পদার্পণ
২৬ মে ২০২০ ১৮:০২
মেঘগুলো নিশ্চয়ই তামাশা দেখছে। বিরক্তিতে সেকু এপাশ ওপাশ করে। চিৎ হয়ে শুতে পারলে আরাম লাগত। কিন্তু নিতম্ব আর ঊরুর মাঝামাঝি জায়গায় একটা ফোঁড়া হয়েছে। ফোঁড়ার কথা মনে হতেই হাত দিয়ে জায়গাটা স্পর্শ করে। উইপোকার ঢিবির মতো হয়েছে। বেশ গরম জায়গাটা। দুআঙুল দিয়ে চেপে দেখল। এখনও মুখ বাঁধেনি। আরো দিন তিনেক জ্বালাবে।
সজনা গাছের নিচে বসে আকাশ দেখে। টিয়ে রঙের কচি সজনা পাতায় ভরে গেছে গাছটা। ঝিরঝিরে বাতাসে শিরশির করে কেঁপে উঠবে পাতাগুলো। কিন্তু বাতাস কই? সারাটা শরীর বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে গেছে। গামছা দিয়ে ঘাম মুছে আর বিরক্তিতে গজরায়। আজিমের মাকে বলেছিল বেলের শরবৎ দিতে। এসময় মাটির কলসীর পানি দিয়ে বানানো শরবৎ খেলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। সেহেরিতে দিয়েছিল। এখনও সেই তৃপ্তির আবেশটা রয়ে গেছে বুকে। কিন্তু আজিমের মায়ের খবর নেই। সে গেছে পাড়াবেড়ানিতে। এই নারীজাতি জগতের এক বিস্ময়। পৃথিবীর কোন সমস্যাই তাদের স্পর্শ করতে পারে না। নূহের কিস্তিতে ওঠার সময়ও বোধহয় এদের তাড়া দিতে হয়েছিল।
সেকুর বড়ভাইয়ের মেয়ে নুড়িয়া একটা কুলগাছের ডালে উঠে ঝাঁকা দিচ্ছে। আজিম নিচ দাঁড়িয়ে কুল কুড়াচ্ছে। আজিমের চেয়ে নুড়িয়া বছর দুয়েকের বড়। কিন্তু দেখতে বেশ বড় লাগে। গায়ে গতরে ধাই ধাই করে বেড়ে উঠছে। কে বলবে মেয়েটার বয়স তের হতে আরো দুমাস বাকি।
কিছুক্ষণ পর নুড়িয়ার মা এসে চিৎকার করতে লাগল। নুড়িয়ে লাফ দিয়ে নেমে দিল ছুট। দৌড়ে সে ঢুকে গেল দাদীর ঘরে।
তারপর আক্রমণটা তাক হলো সেকুর দিকে, ‘এক কুনজে কো ধামকি নাহি দে যা সাকতি হে… এতনা বাড্ডি লাড়কি রাহি হে…’
সেকু ভাবীর কথা শুনেও না শোনার ভান করে। ধ্যানস্থের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছাইরঙের মেঘ এমনভাবে আকাশ ছেয়ে আছে মনে হয় কোন পোড়াবাড়ির সিলিং। কালিঝুলিতে বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেকু স্কুলে বিজ্ঞান পড়ায়। বাতাসের চাপের সঙ্গে ঝড় বৃষ্টির একটা সম্পর্ক আছে, সে জানে।
গ্রামে আসার পর থেকেই আকাশ এমন গোমড়া হয়ে আছে। মেঘ থমথমে। বাতাসও হালকা। বৃষ্টি আসছে না। এখন আর বৃষ্টি আসবে না। হবে ঝড়। ঝড় দিয়েই মৌসুমী বায়ু পা রাখবে পঞ্চনদের দেশে। নতুন একটা কৃষিবর্ষের সুচনা হবে। যব জোয়ার আর ভুট্টার লকলকে শিষে ভরে যাবে মাঠ। দূর থেকে মনে হবে সবুজ গালিচা পেতে দেয়া হয়েছে কাশ্মীরের নীল পাহাড়গুলোর দিকে হেঁটে যাওয়ার জন্য। এমন পথ দিয়েই হয়ত রঞ্জিত সিং গিয়েছিল কাশ্মীর দখল করতে। তবে ইরাবতী কিংবা বিভাস খেপে উঠলে সব শেষ। মাঠের পর মাঠ প্লাবিত হবে বাদামী জলে। মরা গরু ভাসবে বেনোজলে। পিডাব্লুডির রাস্তাগুলো ভরে উঠবে বানভাসি মানুষে।
খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে চারদিক দেখে। ভুট্টার মাঠটা নোড়ায় ভরে আছে। সেখানে কিছু গরু চরে বেড়াচ্ছে। তাদের কোন ভাবান্তর নেই। দুই সাল আগে ক্ষুরা রোগে দুটো গাই মারা গিয়েছিল। সে কথা মনে পড়ল। গরু বড় লক্ষী। তাদের বিষ্ঠা পর্যন্ত কাজে লাগে। আর এই গরু নিয়ে ঝগড়া করে একটা দেশ ভেঙে ফালিফালি হয়ে গেল। অথচ গরুদের কোন বিকার নেই। গরু আসলে কাকে বলা যায়?
ডান পা টা ভাঁজ করে ফোঁড়ায় হাত বুলায় আর এসব ভাবতে থাকে সেকু। এমন সময় একটা হৈচৈ শোনা যায়। এসবে এখন আর সে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। মার্চে যখন শহরে রায়ট লেগেছিল, খুব ভয় পেয়েছিল। কিন্তু কতদিন আর ভয় আকড়ে ঘরে বসে থাকা যায়? সারাদেশ জ্বলন্ত উনুনে বসে আছে। আগুনের আঁচ তো কিছুটা লাগবেই। এতে অভ্যস্ত না হলে বিপদ। তবে গত এক বছর ধরে পরিস্থিতি সত্যি বেসামাল। সমস্যাটা লেগেছে বাঙাল মুলুক থেকে।
কলকাতায় প্রথম রায়টটা লাগে। সেখানে মুসলমানরা কচুকাটা খেল। তার শোধ নিতে নোয়াখালীর এক পীর সাব শুরু করলেন হিন্দু সাফাই। গান্ধীজি নেংটি পরে ছুটলেন সেই আগুনে পানি ঢালতে। কিন্তু সব আগুন তো পানিতে নেভে না। বিহারের হিন্দুরা শুরু করল মুসলিম নিকাশ। নোয়াখালীর আগুন না নিভিয়েই গান্ধী ছুটলেন পাটনা। মজার খেলা। আমি পারলাম না আমার বিবির সঙ্গে কাজিয়া করে তো কোন পেরেশানি নেই, আমার ছোটভাইকে বললাম তোর বউকে লাগা। সে ইচ্ছা মত তার বউকে মারল আমার শোধ তোলা হয়ে গেল আমার।
‘শালা খতরনাক পাবলিক’, নিরুচ্চারে কথাটা বলে এক গাল থুতু ফেলল মাটিতে। তৃষ্ণার্ত মাটি দ্রুত তা শুষে নিল। এ সময় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল সালাউদ্দিন। বয়স একুশ হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনায় বারো বছরের কিশোর। করে উইনিয়নিস্ট পার্টি। সারা ভারতের মুসলমানরা একদিকে, তারা হাঁটে অন্যদিকে। জিন্নার নেতৃত্বে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। মুসলমানদের স্বপ্নের একটা দেশ। অথচ খিজরি হায়াত খান হিন্দু আর শিখদের সঙ্গে জোট বেধে করেছে কোয়ালিশন সরকার। নিজেই নিজের অবস্থান নড়বড়ে করে দিয়েছে। এখন জিন্নার পা টিপছে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। এই যে ভারত ভাগের একটার পর একটা রাউন্ড টেবিল মিটিং হলো, তাতে একবারও কি খিজরিকে ডেকেছে? বা তার দলকে? একটা আঞ্চলিক দল হিসেবে কোণঠাসা হয়ে গেছে। যে শিখ ও হিন্দুদের কাছে পিরিতি বিলাতে গেল, সেই হিন্দু-শিখরাই আজ মুসলিমদের কচুকাটা করছে। অমৃতসর শহর এখন মুসলিমশূন্য।
সেকুর স্কুল বন্ধ। সরকার থেকে বলেছে অপশন বেছে নিতে। চাইলে সে পাকিস্তান চলে যেতে পারে। যেতেই পারে। কিন্তু কেন যাবে? এই বিঘার পর বিঘা ফসলের মাঠ, গোয়াল ভর্তি গরু, পিতৃভিটা, ভাঙা টাঙা গাড়িটা এসবের কি হবে?ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সেকু।
সালাউদ্দিনের দোষ দিয়ে কি লাভ, এ বয়সে সেও এভাবে মরীচিকা পেছনে ছুটেছে। প্রথমে করত কংগ্রেস। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মাথায় জালিয়ানাওয়ালাবাগের রক্তাক্ত স্মৃতি। সারা ভারত জেগে উঠেছিল। তারা ভেবেছিল এবার ব্রিটিশ সিংহ লেজগুটিয়ে পালাবে। বলা নাই কওয়া নাই গান্ধীজি একতরফা আন্দোলন ইউথড্র করে নিলেন। প্রথম প্রথম বেজায় রাগ হয়েছিল। পরে ধরে নিয়েছিল এটা রাজনৈতিক কৌশল।
তারপর শুরু হলো সত্যগ্রহ আন্দোলন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হলেন ভগৎ সিং। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব পাঞ্জাবীর কাছে এক অহংকারের নাম হয়ে উঠল ভগৎ। গান্ধীজি আন্দোলন ছেড়ে গেলেন বড়লাটের কাছে। চুক্তি হলো। চুক্তিতে বলা হলো সব রাজবন্দীকে ছেড়ে দেয়া হবে। অথচ চুক্তির দুই সপ্তাহ পরেই ফাঁসি হলো ভবগৎ সিংয়ের। যা বোঝার বুঝে গেল সেকু। গান্ধী আসলে ইংরেজের এক পুতুল। তাকে দিয়ে গণক্ষোভ প্রশমন করা হচ্ছে। তথাকথিত উগ্রবাদীদের কোণঠাসা করে রাখাই তার কাজ। ভগৎ সিংয়ের জন্য তখন কংগ্রেসের কাউন্সিলে একটা শোক প্রস্তাব তুলেতে দেননি গান্ধী। অথচ পরে যখন লেলিন মারা
গেলেন তখন ঠিকই শোকপ্রস্তাব উঠল। ভগৎ গুণ্ডা, লেলিন দেবতা- বাহ! এর চেয়ে কোট টাই পরা জিন্না অনেক ভালো। যা বলে তাই করে। নাটক সাজায় না। ওপেন সিক্রেট।
‘ভাই বহুৎ খাতরা (খারাপ) হ গিয়া সিচুয়েশন।’ সালাউদ্দিনের কথায় চমকে উঠে সেকু।
‘কেয়া।’
‘এক মহিলা আপনি ছাতি কে পাসআপনে পতি কে সের লিয়ে মার্চ কর রাহিয়ে। ভো রো রাহি হে। হার কোই উৎসাহিত হে।’
‘পাগল হে ইয়া নাহি!’
বিষয়টা খুবই আগ্রহোদ্দীপক মনে হল সেকুর কাছে। এক মহিলা তার স্বামীর মাথা বুকে নিয়ে মিছিল করছে। এর মানে এখানে একটা খুনোখুনি হয়েছে। কে মহিলার স্বামীর শিরশ্ছেদ করলো? মহিলা মুসলিম না অমুসলিম?
অমুসলিম হলে খবর আছে।
পাছার ফোঁড়ার কথা ভুলে গিয়ে সটান হয়ে বসে পড়ল সেকু। সালাউদ্দিন যা জানাল রীতিমতো উত্তেজনাকর।
‘ওর স্বামীর মাথা কাটল কে?’
‘আর বল না, সকালে লাহোর থেকে একটা ট্রেন এসেছে। ট্রেন ভর্তি হাত পা মাথা কাটা মানুষজন। সবাই তো ভেবেছিল ট্রেনে কোন জীবিত মানুষই নেই। পরে দেখ গেল দুয়েকজন বেরিয়ে আসছে…’
কথাগুলো হারিয়ে যায়। সেকু সরুচোখ করে তাকায় তার ভাইয়ের দিকে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। সারা মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। তার উপর শিশিরকণার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম। কপালের দুপাশে নীল নীল ধমনীগুলো লাফাচ্ছে। সেকু মনে মনে বলে, ‘বকরা।’
সালাউদ্দিনের সেসব শোনার সময় নেই। ঢোলা ঘিয়ে রঙের পাজামা পাঞ্জাবি পরনে সে ছুটল অন্য বাড়িগুলোর দিকে। লিকলিকে দুটো পা পাতলা কাপড়ের আড়ালে দেখা যায়। মনে হয় বাতাসে ফোলা পালের ভেতরে মাস্তুল। এই দুর্বলচিত্ত ছেলেদের দিয়ে তাদের কওম রক্ষা পাবে কি করে? একশ বছর আগে তার পর-দাদারা জিহাদ করতে সিত্তানা গিয়েছিল। যে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য তারা রক্ত ঝরিয়েছিল, সেই শিখদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হায়াত খানের গোষ্ঠী এতদিন সখীনৃত্য করেছিল। যেই মুসলমানরা নিজেদের জন্য আলাদা স্টেট দাবি করেছে, ওমনি শিখগুলো আদিম রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ধিক, এতোদিনের সহাবস্থান। বীরের মতো বাঁচতে হবে। এতো ঘাবড়ে গেলে হবে না। চার গাঁও ভর্তি নিজ কওমের লোক। এখানে এসে কিছু করার সাহস পাবে না। মার্চের দাঙ্গাতেও ওরা এদিকে আসেনি। দলবদ্ধভাবে থাকার এই এক সুবিধা। এর জন্যই শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছে। একদিকে নিরাপত্তা হলো, অন্যদিকে ঈদটাও কাটিয়ে গেল পরিবারের সঙ্গে।
রাতে ব্যথা বাড়তে লাগল। শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ব্যথা। বিবি এক গামলা গরম পানি নিয়ে এলো। মা বাধা দিল। পানি দিলে জায়গাটা নরম হয়ে যাবে। মুখ বাঁধতে দেরি হবে। সানাউল্লাহ ঝান্টু সিং-এর দোকান থেকে হোমিওপ্যাথিক পুরিয়া নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেকু খেল না। বছর দুয়েক আগে হোমিওপ্যাথিক খেয়ে কেলেংকারি হয়ে গিয়েছিল। এক ফোঁড়া সারতে চার ফোঁড়ার জন্ম। দিন সাতেক ভয়ংকর কষ্ট হয়েছিল। সেই স্মৃতি মনে করে সে আর হোমিওপ্যাথিকের পুরিয়া খেল না। ইফতারিতে বকরার গোস্ত দিয়ে বাজরার রুটি খেয়ে শুয়ে পড়ল।
কিন্তু এই ব্যথা বেদনা নিয়ে কি ঘুম আসে? ফোঁড়ায় হাত দিলে মনে হয় উত্তপ্ত লোহা।
‘আজিম কাঁহা হে!’
‘নুড়িয়া কো সাথ।’
‘উসে বুলাও। সামনে কা উস্কো এক্সাম। পড়নে কি জরুৎ নেহি হে!’
‘কেয়া ভা মেরি ডাক শুনতা হে? কুচ ভি হো, ভা আপনে দাদা সে সিকায়েত করতা হে।’
‘যাও, এসি লিয়ে আও।’
এভাবে এই পাড়াগায়ে পড়ে থাকলে ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাবে। ইচ্ছে আছে মিলিটারি স্কুলে ভর্তি করানোর। সে জন্য আজিমের ইংরেজি ভোকাবুলারি নিয়ে সে প্রতিদিন বসে। একটা দুটো করে নতুন শব্দ শেখায়। বাক্যে শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা বলে।
একটু পরে কাঁদতে কাঁদতে আজিম এলো। পেছনে তার মা। আজিমের মা গজরাতে থাকে ‘ইয়া সব মেরি গলতি হে’। আজিমের দিক কটমট করে তাকায় সেকু, ‘ভোকাবুলারি বই নিয়ে আয়।’
কাঁদতে কাঁদতে উত্তর করে, ‘আজ পড়ব না।’
‘লাত্থি মেরে তোর গু বের করে দেব।’
এসময় চারদিকে আর্তনাদ আর মিছিলের আওয়াজ শোনা গেল। ‘ওয়াহে গুরুজি কী খালসা’ ‘ওয়াহে গুরুজি কী ফতেহ’।
‘রায়ট এটাক গায়া হে।’
আজিমের মা চকিতে লোহার ট্রাংকটা টেনে নেয়। ব্যথা বেদনা নিয়েই উঠে পড়ল সেকু। একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে আজিমকে টেনে নেয় কাছে। এসময় শোনা গেল বড়বাড়ি থেকে সেকুর মা ভাবী আর নুড়িয়ার আর্তনাদ। সেকু উদ্যত হয় বড়বাড়ির দিকে যেতে। কিন্তু আজিমের মা শক্ত করে তার হাত ধরে। ‘আগে নিজে বাঁচো।’ ট্রাংকটা সেকুর হাতে দিয়ে আজিমকে নিয়ে ন্যাড়া মাঠটার দিকে ছুটে। সেকু সাত পাঁচ না ভাবে পিছু পিছু ছুটে।
চারপাশের ঘরবাড়ি থেকে আর্তনাদ আসছে। সাহায্যের আহ্বান। দূরে দুয়েকটা বাড়িতে আগুন লেগেছে। অন্ধকারের মধ্যে আগুনের আলোয় একটা গোলক ধাঁধা লেগে যায়।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে সেকু। সঙ্গে তার পরিবার। বনে আগুন লাগলে যেমন পশুরা ঝোপ ঝাড় থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে, তেমনি গ্রামবাসীও ছুটে আসতে লাগল। সবার মুখে চাপা আওয়াজ ‘পালাও পালাও’ ‘আরো দ্রুত’।
অন্ধকারে মাঠের আলে কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। সঙ্গের কেউ হয়ত হিঁচড়ে তুলছে, নয়ত নিজে থেকে উঠে পড়ে দৌড়াচ্ছে।
অন্ধকারের মধ্যে কতক্ষণ তারা ছুটেছে মনে নেই। থামল একটা আখ খেত দেখে। সবাই ইঁদুরের মতো গিয়ে লুকাল সেই খেতে। খেতের ভেতর থেকে দেখা যায় গ্রাম। অমাবস্যার রাতে গ্রামটা অন্ধকারে ডুবে থাকে। মাঝে মাঝে দুয়েকটা আলোর ফুটকি দেখা যায়। কিন্তু আজ দৃশ্য ভিন্ন। মট মট করে পুড়ছে ঘর বাড়ি। হঠাৎ হঠাৎ বিকট আওয়াজ হচ্ছে। আগুনের উল্মফন তখন বেড়ে যায়। মানুষের উল্লাস আর জয়ধ্বনিতে ঢেকে যাচ্ছে মানুষের আতর্নাদ আহাজারি। পৃথিবীর অন্যকোন প্রাণী স্বজাতির বিপদে এতো আনন্দ পায় না। কি পৈশাচিক আনন্দ। সবাই বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়ে। ‘ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু… হে আল্লাহ, আশ্রয় দাও। রক্ষা কর।’
মশার কামড় খেয়ে আর দোয়া দারুদ পড়ে কোন প্রকারে রাতটা পার হয়। কেউ কেউ সেহেরি সারল খেতের আখ চিবিয়ে। সকালে গোর্খা রেজিমেন্টের সৈনিকরা এলো। তারা গার্ড দিয়ে পুরো দলকে নিয়ে গেল অমৃতসর স্টেশনে। গরমে ক্লান্ত হয়ে আসছে শরীর। একটা গাছের নিচে বসে পড়তে পারলে শান্তি। কিন্তু জীবনের তাড়া তাদের বসতে দেয় না। তিন ঘন্টা হাঁটার পর তারা অমৃতসর শহরে এসে পৌঁছায়।
এতোদিনের পরিচিত শহরটাকে বড় অপরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে শত্রু সীমান্ত। রাস্তায় রাস্তায় লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লুট করা দোকানগুলো ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে। সব নিয়ে গেছে লুটেরারা। রয়ে গেছে কিছু ভাঙাচোরা আসবাব। কিছু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেসব থেকে সুতোর মতো হালকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এক জায়গায় দেখা গেল শিখদের একটা ছোট্ট মিছিল এগিয়ে আসছে। গোর্খারা দ্রুত গিয়ে লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দিল।
গাড়িঘোড়া নেই রাস্তায়। কিছু দূর দূর পর পর ঘোড়ার পিঠে পুলিশ। এসবের মধ্যে তারা অমৃতসর স্টেশনে পৌঁছাল। লোকে লোকারাণ্য। সবাই চায় প্লাটফর্মে একটু জায়গা। মাটিতে মাল সামানা রাখার জায়গা নেই। বিশাল বোঁচকা মাথায় নিয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে সেকু পেয়ে গেল মা আর বড়োভাইকে। তাকে পেয়ে তারা দুজন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সালাউদ্দিনের খবর তারা জানে না। নুড়িয়াকে শিখ গুণ্ডারা তুলে নিয়ে গেছে। নুড়িয়ার মা বাধা দিয়েছিল। তাই তার পেটে তরবারি বসিয়ে দিয়েছে। নুড়িয়ার মার লাশ ফেলেই তারা দৌড়ে পালিয়েছে।
ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর ঝমঝম হিশহিশ আওয়াজ তুলে ট্রেন এলো। প্লাটফরমে ভিড়তেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মানুষজন। ধাক্কাধাক্কি করে উঠল সেকু ট্রাংকটা নিয়ে। পেছনে আজিম আর তার মা। লম্বা বেঞ্চের মতো সিট। কে কার আগে বসবে তার যুদ্ধ। আজিম পায়ের ফাঁক গলে একটা সিটে গিয়ে বসল। এক মহিলা দাবি করল সিটটা তার। লাগল ঝগড়া। আজিমের মা আজিমকে কোলে তুলে বসে পড়ল চুপচাপ। সেকু তাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সুন্দর ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু ভিড়ের তোড়ে সেকু দাঁড়াতেই পারছে না। বেঁকে কোনরকমে দাঁড়িয়ে থাকল ট্রেনের মধ্যে।
একটু পরে হর্ন বাজল। অনেক যাত্রী উঠতে পারেনি। অনেকে ছাদে উঠার চেষ্টা করছে। এসময় দেখা গেল বড়ো একটা কাফেলা স্টেশনে ঢুকছে। রক্তাক্ত বিধ্বস্ত ছিন্নভিন্ন মানুষের দল। হাঁটার শক্তি নেই। কারো মাথায় টাটকা রক্ত। কারো পিঠে কোপ। কারো বা হাতে। শক্তিহীন এই মানুষগুলো অপেক্ষমান ট্রেন দেখে যেন নবপ্রাণ পেল। ছুটে এলো ট্রেনের দিকে। কিন্তু ট্রেনের হাতলটা পর্যন্ত ধরবার জো নেই। সেকু দেখল এই বিধ্বস্ত মানুষগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজের প্রফেসার আছে, আছে বড় ব্যবসাদার, আছে বিশিষ্ট কবি। আজ দাঙ্গার ঝাপ্টায় সব মিলে মিশে একাকার।
হুড়োহুড়ি চিৎকার চেঁচামেচি ছাপিয়ে ট্রেনের হুইসেল বাজল। সবাই আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে উঠল। পরম করুণাময় তাদের সহায়। তাদের ট্রেন ছেড়েছে। বগির বেশিরভাগ মানুষই একে অপরের পরিচিত। ভিড়ের মধ্যেই একজন আরেকজনের অবস্থা জানতে চাইছে। পরিবারের সবাই আসতে পেরেছে কিনা। তখন সেকুর মনে পড়ল তার মা আর ভাইয়ের কথা। বিরাট ভুল হয়ে গেছে। ওঠার সময় একটু লক্ষ করা উচিত ছিল।
‘নুড়িয়াকে বলে নিয়ে গেছে।’ পেছন থেকে কে যেন খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে রহমত। সেকুর বাল্যবন্ধু রহমত। ফ্রন্টিয়ার আর্মিতে কাজ করত। এখন বেকার।
‘সবই আমাদের কপাল।’
‘আমার ভাগ্নিটাকেও তুলে নিয়ে গেছে। ভাই আর দুলাভাইর লাশ ফেলে এসেছি বাড়িতে। ওই যে দ্যাখ, বোন কাঁদে।’
‘এ কোন আইয়ামে জাহেলিয়া শুরু হলো। খোদা তুমি রক্ষা কর।’
মহিলারা গুনগুন করে কান্না শুরু করল। এতোক্ষণে তারা কান্নার ফুসরত পেল। পুরুষরা দোয়া দারুদ পড়ছে। রহমত কথা বলতে বলতে শুধু শুধু জানালার দিকে তাকায়।
‘আল্লা রক্ষা কর, ট্রেন যেন না থামে। থামলেই খালসার গুণ্ডাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে ট্রেনে।’
রহমত জোরে জোরে দোয়া ইউনুস পড়ে। ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে বেরিয়ে আসতে আল্লার সাহায্য চেয়েছিলেন। এখন মানুষ তার পিতৃভিটা থেকে পালাতে সে দোয়া পড়ছে। কি অদ্ভুত সময় পার করছি আমরা।
দুজন কলেজের ছাত্র গল্প করছে। ওরা বেশ উত্তেজিত। সে বলছে, ‘এতোদিন যারা আমাদের প্রতিবেশী ছিল, আপদে বিপদে দৌড়ে এসেছে, কত হাসিঠাট্টা করেছি, সেই মানুষগুলো এখন হন্যে আমাদের হত্যা করতে। কি অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ৬০০০ মাইল দূর থেকে এসে বলল, এ মাটি হিন্দুর ও মাটি মুসলমানের। ব্যস হয়ে গেল!
আমার বাপ দাদার মাটি আর আমার নেই। আরে, আমার মাটি অন্যের হাতে তুলে দেয়ার তুই কেরে? সাথে জুটেছে কয়েকটা ম্যাট্রিক পাস ব্যারিস্টার। এরা বড়ো কিছু ভাবতেই পারে না…’
‘আমাদের পাঞ্জাব কেন ভাগ করা হল। আমরা তো ভাগের জন্য ভোট দেইনি। কার অনুমতিতে আমার এ শস্যশ্যামলা স্বর্গটিকে ছিন্ন বিছিন্ন করা হল। এই অমৃতের শহরে আর বোধহয় আসা হবে না।’
আরেকজন বলে উঠল, ‘সব হিন্দুদের ষড়যন্ত্র। পুরো পাঞ্জাবই তো পাকিস্তান হয়। ওরা কেটে নিয়ে গেল আমার দেশ।’
‘এসব রাবিশ কথা বলেই তো তোমরা সমস্যা লাগিয়েছ। পপুলেশনের দিক দিয়ে অমুসলিমই বেশি কিন্তু পাঞ্জাবে।’
কথা শেষ করেত পারলো না। সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠল যুবকের উপর। একজন বলে উঠল, ‘এ লাড়কা হায়াত খানকো দালাল হে। মার সালে কো।’
যুবকের ভাগ্য বলতে হবে, এমন সময় ট্রেনের গতি কমে গেল। একটু হুড়োহুড়ি শুরু হলো। সবাই জানালার দিকে উঁকি দিতে লাগল। দেখল এক লোক পাগলের মতো ছুটছে আর চিৎকার করে বলছে ‘সামনে হামলাওয়ারি’ ‘সামনে হামলাওয়ারি’। ট্রেনে থামেনি, কিন্তু খুব মন্থর গতিতে চলছে। হঠাৎ শোনা গেল ছাদের উপর ভারী বুটের জুতোর দাপাদাপি।
কয়েকজন কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে দরজার হেন্ডেল ধরে ছাদের মানুষগুলোকে প্রশ্ন করতে লাগল। জানা গেল হামলাকারীরা ট্রেনের ড্রাইভারকে এক তাড়া টাকা দিয়েছে সামনে ট্রেন থামিয়ে দিতে। সেখানে একদল হামলাকারী লুটের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই খবর পেয়ে গোড়া অফিসার পিস্তল হাতে ট্রেনের ছাদ দিয়ে যাচ্ছে ইঞ্জিনের দিকে। এখন সবই উপরঅলার হাতে।
হঠাৎ মনে হল ট্রেনটা হোঁচেট খেয়ে থমকে গেল। পুরো ট্রেনে বিলাপ আর আর্তনাদের ধ্বনি উঠল। কে যেন বলল, ‘গোয়িং টু বি এ রোলিং কফিন। মাই আল্লা হেল্প আস।’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল ট্রেনটি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল গতি। ট্রেন যেন আসুরিক শক্তি পেয়ে গেছে। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। বগিতে বগিতে আনন্দধ্বনি উঠল। হায়নারা রেল লাইনের দুপাশে অস্ত্রহাতে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কেউ আক্রশে এটা ওটা ছুঁড়তে লাগল ট্রেনের দিকে। একঘন্টার মধ্যে ট্রেন ভারত সীমান্ত অতিক্রম করল। এবার লোকজনের মধ্য থেকে ভয় ভয় ভাবটা কেটে গেছে। লোকজন জোরে জোরে কথা বলছে। কেউ আবার এটা ওটা নিয়ে দুষ্টমি করছে। কত দ্রুত বদলে যায় মানুষ। মানুষের উপর ভুগোলের কত প্রভাব!
‘এই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভগৎ সিং-রা জান দিয়েছিল আজাদী আজাদী বলে। আর এই ব্রিটিশরাই আজ আমাদের বাঁচাল। আমরা ভালো চাইতে গিয়ে কি খারাপ কিছুকে ডেকে নিয়ে আসছি?’
‘রাখো তো এসব কথা। আমরা এখন নিজেদের দেশে। আর কোন ভয় নেই। এ দেশকেই আমরা আমাদের মন প্রাণ দিয়ে গড়ে তুলব। এটা হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্টেট।’ আমিন আমিন বলে উঠল সবাই।
সেকুর মনে পড়ল পায়ের ফোঁড়ার কথা। কই বিষব্যথা ত নেই। হাত দিতে দেখে ফোঁড়াটা ফেটে গেছে। কিছু রক্ত আর পুঁজ লেগে আছে। এই সামান্য রক্তের দিকে কারো দৃষ্টি যাওয়ার কথা নয়। বাইরে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ইফতারির বেশি দেরি নেই। পানাহারবিহীন অভুক্ত শরীরগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। হাত পা ছেড়ে দিয়েছে লোকজন। সেকু কোনপ্রকারে বাঙ্কের লোহা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পা কাঁপছে। আজিমের মুখটা চুপসে গেছে। মা আর ছেলে ঘুমে ঢুলছে।
বহুদেখা লাহোর স্টেশনের আউটার দিয়ে হেলেদুলে ট্রেনটা ঢুকতে লাগল। বিজলির আলোয় ঝলমল করছে স্টেশন। মনে হয় আলোর বাগান। প্লাটফর্মে উপচে পড়া ভিড়। প্লাটফর্মের লোকজন ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে উঁকি দিতে লাগল ট্রেনের ভেতরে। কেউ কেউ তাদের স্বজনদের নাম ধরে ডাকতে লাগল। এসময় কিছু ষন্ডা মার্কা লোক এসে হম্বিতম্বি শুরু করল জানালা দিয়ে।
‘মাউলাউনরা তোমাদের কোন ক্ষতি করেনি তো, আমরা পুরো এক ট্রেন লাশ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, পেয়েছে ত শালারা।’
লোকজন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তবে সবাই ভীষণ বিরক্ত হলো জালিমগুলোর উপর। নামার সময় লাগল এক হুড়োহুড়ি। এর মধ্যে কয়েকজন হারিয়ে ফেলেছে তাদের বাক্স প্যাটরা। ওরা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে হৈচৈ করছে। সরছে না। সরার কথা বলায় হাতাহাতির উপক্রম। দু’ঘন্টার মধ্যে মানুষের কি পরিবর্তন! এর মধ্যে শোনা গেল ঈদের চাঁদ উঠার খবর। এতো দুঃখের মধ্যেও সুখের হাসি। পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে সৌহার্দে্যর উষ্ণতায়। দেখে ভালোই লাগছে।
ধীরে সুস্থে লোহার ট্রাংকটা নিয়ে প্লাটফর্মে পা দিল সেকু। পা দিতেই মনে হলো পায়ের নিচে চটচটে কি একটা জিনিস। নিচের দিকে তাকাতেই দেখে কালচে হয়ে আসা ঘন রক্ত। স্বাধীন দেশে প্রথম পা দেয়ার জন্য মাটি পেল না। পেল রক্ত। রক্ত তাকে স্বাগত জানাল স্বপ্নের দেশে।