বাজার জেগে উঠে প্রতি শুক্র আর মঙ্গলবার, তার জন্য। সেটা বিন্যাকুড়ির বাইরে থাকা মানুষদের কথা। বিন্যাকুড়ির মানুষ, আলাদা করে বাজার নিয়ে ভাবে না। তারা বলে হাট। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল বিক্রেতাদের নিজ নিজ জায়গা বরাদ্দ আছে। সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ বাঁশ দিয়ে কাজ চালানোর মতন একটা ঠুনকো দোকান করে নিয়েছে। ছাদ বানিয়ে নিয়েছে প্লাস্টিক নয়তো চটের ছালা দিয়ে। বৃষ্টি আর রোদের জন্য প্রস্তুতি। আর যারা অত জোগাড়যন্ত্র করার ক্ষমতা রাখেনা, তারা বসে পড়ে এখানে ওখানে সেখানে। নির্ভেজাল ব্যবস্থা। এতো পুরোনো হাট! হুলুস্থুল মন কষাকষি তো হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু আবার কেমন করে মিটেও যায়। সব মিটে যাওয়ার পরে আবার যখন মন দিয়ে সবাই হাট করে, মনে হয়, ওই ঝগড়াটুকু বোধহয় কোনো বিশেষ পরিবেশনা ছিল। যাত্রাপালার মতন। নুনহীন মাছের ঝোলে দুফোঁটা লেবুর রসের মতন, স্বাদবর্ধক।
কখনো ওই হাঙ্গামা ঝগড়া বাদে, বিন্যাকুড়ির হাট, ভীষণ নিজ গতিতে, নিজ ধারায় চলে। ঠিকঠাক। শুক্রবারকে তারা বলে হাটের প্রথম দিন। সকালে বাড়ির মুরুব্বিরা গিয়ে তোতামিয়ার আশপাশ ধার ঘেঁষে জায়গা করে বসে। মালপত্র, আনাজপাতি সাজিয়ে গুছিয়ে বসে। তারপর বাড়ি ফিরে। দায়িত্ব দিয়ে দেয়, পরিবারের ছেলে ছোকরাদের হাতে। বাড়ির খুকি মেয়েগুলোও লক্ষী হয়ে বিক্রি করে। জুম্মার পরে, মুরুব্বিরা এসে দোকানে বসে। ছেলে-পেলেরা তখন বাড়ি ফিরে যায়। বিকালে জমে আসর।
রুপোর, তামার গয়না, কানপাশা, বালা, নাকের নথ। কিছু আসে ঢাকা থেকে, কিছু ভারত থেকে বর্ডার হয়ে। মেলা ভিড় জমে তখন। কেউ কিনে। যারা কিনতে পারে না, দেখে যায়। কেউ বায়না করে যায় হাতে টাকা আসলে কিনবে বলে। আর মঙ্গলবার হাটের শেষ দিন। বুড়ো-বুড়ি, খোকা-খুকি সবাই বেচা বিক্রিতে ব্যস্ত থাকে সকাল থেকে। শুক্রবারের আয়েশি ভাবটা কম থাকে। জরুরি জিনিস বিক্রি হয়। আয় রোজগারের বেশি যোগান হয় মঙ্গলবারেই। এই অঞ্চলের যে আধা ভাঙা ব্রিজটি আছে তার নামও লোকের মুখে মুখে চলে- বিন্যাকুড়ি বাজার ব্রিজ হিসেবে। ক্রমশ ভঙ্গুর ব্রিজটি তোতা মিয়ার মতন শক্তিমান নয়। অযত্নে ভেঙে ভেঙে পড়ে। লোকের মুখে মুখে এখন তার নাম হয়েছে ভাঙা ব্রিজ। সেই ভাঙা ব্রিজ ধরে আসে বারো গ্রামের মানুষ, হাটের দিনে।
গায়েন নুরু ফকির এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরতে ঘুরে ঠিক হাটবারে চলে আসে বিন্যাকুড়িতে। সারা সপ্তাহের রোজগার এ দুদিনেই হয় তার। কিন্তু সে যখন সুর তোলে, ভাঙা হাটের সময়ে, শুধু টাকার মায়ায় গানে সে সুর বাঁধেনা তা বোঝা যায়। তার গানের পরান পাখি, কেমন বিন্যাকুড়ি হয়ে মিশে যায়, সবার অন্তরে। ঠিক যেমন গলে পড়া শেষ সময়ের সূর্য পুরো আকাশ জুড়ে মিলে মিশে যায়, তেমন। সুর তোলে নুরু ফকির,
তুই মোর এক আসমান
হইলদ্যা রঙা বসন
বসন্ত তুই পোড়াস কেনে
পরান পাখির মতন।
আর এমন করেই হাটবারে সন্ধ্যে নামে। সুর মিলিয়ে যায় তখন, হাট ভাঙে যখন। পূর্বের মসজিদ থেকে তখন মাগরিবের আওয়াজ শোনা যায়।
হাটের এই এমনধারা একইরকম নুনহীন মাছের ঝোল স্বাদ, গোলাপ জল আর কিসমিসের মতন উৎসবময় ঘ্রাণে ভরে ওঠে, রোজার ঈদের আগের দুই সপ্তাহে। ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে পাইকারি দুটো দোকান থেকে দোকানিরা ১২-১৫ গ্রস ধরে ধরে শিশি কিনে। নানারকম স্নো-ক্রিম ভরে বিক্রি করে। বিন্যাকুড়ি হাটে। আর চাঁদ রাতের বিশেষ যে হাট বসে, সে যেন চাঁদেরই হাট। কে বলবে, এই অঞ্চলে ভাঙা ব্রিজ আছে, তার এপার ওপাড় জুড়ে জ্বর-জরা-খরাও আছে। ঈদ যেন আগের রাতে সাক্ষাৎ নেমে আসে। সবাই বলে এ আসলে এক টাকার ঈদ এর গুণে।
বিন্যাকুড়ির তরুণেরা যখন চাঁদরাতে, তোতা মিয়ার চারপাশে মরিচবাতি জড়িয়ে দেয়, খোকা-খুকুরা রঙিন কাগজে শিকল কেটে ভাতের আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে, তোতা মিয়ার শরীরে মালার মতন পরিয়ে দেয়, ঠিক তখনই লোকটা আসে। প্রতি বছর! বাপ মায়েরা ছেলেমেয়েদের গল্প করে তাদের সময়ের এক টাকার ঈদ এর গল্প। দাদা-দাদিরাও করে তাদের সময়ের এক টাকার ঈদেরই গল্প। ছেলে-মেয়েরা মিলিয়ে দেখে, এখন আর তখনের গল্পে তেমন ফারাক তো নেই। এমন করে এক টাকার ঈদ রয়ে গেছে, এ অঞ্চলে, তোতা মিয়ার মতন।
যে লোকটা এক টাকার ঈদ নিয়ে আসে, সে এমন আহামরি কেউ নয়। রোদে পড়া কোনো জীর্ণ শরীরও নয়, সাধুসন্ন্যাসী গোছের খুব উজ্জ্বল চরিত্রও নয়। মাঝারি বর্ণ, মাঝারি বয়স, মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি প্রস্থ, আর মাঝারি এক হাসি ঝুলিয়ে সাদামাটা এক মানুষ এসে বসে, এক টাকার ঈদ নিয়ে। তোতামিয়ার ঠিক উল্টোদিকে। একটা পাটি বিছিয়ে সেখানে বসে। কাঁধে বাঁধা চাদরের পুটলি থেকে বের করে ছোট ছোট শিশি। আর হাতে বানানো ছোট দুটো সাইন বোর্ড। সেখানে লেখা থাকে,
ঈদ আনন্দ এক টাকা
সুরমা আতর এক টাকা
ধনী-গরিব এক টাকা
লেখা থাকে। আর সুর করে মুখে ক্যানভাসিংও চলে। আর মুখে ঝুলে মাঝারি হাসি। কেউ কেউ বলে একই লোক দাদা- নানার আমল থেকে আসছে। কেউ বলে না, একই লোক তো নয়। এই মাঝারি লোকটি এই অঞ্চলের কেউ নয়। এই লোকটির কথা সবার মনে পড়ে ঈদের আগখান দিয়ে। এবং এই লোক কে, কোথা থেকে আসে, এই আলোচনা থেকে সবাই এক টাকার ঈদের গল্পে চলে যায়। তাই এই লোকের গল্প বেশি স্থায়ী হয়না। যতটা হয় এক টাকার ঈদের ঘ্রাণ।
এক টাকার ঈদ আদতে একটি প্লাস্টিকের নীল প্যকেটে মোড়ানো দুটো বুড়ো আঙ্গুল সাইজের শিশি। একটি শিশি ভরা আতর, আরেক শিশিতে অল্প করে থাকে সুরমা। এতো সুন্দর শিশি কই পায় কে জানে? পাইকারি দোকানের গ্রসে বিক্রি হওয়া শিশির চেয়ে ঢের ভাল। এক টাকাতেই চলছে, তখনো, এখনো।
কেন এর দাম বাড়েনা, এই প্রশ্ন যে কারো মনে আসেনা তাতো নয়, কিন্তু ওই যে প্রশ্ন মনের মধ্যে অত জোরে ঘুরপাক খায়না, যত ঘন হয় সুরমার রং।
মাঝারি লোকটা, ঈদ আনন্দের মতনই, উৎসবময়। সুর তোলার ফাঁকে মাঝে মাঝে বলে, ‘ভাই বোন, ভাগনা ভাগ্নেরা, যদি কারো পকেটে একটি টাকা না থাকে তো সংকোচ করিবেন না। বিনামূল্যে নিয়ে যান। ঈদ আনন্দ কেউ পাবে, কেউ পাবেনা, তা হবেনা তা হবেনা।’
থামে আবার বলে, ‘কিন্তু চুরি করিবেন না, পকেটে টাকা রেখে মিথ্যা বলিবেন না। দিলে বড় কষ্ট পাবো। ঈদের আনন্দে কাউকে দিলে কষ্ট দেয়া কি ঠিক?’
তা কেউ চুরি করবে কিভাবে? মাঝারি লোক ঠিক ধরে ফেলে। পাড়ার দুলু চোরাকে পুলিশ দারোগা ধরে সামলাতে পারেনা, মাঝারি লোকটি হাতে নাতে একবার ঠিকই ধরে ফেললো।
‘ও ভাই লুঙ্গির গিটে কি নিলেন গো?’
ধরা পরে গেল দুলু চোরা। ঠিকই লুঙ্গির গিট থেকে হাটের লোকেরা দুটো চুরি করা ঈদ আনন্দ শিশি খুঁজে পেল। পিটিয়ে লম্বা করা যেত বটে, কিন্তু একে চাঁদরাত, তারমধ্যে আবার মাঝারি লোকটা বাধ সাধলো।
‘বাদ দেন, মাফ কইরে দেন।’
দুটো ঈদ আনন্দ থেকে একটি ফেরত নিয়ে, একটু দুলুকে দিয়ে দেয়া হল। দুলু চোরা আতর মাখা হাতে বাড়ি ফিরল। গেল ঈদে নুরু ফকির যেয়ে বলল, ‘বাপ একটা আনন্দ দাও দেখি ঈদের। পকেটে পয়সা নাই। বিনে পয়সায় দাও।’
মাঝারি লোক ভুরু নাচিয়ে বলে, ‘চাচা, এই যে একটু আগে কোণার দোকান থেকে তিন টাকার বাতাসা কিনলেন, দশ টাকা দিলেন, বাকি ফেরা সাত টাকা তো পকেটে রয়েছে আপনার।’
নুরু ফকির অগত্যা এক তাকে ঈদ আনন্দ কিনে নিল। এমনই সতর্ক, মাঝারি লোকটি। চোখ কান খোলা। সব দিকে
খেয়াল। কিন্তু যখন টুকু পাগলা, মজিদ মিয়ার মেয়ে ঝুমকা, আর পাড়ার অলোক শীলের কিশোর ছেলে সুদীপ, মাঝারি লোকের
আশ-পাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে, তখন সে বিনা বাক্য ব্যয়ে, বিনামূল্যে এক টাকার ঈদ আনন্দের প্যাকেট তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়।
মাঝারি লোকটি হাট ভাঙার কিছু আগে উঠে চলে যায়। সবাই ভাবে প্রতিবার লোকটার পিছু নিবে। কই যায়, কোথায় বাড়ি? কিন্তু ঈদ এর আগের দিন, বাজার করে বাড়ি ফিরে, রান্না খাওয়ার জোগাড় করে, ঘর ঝাঁটপাট করে সময় কোথায়? সবাই তাই ভুলে যায়। কিন্তু অনেকে তাকে দেখে, সন্ধ্যামালতির বাড়ির দিকে যেতে। সন্ধ্যামালতী বাড়ির উঠোনে একটা ঈদ আনন্দের নীল প্লাস্টিকে মোড়ানো প্যাকেট রেখে সে চলে যায়, তার গন্তব্যে।
সন্ধ্যামালতি, মাঝবয়স অতিক্রম করা, বিধবা। শহরে বিয়ে হয়েছিল, সে অনেক আগে। শহরে বিয়ে হওয়া তখন ভাগ্যের কথা। ভাল ঘরে। বংশ, পরিচয়, কুষ্ঠি মিলিয়েই। দুই বছর পর ফিরে আসে বিধবা হয়ে। তাও আজ থেকে কত কত বছর আগের কথা। বাপ মা কেউ নেই। একা বাড়িতে থাকে। বয়সের চেয়েও অনেক গম্ভীর, অনেক শান্ত। সবাই একরকম সমীহ করে চলে। কেউ তাই সাহস করে প্রশ্ন করে না, মাঝারি লোকটি কেন তার উঠোনে ঈদ আনন্দের শিশি রেখে যায়।
অনেকে বলে, বিধবা হওয়ার পর এই লোকের সাথে তার ভাব পরিচয় হয়েছিল। সেই টানেই মাঝারি লোক এই গ্রামে আসে বছরে একবার করে। কেউ বলে, মাঝারি লোকটাই আসলে তার স্বামী। সবাই ভেবেছিল, সে মরে গেছে। বেঁচে ফিরে এসে বাউল হয়ে গেছে। বছরে একবার ঈদ আনন্দ নিয়ে বৌয়ের দরজায় রেখে যায়। কিন্তু এইসকল অনুমানের সত্যতা কেউ খোঁজার চেষ্টা করেনি। সবই শোনা কথা।
কারণ এটাই সত্য যে ঈদ এর দিন ওই ছোট্ট শিশির আতর আর সুরমা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সারাবছর, মাঝারি লোকটার কথা আর কারো মনে পড়েনা। মনে পড়ে যায়, প্রতিবার ঈদ আসার আগের দিন। মাঝারি লোকটার কথা। এবারও তাই। ঈদের আগের দিন। সকাল থেকে ঈদের হাতের তোড়জোড় করে দোকানিরা। রঙিন কাগজের শিকলে আঠা মাখাচ্ছে কিশোরেরা। মরিচবাতি, দড়ি, কাঁচি, মই আর সাজ-সরঞ্জামের আয়োজন গোছাচ্ছে তরুণেরা। আর দোকান সাজাচ্ছে মুরুব্বিরা। এমনই হয়ে আসছে। বিকাল থেকে সাজসাজ রব। হাট জমবে বলে।
এর মাঝে মনে বড় কু ডাক দিচ্ছে, নুরু ফকিরের। এ ক দিনের ভ্যাপসা গরমের পরে, আজকে আকাশে মেঘ মেঘ ভাব। এ কেমন ধারা। লক্ষণ তো ভালো না। হাটের শেষ মুহূর্তের তদারকি করছে সর্দার মোল্লা। নুরু তার কাছে যায়।
‘আকাশে মেঘ করেছে’
-‘তো?’ – ভারী বিরক্ত হয় কাজের মাঝে সর্দার মোল্লা। যেন এ অঞ্চলে আর আগে বৃষ্টি হয়নি।
-‘ঈদের আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে আগে?’
-‘ক্যান কি হয় আগের দিন বৃষ্টি হলে?’ – সর্দার মোল্লা খেঁকিয়ে ওঠে।
-‘ওমা ভুলে গেলে, ওই যে খুন্তি বুড়ি কইতো …’
মনে পরে সর্দার মোল্লার। রাগ জল হয়ে, কেমন পানসে হয়ে যায়। সত্যিই তো। বিচলিত সে। ভারী কুলক্ষণ। নুরু ফকির আর সর্দার মোল্লা যায় এরপর খুন্তি বুড়ির ছেলের বাড়ি। বুড়ি তো আর বেঁচে নেই। ছেলেও একমত, ভীষণ অলুক্ষণে কারবার। তারা তিনজন মিলে যায়, পাড়ার সবচেয়ে বয়োজোষ্ঠ্য, চাচা মিয়া আহ্সানুল্লার বাড়ি।
কথা সত্য প্রমাণিত হয়। এক অলুক্ষণে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। অতঃপর দশ কান হয়ে পুরো অঞ্চল জানাজানি হয়। সবার মনে পড়ে যায় যে, ‘কোনদিন যদি এ অঞ্চলে ঈদ এর আগের দিন বৃষ্টি হয়, তো এক টাকার ঈদ নিয়ে সেই লোক আর আসবে না। এক টাকার ঈদ যদি এ অঞ্চলে না আসে তো, এ গ্রামে আর কখনো সুখ থাকবে না। গ্রাম শেষ হয়ে যাবে।’
এমন কথা খুন্তি বুড়ি বলে গিয়েছিল। পাগলাটে বুড়ির কথা কেমন করে যেত ফলে যেত। খুন্তি বুড়ির সেই কথা মুরুব্বিরা বিশ্বাস করতো, বিশ্বাস করতো তরুণেরা এবং শিশুরাও। তারা অনেক হিসাব করে, স্মৃতির লিস্টি মিলিয়ে দেখল, যে এই গ্রামে আগে কখনো ঈদের আগের দিন বৃষ্টি হয়নি। ঈদ এর দিন হয়েছে বটে। ঈদ এর আগের দিন কক্ষনো নয়। তাদের স্মরণে তো নেই।
তবে এবার? কেউ প্রার্থনায় বসে, কেউ কাঁদে, কেউ আকাশে দিকে তাকিয়ে খোঁজে কালো মেঘের গতিবিধি। বৃষ্টি না হোক, না
হোক আজ বৃষ্টি।
তরুণেরা, দুটো বালির বস্তা নিয়ে ভাঙা ব্রিজের ভাঙা ফুটো ভরাট করে দেয়। তবুও আসুক, এক টাকার ঈদ, আর ওই অনাকর্ষণীয় আকাঙ্খিত মাঝারি লোকটা ব্রিজ ধরে।
সর্দার মোল্লার রাগটা আবার জেগে ওঠে। ‘তোমরা মিয়া বেশি বাড়সিলা। এক টাকার আনন্দ, তাও চুরি করসিলা, পকেটে টাকা রাইখ্যা মিথ্যা বলসিলা। এখন বুঝো। এই গ্রামে আর কোনদিন আনন্দ আসবেনা। চোর বাটপার সব।’
কেউ রাগ করেনা সে কথায়, কথা গায়েও মাখেনা। সন্ধ্যামালতী, যার উঠোনে মাঝারি লোকটা একটা ঈদ আনন্দের নীল প্যাকেট রেখে আসে প্রতি বছর, তার ঘরের দুয়ার আজও বন্ধ। অন্যদিনের মতন। সবাই হাটে বসে থাকে। সে হাটে হাসির মরিচবাতি নেই। যেন এক ধ্যানমগ্ন নীরব মানুষের মিছিল, তোতামিয়াকে ঘিরে আছে। শুধু তোতামিয়ার সবুজ পাতা দোলে, গুমোট বাতাসে। সবার হাতে, পকেটে এক টাকা। এমনকি দুলু চোরারও।
সবাই পথের দিকে তাকিয়ে। এই সময় যদি তারা একটু আকাশের দিকে একবার তাকাতো তো দেখতো, কালো মেঘ কেমন লেজ গুটিয়ে আকাশ ছেড়ে হারিযে যাচ্ছে। বিন্যাকুড়ির আকাশের মেঘ সরছে। ধীরে ধীরে। কে একজন খবর দিয়ে যায়, ভাঙা ব্রিজ ধরে মাঝারি লোকটিকে হেঁটে আসতে দেখা গেছে। আবার হাট বসে যায়। জমে যায় হাট। জেগে ওঠে ঈদ, বিন্যাকুড়ির হাটে।