সুন্দরী কথা
২৭ মে ২০২০ ১৫:০৪
একসময়, যখন আমাকে কোনো সুন্দরী পাত্তা দিতো না, মনটা খুব খারাপ হতো। এখন, আমাকে অনেক সুন্দরী পাত্তা দেয়, তবুও মনটা খুব খারাপ হয়। প্রবলেমটা সুন্দরীদের মধ্যে, নাকি আমার মনে; বুঝতে পারি না।
বিষয়টা ঠিকঠাক বোঝার জন্য ‘তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী…’টাইপ আমার এক বান্ধবী, নাম রুমানা হাশেম, ওর সঙ্গে কথা পাড়ি। এবং বুঝতে পারি; সুন্দরীর সঙ্গে সিরিয়াস বিষয়ে ‘কথা পাড়া’র চেয়ে ডিম পাড়া তুলনামূলক সহজ!
‘দোস্ত, সুন্দরীদের নিয়ে আমি তো ব্যাপক সমস্যায় আছি রে।’
রুমানা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ‘হা-রোগ’ আছে। সুন্দরীদের নানা কিসিমের রোগ থাকে। এসব রোগ কোনো পথ্যে সারে না। কারণ রোগগুলোর বেশিরভাগই বানানো। যেমন, ঢং-রোগ, হায়-হায়-রোগ, ভাইয়া-রোগ ইত্যাদিই… ইত্যাদিই-ই-ই…!
‘রুমানা, হা বন্ধ কর। আলজিব দেখা যায়। তা ছাড়া তুই মনে হয় গত এক বছরে ডেন্টিস্টের কাছে যাস নাই।’
‘কস কি মোমিন! এক বছর না, এক বছর না…’ হা-রোগ থেকে রুমানা কনভার্ট হয় ঢং-রোগে, ‘এই তো, মাত্র ১১ মাস ২১ দিন হলো। আচ্ছা, তোর সমস্যাটা কী জানি বললি?’
‘কিছু কিছু সুন্দরী মেয়ে আমাকে পছন্দ করে না। আমি নাকি পুরাই ক্ষ্যাত! ওদের দুর্ভাগ্য, ওরা আমার ব্যাংক- ব্যালেন্স সম্পর্কে কিছুই জানে না।’
‘জানলে কী হইতো? শুধু ক্ষ্যাত না, তোরে ফকিন্নিও কইতো, তাই না?’ বলেই রুমানা হা হা করে হাসতে থাকে।
সুন্দরীদের মুখে বিশুদ্ধ বাংলার চেয়ে খাইছো-যাইছো-করছো… এসব শুনলে কেন জানি অন্যরকম ভালো লাগে। আর সঙ্গে সেন্স অব হিউমার থাকলে তো কথাই নেই। আমি আরেকটু হলেই রুমানার প্রেমে পড়ে যেতাম।
‘শোন্ রুমানা, আমি কালো বলে ব্ল্যাক-মেইল করবি না। ফরসা তো মুলাও হয়। কিন্তু আউটপুট কী; জানিসই তো!’
‘চোপ শালা!’ রুমানা ধমকে ওঠে, ‘তোর সমস্যা কী; সেইটা বল।’
‘আমি সুন্দরীদের ভয় পাই।’
‘অ্যাঁহ, ন্যাকামি। কই, আমাকে তো ভয় পাস না।’
‘তুই তো…’
‘কী? কথা শেষ কর মোমিন। তুই তো কী…?’
‘তুই তো আমার দোস্ত।’
‘হ। বুঝলাম। তা সুন্দরীদের ভয় পাস ক্যান?’
‘দুইটা ঘটনা বললেই ক্লিয়ার হয়ে যাবি। একটা ইতিহাস থেকে, আরেকটা জীবন থেকে নেওয়া।’
‘আচ্ছা। প্রথমে ইতিহাসই শুনি।’
‘বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ইসাডোরা ডানকান একবার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আনাতোলি ফ্রাঁসকে বললেন, একটু কল্পনা করুন তো, আপনার আর আমার মিলনে যদি একটি শিশুর জন্ম হয়, ব্যাপারটা কী চমৎকারই-না হবে। সে পাবে আমার রূপ আর আপনার মেধা।
জবাবে আনাতোলি ফ্রাঁস বললেন, যদি উল্টোটা হয়? আমার রূপ আর আপনার মতো মেধা পায়, তাহলে?’
‘হা হা হা…।’ রুমানা হাসতে হাসতেই বলে, ‘এই গল্পের সঙ্গে তোর কানেকশনটা কী?’
‘ওই যে, বাবা-মা চায় সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করাতে। আর, তুই তো আমার রূপের ঝলক চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিস!’
‘ওলে কিউট দোস্ত আমার…। এবার জীবন থেকে নেওয়া গল্পটা বল।’
‘গল্প না, সত্যি ঘটনা। তুই তো জানিস, আমি একটা টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করি।’
‘হ। আগে বাড়…’
‘কাজের খাতিরে প্রায়ই আমাকে “হতে-চাই-উপস্থাপক”দের অডিশন নিতে হয়। একবার, জনৈক সুন্দরী এসেছিলেন, উপস্থাপনা করবেন। প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নাম শুনেছেন?
তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, অবশ্যই শুনেছি, উনি খুব ভালো কণ্ঠশিল্পী!
ব্যস! ওইদিনের পর থেকে সুন্দরী দেখলেই আমার বুকটা চিনচিন করে ওঠে। আর বেশি সুন্দরী দেখলে বুকটা জাপান-জাপান করে!’
‘হা হা হা…।’ রুমানার অট্টহাসিতে ছোট্ট কফিশপে থাকা অন্য মানুষগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকায়। এতক্ষণ যারা আড়চোখে তাকাচ্ছিল, তাদের সুবিধাই হয়।
এদিকে আমি ভাবতে থাকি, রুমানার সেন্স অব হিউমার দিন দিন বাড়ার কারণ কী? আগে কোনো জোকসের পাঞ্চ-লাইন বলার পরও রুমানা বলতো, তারপর? আর এখন সাথে সাথে বুঝে ফেলছে; ঘটনাটা কী?
‘তাহলে মোমিন সাহেব, এটাই তোর সমস্যা?’
‘না। মূল সমস্যার শুরু এরপর।’
‘কেমন?’
‘ওই ঘটনাটা লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। ওমনি কমেন্টে-ইনবক্সে সুন্দরীদের হামলা। একজন লিখল, ভাইয়া, আমাকে দেখে আপনার বুকটা কেমন-কেমন করে?
আমি লিখলাম, উগান্ডা-উগান্ডা!
সত্য কথা যথারীতি তেতো লাগল। একটু পর দেখি ওই ভাইয়া-রোগওয়ালা-সুন্দরী আমাকে ব্লক করে দিয়েছে। এরপর, দীর্ঘদিনের পরিচিত এক আন্টির-বয়সী-আপা লিখলেন, আচ্ছা মোমিন, আমাকে দেখে তোমার বুকটা কেমন করে?
ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তেমনি আমি ব্লক-খাওয়া-তরুণ কমেন্টের রিপ্লাই দিতে গিয়ে অধিকতর সতর্ক হলাম।
: আন্টি, সত্যি বলব?
: সত্যিই বলবা। কিন্তু তার আগে বলো, আমাকে আন্টি বললা ক্যানো? আমাকে কি আন্টির মতো লাগে?
: সত্যি বলব?
: অবশ্যই।
আমি লম্বা-আ-আ একটা শ্বাস নিয়ে ধীরে-এ-এ ধীরে-এ-এ শ্বাস ছাড়লাম। তারপর লিখলাম, আসলে আপনাকে যখন মেকআপ-অবস্থায় দেখি, তখন আপা-আপা লাগে। অন্যসময় লাগে আন্টি-আন্টি!
মেসেজ সীন হলো। রিপ্লাই নেই। সেকেন্ড যায়, মিনিট যায়, জবাব আসে না। একটু পরই আমার মোবাইল ফোন কেঁপে ওঠে। কাঁপুনি শুরু হয় আমার বুকেও।
: আসসালামু আলাইকুম আপান্টি।
: অ্যাই ছ্যামড়া, আপান্টি আবার কী?
: ধরি মাছ না-ছুঁই পানি-টাইপ সম্বোধন।
: সেটা আবার কী?
: সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না…।
: তোরে যদি হাতের কাছে পাইছি রে, তুই-ও মরবি, লাঠিও ভাঙবে। বজ্জাত পোলা!
: আন্টি, ইয়ে মানে আপা, আপনাকে দেখলে আমার বুক কেমন করে সেটা শুনবেন না?
: আচ্ছা ঠিকাছে। কও।
: মেকআপ-অবস্থায় দেখলে গুলশান-গুলশান করে আর অন্যসময়…
টুট শব্দ হয়। লাইন কেটে গেছে। অপেক্ষা করি। সেকেন্ড যায়, মিনিট যায়, কল আসে না। ভদ্রতার খাতিরে আমি কল-ব্যাক করে ব্যাক্কল হয়ে যাই। আপান্টি আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছেন।’
‘এই তাহলে তোর সুন্দরীদের নিয়ে সমস্যা?’ কফিকাপে চুমুক দিতে দিতে রুমানা জানতে চায়।
‘কিছুটা। আচ্ছা রুমানা, তুই কি আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি?’
‘অবশ্যই।’
‘অধিকাংশ সুন্দরী নাকি বেকুব হয়। কথাটা কি সত্যি?’
রুমানা একটু চুপ থাকে। তারপর বলে, ‘তুই কি আমাকে কিছু মিন করছিস?’
আমি বললাম, ‘উত্তর পেয়ে গেছি। তোকে ধন্যবাদ।’
‘মানে কী?’ রুমানার কণ্ঠে তেজ।
‘মানে বিউটি উইথ ব্রেইন নাকি ব্রেইন উইথআউট বিউটি; তুই কোন ক্যাটাগরির সেটা বুঝলাম।’
‘ওরে আমার সবজান্তা মোমিন রে, তাহলে বল, আমি কি সুন্দরী?’
‘হ। পুরুষ সুন্দর ব্যায়ামে আর নারী সুন্দর বিউটিক্যামে!’
‘ধ্যাত্তেরি। সবসময় ফাজলামি করবি না তো। বল, আমি কেমন সুন্দরী?’
‘আলবত মহাসুন্দরী। তুই সুন্দরী না হলে পৃথিবীর কোনো নারী সুন্দরী না। তুই সুন্দরী না হলে পৃথিবীর কোনো গাছের নাম সুন্দরী হতে পারে না। তুই সুন্দরী না হলে…’
‘থাম থাম।’ রুমানা ডানহাত দিয়ে আমার বামহাত চেপে ধরে। চোখে চোখ রেখে বলে, ‘এবার তুই সত্যি করে বল, আমাকে দেখলে তোর বুকের ভেতরটা কেমন-কেমন করে?’
রুমানার এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। বলব-বলব করেও কখনো বলা হয় নি। আজও আমার ‘বলতে পারি না মুখে তওবা তওবা’ অবস্থা! মন যা বলছে, মুখে তা বলে রুমানার মতো সুন্দরী-বান্ধবীর বিরাগভাজন হতে ইচ্ছে করল না। তা ছাড়া লাগাম-ছাড়া সুন্দরীকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলে লাভ নেই। কারণ ইতিহাস সাক্ষী; মহাসুন্দরীর সাথে Love- এর ফিউচার টেন্স একটাই- লস!