মিথ্যামিথ্যি কিংবা সত্যিসত্যি একটা মিথ্যা গল্প!
২৫ মে ২০২০ ১২:৩৮
সেই জেনারেলের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই! সেই যে এক ভয়ঙ্কর জেনারেল। ক্যু করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে দেশের প্রধান হয়ে বসেছে। অনেক দেশেই যেমনটা হয় বা হচ্ছে। বলাই বাহুল্য খুবই অজনপ্রিয় জেনারেল। কিন্তু তার আশেপাশে সবসময় চামচারা আছেই, যেমনটা সবসময় থাকে। তারা বলেই যাচ্ছে যে, তিনি কত অসাধারন শাসক… ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও সেই জেনারেলের মনে হলো, আচ্ছা তিনি নিজে কেন যাচাই করছেন না যে তিনি সত্যিই জনগনের কাছে কতটা জনপ্রিয়; আদৌ জনপ্রিয় কিনা। তাই একদিন তিনি কাউকে না জানিয়ে ছদ্মবেশে বের হলেন।
প্রথমে একটা টং দোকানে গেলেন চা খেতে। এখানে সাধারন মানুষরা নানান রকম গপ্প করতে করতে চা-নাস্তা খায়। তিনিও এক কাপ চা নিয়ে বসে গেলেন। শুনতে পেলেন তাকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। এতোই জঘন্য ভাষায় আলোচনা হচ্ছে যে তার দুই কান দিয়ে ধূয়া বের হতে লাগল। তিনি ধূমায়িত চা রেখেই বের হয়ে এলেন সেই দোকান থেকে। ঢুকলেন একটা বাজারে। সেখানেও একই অবস্থা তিনি যে কতটা খারাপ সবার মুখে মুখে। তিনি হতাশ হয়ে বের হলেন বাজার থেকে।
এবার গেলে একটা পার্কে। বেশ নিরিবিলি পার্ক, তার নামেই এই পার্কটা। এমন না যে তিনি এই পার্কের নাম তার নামে দিতে বলেছেন, তার চামচারাই এই কাজ করেছে, সব জায়গায় যেমনটা হয় আর কি। তার পাশে বেশ ভদ্রলোক টাইপ এক লোক এসে বসল। দূরত্ব রেখেই বসল। কারণ যখনকার গল্প বলছি তখন পৃথিবীতে করোনা কাল চলছে। অবশ্য তৃতীয় বিশ্ব বলে কেউ মানছে না সেই ভাবে। জেনারেলের মনে হল, আচ্ছা এই লোকটাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?
– এই ভাই একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?
– জি অবশ্যই পারেন।
– আচ্ছা এই দেশের যে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ব্রাঙ্কো। তাকে আপনার কেমন লাগে?
লোকচা এদিক ওদিক তাকাল। তারপর গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল
– সত্যিই শুনতে চান?
– হ্যাঁ
– তাহলে এখানে বলা যাবে না। চলুন আমার সঙ্গে… বলে লোকটা ইশারা করল। জেনারেল একটু অবাক হলেন। তবে তাকে অনুসরন করলেন। লোকটা একটা টেক্সি নিল। তিনি তাতে উঠলেন। তারপর বেশ অনেক্ষন পর শহরের শেষ প্রান্তে একটা জঙ্গলের ধারে তারা পৌঁছাল। লোকটা ভাড়া মিটিয়ে জেনালেরকে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেল।
বিশ মিনিট হেঁটে আরো গভীরে ঢুকে একটা জায়গায় থামল। তারপর জেনারেলের দিকে ফিরে বলল-
– হ্যাঁ এখানে বলা যায় , এখানে আশেপাশে কারো থাকার কোন সম্ভবনাই নেই।
– বলুন।
লোকটা তখন হাসি হাসি মুখ করে বলল ‘জেনালের ব্রাঙ্কো লোকটাকে কিন্তু আমার বেশ ভালই লাগে!’
ঠিক তখনই একটা চিকন কান্নার শব্দ পেলেন তারা। দুজনেই চমকে উঠলেন। কে কাঁদে এই গভীর জঙ্গলে। দুজনে কান্নার উৎস সন্ধান করে দেখেন একটা জারুল গাছের নিচে এক বৃদ্ধা মহিলা বসে খুনখুন করে কাঁদছে।
– কি হয়েছে আপনার?
– আপনি এখানে একা একা কি করছেন?
– বাবারা দুঃখের কথা কি বলব? আমার জ্বর হয়েছিল। আমার নাতীরা ভয় পেল আমার করোনায় ধরেছে তাই তারা ধরে বেঁধে এখানে রেখে গেছে।
– হোয়াট? হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন জেনারেল ব্রাঙ্কো। তিনি ভুলে গেলেন যে তিনি ছদ্মবেশে আছেন। ‘আমার শাসনামলে এত বড় অন্যায় আামি সহ্য করব না। ঐ কুলঙ্গার নাতীদের এখনই অ্যারেস্ট করার নির্দেশ দিচ্ছি।
আমি জেনারেল ব্রাঙ্কো’ পার্কের ভদ্রলোক চমকে উঠলেন!
– আপনি সত্যিই ব্রাঙ্কো ?
ঠিক তখনই আরেকজনকে দেখা গেল জঙ্গলে। দেখা গেল তার হাতে একটা খালি বস্তা। চেহারায় একটা উদভ্রান্ত ভাব।
– এই তুমি কে?
– আমি এসেছিলাম আমার ভাগ্নের পালা বিড়াল ফেলতে। বিড়ালগুলো খুব জ্বালাচ্ছিল। তাই আমার বোন বলল জঙ্গলে ফেলে দিতে। সব কটাকে ফেলেছি। কিন্তু…
– ও তুমি তাহলে মামা, মানে ভাগ্নের মামা?
– জ্বি, কিন্তু এখন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। স্যার বলতে পারেন কোনদিকে গেলে বেরুতে পারব?
– হোয়াট? তুমি কি ভেবেছ আমি ট্রাফিক পুলিশ? তোমাকে রাস্তা দেখাতে এখানে দাড়িয়ে আছি? আমি জেনারেল ব্রাঙ্কো এই দেশের শাসক।
– তো স্যার সত্যিই যদি আপনি দেশের শাসক জেনারেল হয়ে থাকেন এই জঙ্গলে কি করছেন?
– জঙ্গলই মঙ্গল। কে বলল কথাটা? সবাই তাকিয়ে দেখে গেরুয়া পোশাক পরা এক সন্নাসী। মাথায় জটা বাধা চুল কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে, খালি পা দাড়ি গোঁফে মুখ দেখার উপায় নেই।
– এই তুমি কে? জেনারেল চেঁচিয়ে উঠেন
– আমি ঈশ্বরের সন্ধানে বের হয়েছি, সামান্য এক নাদান মানুষ
– আমার শাসনামলে এই হেয়ারকাট চলবে না। আজই বাটি ছাট দিতে হবে তোমাকে, নইলে কোর্ট মার্শাল হবে তোমার।
এই সময় পার্কের সেই ভদ্রলোক কেশে গলা পরিষ্কার করলেন।
– হে মহামান্য জেনালের ব্রাঙ্কো। আপনি সত্যিই যদি দেশের প্রধান হয়ে থাকেন তাহলে দেশের এই ক্রান্তিকালে যখন করোনায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তখন এখানে সময় নষ্ট না করে ফিরে গিয়ে পজিটিভ কিছু একটা করুন।
– এ্যাঁ? পজিটিভ আর কি করবো, করোনা টেস্টেতে সবই পজিটিভ আসছে, কেউ নিয়ম মানছে না।
– কিন্তু দেশের প্রধান হিসেবে আপনাকে কিছু একটা করতেই হবে।
– আচ্ছা, বরং যাই নতুন করে চিন্তা ভাবনা করি। এই যে মা, আপনি চলুন আমার সঙ্গে আগে আপনার একটা ব্যবস্থা করি, আপনার নাতীদের এমন টাইট দিব…। আর এই সাধু বাবা আপনিও চলুন এই চুল দাড়িতে চলবে না বাটি ছাট মাস্ট… আর কাকে যেন খুঁজতে বের হয়েছেন আপনি?
– ঈশ্বর
– কিন্তু বের হব কোন দিক দিয়ে? জেনারেল ব্রাঙ্কো পার্কের সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন।
– আমিওতো বুঝতে পারছি না। কোন দিক দিয়ে যে ঢুকলাম। এখন কিচ্ছু চিনতে পারছি না।
– আমিতো সেটাই বলছিলাম আপনাদের বের হওয়ার রাস্তা কোন দিকে? বিড়াল ফেলতে আসা সেই মামা বলে।
তখন সেই খুনখুনে বৃদ্ধা মুখ খুলে ‘বাবারা বিড়ালগুলোকে খুঁজে বের কর আগে, ওরাই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের লোকালয়ে …’
– ওহ দারুন বলেছেন। জেনারেল খুশি হয়ে উঠেন। ‘আপনাকে আমি আমার মহিলা বিষয়ক মন্ত্রী পরিষদে নিয়ে নিব। এই সবাই বেড়াল খুঁজে বের কর জলদি… দিস ইজ মাই কমান্ড! ’
– মাফ করবেন বিড়াল খুঁজতে পারব না আমি ঈশ্বরের সন্ধানে বের হয়েছি বলে সাধু হাঁটা দিল।
জেনারেল হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ‘ এই ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট! এই কে আছ একে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাও!’
জেনারেল হুঙ্কার শেষ করতে পারলেন না, গিলে ফেললেন। সবাই হতভম্ব হয়ে দেখে সামনে দাড়িয়ে আছে একটা আস্ত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এটা কি করে সম্ভব? এই জঙ্গলে বাঘ আসল কোথা থেকে??
– সম্ভব, জেনারেলের কানে ফিস ফিস করে সেই পার্কের ভদ্রলোক ‘দেখছেন সারা পৃথিবীতে এখন জন্তু জানোয়ার সব শহরে ঢুকতে শুরু করেছে এই বাঘতো তবু জঙ্গলেই আছে…!’
সবাই দেখল বাঘের পিছে পিছে ঢুকলো একপাল ভেড়া। তার পিছে এক রাখাল বালক। সেই মিথ্যাবাদী রাখাল বালক!
বালক বলল,
– আপনারা ভয় পাবেন না। এই বাঘ আমার ভেড়ার পালে পড়েছিল। একটাও ভেড়া খায় নাই।
– মানে কি? সবাই অবাক হয়
– তুমি মিথ্যাবাদী সেই রাখাল মিথ্যে বলছ?
– না আমি আর মিথ্যা বলি না, পৃথিবী বদলে যাচ্ছে টের পাচ্ছেন না? এই বাঘ মামাও বদলে গেছে, ইনি নিরামিষী, ঘাস খায়। শুনে সবাই হতভম্ব! এই সময় আকাশে মস্ত এক চাঁদ উঠল, চাঁদ মামা। আর মনুষ্য মামাতো আছেই।
জঙ্গলের লোকজন বুঝলো বাঘ মামা, চাঁদ মামা আর মনুষ্য মামা এই তিন মামার মধ্যে মনুষ্য মামাই যত নষ্টের মূল। সে যদি বিড়ালগুলোর একটাকেও খুঁজে পেত তাহলে তার পিছু পিছু জঙ্গল থেকে বেরুনো যেত। জেনারেল ব্রাঙ্কো ফের হুঙ্কার দিলেন-
– এই যে ইউ? তুমি মামা, দি মেটারনেল আঙ্কেল তুমি আন্ডার এ্যারেস্ট, তোমার কোর্ট মার্শাল হবে।
এই সময় হটাৎ ‘মিউ’ ‘মিউ’ আওয়াজ শোনা গেল। সবাই তাকিয়ে দেখে এত বিড়াল না বাঘ মামা ডাকছে!
– বাঘ মামা তোমার গলার এই অবস্থা?
– আরে আমি কি আর সেই বাঘ আছি? ঘাস খাই না। চল আমিই তোমাদের পথ চিনিয়ে লোকালয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
– কিন্তু তুমি পথ চিনবে কিভাবে?
– আরে এই করোনাকালে প্রাণীরা এখন সবাই শহরমুখী, তোমরা মানুষরা এখন যেমন ঘরমুখী কোয়ারেন্টাইনে!
সবাই বাঘের পিছে পিছে শহরে ফিরে এল। এল না শুধু সেই সাধু। সে বের হয়েছে ইশ্বরের সন্ধানে… তাকে খুঁজে পাওয়ার এটাই বোধহয় মোক্ষম সময়!