নজরুলের গানে ঈদ
২৫ মে ২০২০ ১৬:৪০
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ/ তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ’— প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মুসলিম রেনেসাঁর কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গান ছাড়া এ অঞ্চলের মুসলমানদের ঈদ যেন অসম্পন্ন থেকে যায়। রমজান মাস শেষে পশ্চিম আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে বাংলাদেশ বেতার ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এই গান প্রচারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালি মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। গত ৮৯ বছর ধরে এটি অবধারিত রেওয়াজ হিসেবে পালন হয়ে আসছে। এর পেছনে একটি ইতিহাস আছে। সে কথায় পরে আসছি!
সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্মের ইতিহাসে যুগের সব ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত্ব সংরক্ষিত হয় না। অথবা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যেমন- গত ৮৯ বছর ধরে যার গানের মধ্য দিয়ে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়, সেই মুসলিম রেনেসাঁর কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন এবং ঈদুল ফিতর একই তারিখে এর আগে ক’বার পড়েছে বা আদৈ পড়েছে কিনা?— সে ইতিহাস কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। তবে এবারের ঈদুল ফিতর আর কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন একই তারিখে পড়েছে। যদিও বিশ্বমহামারি করোনা ‘সংকট’ ঈদের সব আনন্দ আয়োজনকে সীমিত করে ফেলেছে।
এবার আসা যাক ‘ঈদ-উল-ফিতর নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এর নেপথ্য ঘটনায়। ১৯৩১ সাল। তখনো রমজানের রোজা শুরু হয়নি। তবে মাসিক মোহাম্মদী’র ঈদ সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। একদিন বিকেল চারটার দিকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এলেন মোহাম্মদী’র সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁর কাছে কোলকাতার অফিসে। এসেই বললেন, চার আনা পয়সা দেন চাচা দুপুরে খাইনি। পকেটে হাত দিয়ে একটা সিকি বের করে দিয়ে মওলানা আকরম খাঁ বললেন, এই নাও চার আনা পয়সা, বাইরে থেকে খেয়ে এসো। তারপর একটা কবিতা দিয়ে যাবে মাসিক মোহাম্মদী’র ঈদ সংখ্যার জন্য। খেতে গেলেন না নজরুল। কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসে গেলেন। আধ ঘন্টার মধ্যে লেখা শেষ করে মওলানা আকরম খাঁর হাতে খাতাটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন- কবিতাটি পড়েন চাচা, আমি খেয়ে আসি। এটাই সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’
লেখার চারদিন পর কবির শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের আগে এই রেকর্ড প্রকাশ হয়। গ্রামফোন কোম্পানি এই রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গানটি ছিল নজরুলেরই লেখা ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর/ বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর’। (সূত্র- ফকির আশরাফ, কত কথা কত স্মৃতি, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১০৫)।
তবে এ গানটি রচনার নেপথ্যে জোরালো মতটি হলো- শ্যামা সঙ্গীতের ডামাডোলের মধ্যে আব্বাস উদ্দীনের অনুরোধেই গানটি রচনা করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
আব্বাস উদ্দীন তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কাজীদার লেখা গান ইতোমধ্যে অনেকগুলো রেকর্ড করে ফেললাম। তার লেখা ‘ বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর’, ‘অনেক কিছু বলার যদি দুদিন আগে আসতে’, ‘গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই’, ‘বন্ধু আজও মনে পড়ে আম কুড়ানো খেলা’ ইত্যাদি রেকর্ড করলাম। একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল- এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়। এ ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না?
তারপর আপনি তো জানেন কীভাবে কাফের-কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙ্ক্তেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে এক দল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান’।
কথাটা তার মনে লাগল। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, তুমি ভগবতীবাবুকে বলে তার মত নাও। আমি ঠিক বলতে পারব না’। আমি ভগবতী ভট্টাচার্য অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইনচার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না, ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না’। মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলাম।
এর প্রায় ছয় মাস পর। একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ঘরে গিয়েছি। দেখি, একটা ঘরে আশ্চর্যময়ী আর ভগবতীবাবু বেশ রসালো গল্প করছেন। আমি নমস্কার দিতেই বললেন, ‘বসুন, বসুন’। আমি তার রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এ-ই উত্তম সুযোগ। বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে বলি। সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা। আচ্ছা; একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী’? তিনি হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে’।
শুনলাম, পাশের ঘরে কাজীদা আছেন। আমি কাজীদাকে বললাম, ভগবতীবাবু রাজি হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজীদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজীদা বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে’। ইন্দুবালা চলে গেলেন।
এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথ থেকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’।’’
কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের কালজয়ী এই গানটিতেত আনন্দ-উচ্ছ্বাস, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব, ইসলামের মমার্থ, ঈদের তাৎপর্য নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। এই গান ছাড়া যেমন ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পায় না। তেমনি ইসলামে মানব প্রেমের গুরুত্ব যে অপরিসীম, সে বিষয়টিও দ্যার্থহীনভাবে উচ্চারিত হয়েছে এই গানে। গানের একটি জায়গায় নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন— ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে/ তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ/ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ অর্থাৎ ঈদের এই আনন্দক্ষণে শত্রুতা ভুলে প্রেম বিতরণের মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বকে ইসলামের মুরিদ বানানোর পরামর্শ দিয়েছেন কবি।
ইসলামে উঁচু-নিচু-ধনী-গরিবে ভেদাভেদ নেই। ইসলামে আছে সাম্য-ভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা। সর্বোপরি ইসলামে প্রেমের অমিয় বাণী উচ্চারিত হয়েছে। নজরুল বলেছেন- ‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/ সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ/ তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা/ সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ/ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’
শুধু ঈদ নয়, কাজী নজরুল ইসলামের কিছু গানে রোজার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। একটি গানে তিনি বলেছেন, ‘এলো রমজানের এই চাঁদ এবার দুনিয়াদারি ভোল/নতুন করে রেজওয়ান জান্নাত সাজায়/ আজ রোজায়।’
তাঁর ‘ঈদ’ নাটিকায় তিনটি গান রয়েছে। প্রথম গানে কবি বলেছেন- ‘বিদায়-বেলায় সালাম লহ মাহে রমজানে রোজা/ তোমার ফজিলতে হাল্কা হলো গুনাহের বোঝা/ ক্ষুধার বদলে বেহেশ্তি ঈদের সুধা তুমি দিলে/ খোদার সাধনার দুঃখে কি সুখ তুমি শিখাইলে/ তুমি ইশরাতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখালে সোজা।’
মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে ঈদের অনুষ্ঠান সর্বস্বতার চেয়ে ঈদের মর্মার্থ ও গভীরতার দিকে বেশি দৃষ্টিপাত করেছেন। ‘ঈদ’ নাটিকার দ্বিতীয় গানে আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে নজরুল যে গভীরতর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে এবারের ঈদে তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন— ‘নাই হলো মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার/ আছে আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার/ নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি/ ওতেই আমায় মানায় ভারি/ কলমা আমার কপালের টিপ/নাই তুলনা তার॥’
এই নাটিকার তৃতীয় গানে ঈদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে- ‘এলো ইদুল-ফেতর এলো ঈদ ঈদ ঈদ/ সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল না ক’ নিঁদ/ দেখ হযরতের হাসির ছটা ঈদের চাঁদে জাগে/ সেই চাঁদেরই রঙ যেন আজ সবার বুকে লাগে/ এই দুনিয়াতেই মিটলো ঈদে বেহেশ্তি উমিদ।’
ঈদের অন্য একটি গানে হৃদয়-উপচানো আনন্দের বন্যা তুলে ধরেছেন নজরুল। তিনি বলেছেন, ‘ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান/ এই তুফানে ডুবুডুবু জমিন ও আসমান/ ঈদের চাঁদের পানসি ছেড়ে বেহেশ্ত হতে/ কে পাঠাল এত খুশি দুখের জগতে/ শোন ঈদগাহ্ হতে ভেসে আসে তাহারি আজান॥’
এছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম আরও কয়েকটি ঈদের গান লিখেছেন। যেমন—‘ফিরদৌসের শিরনি এলো ঈদের চাঁদের তশতরিতে/ লুট করে নে বনি আদম ফেরেশতা আর হুরপরীতে।’
এভাবেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে মুসলমানদের সব চেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদকে তুলে ধরেছেন বর্ণাঢ্য আঙ্গিকে। তাঁর ঈদের গানে উঁচু নিচু ভেদাভেদ ভুলে সকল মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করানোর প্রবল অভিপ্রায় এবং শোষণ-বঞ্চনা নিঃশেষ করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পরিলক্ষিত হয়েছে। নজরুলের গানে ঈদ সকল মানুষের মঙ্গলের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
ঈদের গান
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।