করোনার শহরে
২৭ মে ২০২০ ১৮:০৫
করপোরেশনের ময়লার কন্টেইনারটি পড়ে আছে পথের ওপর। ভেতরটা আবর্জনায় ঠাসাঠাসি। উপচে পড়েছে কিছু। সেখানেই মুখ গুঁজে খাবার খুঁজছে তিনটি কুকুর। এর মধ্যে কালোটির শরীর-স্বাস্থ্য ভালো। আগাপাছা সমান। বাকি দুটোর পেছন দিকটা চিমসে গেছে। পেট পড়ে আছে। একটি হলদে কম বয়সী। অন্যটি মাদি কুকুর। স্তুনটা শুকিয়ে কেমন ঝুলে গেছে।
ফুটবলে লাথি দেওয়ার মতো মাদী কুকুরটাকে পেছন থেকে সজোরে হাঁকালো লোকটা। অমনি কাতরসুরে ‘ঘেউ-উ’ করে সরে গেল জন্তুটা। তার দেখাদেখি বাকি দুটোও।
‘হালার ঘরের হালারা! মাইনসে না খাইয়া মরে, আর হেরা খাউনের উপরে আছে।’
খিস্তি করে উঠলো লোকটা। হাতের বেলচাটা চালিয়ে পথে পরে থাকা ময়লাগুলো করপোরেশনের লোহার কন্টেইনারে তুলতে শুরু করলো। ওয়ারলেস গেটে রাশমনো হাসপাতালের কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। তিনটির মধ্যে দুটো কুকুর ভয়ে অনেক দূর চলে গেছে। একটুপর পর থেমে গলা তুলে ‘ঘেউ, ঘেউ’ করে আবারও চলতে শুরু করছে। কেবল মাদী কুকুরটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বেলচাওয়ালা লোকটার দিকে। হয়তো মনে মনে বলছে, আপদটা কখন বিদায় হবে।
পথঘাট ফাঁকা। করোনার জন্য সব ছুটি। অফিস-আদালত বন্ধ। দোকানপাটও খুলছে না। পথে গাড়ি নেই। দু-একটা ব্যক্তিগত গাড়ি হঠাৎ হঠাৎ কোথা থেকে জাদুর মতো আসছে। বুঝে ওঠার আগেই শো করে চলে যাচ্ছে নির্জীব পথের পিঠ বেয়ে। তবে হাতেগোনা কিছু রিকশা আছে পথে। কোনোটা খালি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনোটায় যাত্রী। আর আছে কিছু মলিন মানুষ। বেশভূষাই বলে দিচ্ছে, এরা দিন এনে দিন খাওয়া গোত্রের।
তামাটে শরীরের এই মুখগুলো তিন-চারজনের দলে দলে হাঁটছে। হাঁটলে একসঙ্গে, কোথাও দাঁড়ালেও একসঙ্গেই দাঁড়াচ্ছে। সবার মুখে গেঞ্জি কাপড়ের মাস্ক। ময়লায় কুটকুট করছে। কারোটা নাক ঢেকে আছে। মুখ খোলা। কারোটা মুখ ঢেকেছে, নাক খোলা।আবার কারোটা উঠেছে কপালে। দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হলে নামিয়ে রাখছে গলাতেও। মাস্কের ঠিক ওপরে চোখগুলো উৎসুক। করোনার শহরে কী আর খুঁজতে বেরিয়েছে তারা? এই নির্জন শহরে কিছু তো হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়। জীবিকা ছাড়া। জীবিকা হারিয়ে নির্বিকার মুখগুলো হয়তো খাবারের খোঁজে নেমেছে।
কুকুরটা একপা-দুপা করে কাছে ভিড়ার চেষ্টা করতেই করপোরেশনের হলুদ এপ্রোন পরা লোকটা বেলচাটা তুলে শাসালো। কুকুরটাও বুঝলো। যতটা এগিয়েছিল, পিছিয়ে গেলো তারও বেশি। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে আবার ‘ঘেউ’ করে উঠলো।
‘আয়, আয় সামনে। দেখি তোর কত বল হইছে? শুয়ারের বাচ্চাগো লাইগা শান্তি নাই।’
লোকটা মাথা নিচু করে বলতে থাকে, ‘সব ছিড়ালি- বিড়ালি কইরা ফালায়। শইল্যে আর কতক্ষণ কুলায়!’
পেট পড়ে থাকা জন্তুটা এবার আর আশা দেখলো না। শুঁটকো পাছাটা হালকাচালে দোলাতে দোলাতে মৌচাকের দিকে হাঁটতে লাগলো। ঝুলে থাকা স্তনের বাঁটগুলো শুকোতে দেওয়া কাপড়ের মতো দুলছিল।
‘আপনে হেই লোক না?’ প্রশ্নটা শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি বেঁটে মতন একজন। গায়ে ছেড়াফাঁটা, রঙজলা শার্ট। পরনের লুঙ্গিটা হাঁটুর একটু নিচে। মুখে মাস্ক। রঙটা হয়তো হলদে ছিল। ময়লায় বিবর্ণ হয়ে গেছে। তার নিচ থেকে বেরিয়ে আছে থুতনির দাড়িগোছা। চোখ ঘুরিয়ে তিনি আমায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরোখ করছেন।
বললাম, ‘কোন লোক?’
‘আপনে তেরানের লোক না?’
‘নাতো, কীসের ত্রাণ?’
‘আপনে সকালে কমিশনারের লগে আছিলেন না?’
‘না, আপনার ভুল হচ্ছে। সকালে আমি এদিকে আসিনি।’
‘মিছা কতা কইতাছেন ক্যান?’ লোকটা গলায় কেমন কঠিন হয়ে গেল। তার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
‘আশ্চর্য, মিথ্যা বলবো কেন? আমি তো কিছুক্ষণ আগে এখানে এসেছি। এই হাসপাতালে। আমার এক আত্মীয়কে দেখতে। বাসায় ফিরবো তাই রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি।’
লোকটি এবার আরও চটে গেলেন। হাত তুলে ইশারা করে পথের ওপাশ থেকে আরও দুজনকে ডাকলেন। ‘ওই, এই যে হেয়। তরা কই খুঁজতাছোস?’
লোকটির ইশারায় রাস্তার ওপারে গলির মুখ থেকে দুজন নারী দৌড়ে আসতে লাগলেন। তাদের হাতে ব্যাগ। বাতাসে ব্যাগগুলো উড়ছে। আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে! এই লোকটা আবার তাদেরইবা ডাকতে গেলেন কেন? বুঝলাম নিশ্চয়ই কোনো একটা ভুল বোঝাবোঝি হচ্ছে। আমার সঙ্গে তো তার আগে কখনো দেখাই হয়নি! না, এখানে দাঁড়িয়ে থাক ঠিক হবে না। যতদ্রুত সম্ভব কেটে পড়াই ভালো। ‘আরে ওই মিয়া, কই যান?’ লোকটি বলে উঠলেন, ‘দাঁড়ান কইতাছি। ওই তরা ধর, ব্যাটায় তো পলাইতাছে।’
আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিতেই তারা দৌড়ে পথ আগলে দাঁড়ালেন। তিনজনই আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘চাইল কই? সারাদিন দাঁড়া করায়ে রাইখা এখন ভাগতাছস ক্যান, ওই ব্যাটা?’ তাদের মধ্যে কমবয়সী মেয়েটি বলে উঠলো। তার কোমরে ওড়নাটা প্যাঁচ দিয়ে বাঁধা। রঙজ¦লা ফ্যাকাসে সালোয়ার-কামিজ পরনে। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে মেয়েটি। কিন্তু বয়সের তুলনায় শরীরে রুক্ষতা বেশি।
চুলগুলো রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। চামড়ায় ক্ষরক্ষরে ভাব। তার চেয়েও ভয়াবহ তার চোখ। লাল টকটকে। সেও মাস্ক পড়েছে। তবে তা কেবল নাকের ছিদ্রগুলো ঢেকে রেখেছে।
‘ওই ব্যাটা চাইয়া আছস ক্যান? কথা কানে যায় না?’ মেয়েটি ফের বলল।
‘কী বলছেন এসব? আমি কেন আপনাদের দাঁড় করিয়ে রাখতে যাবো? বললাম তো, আপনাদের ভুল হচ্ছে। আপনারা যাকে ভাবছেন আমি সে নই।’
‘তাইলে তুমি কেডা?’ মাঝবয়সী নারীটি এবার মুখ খুললেন, ‘তুমি কমিশনারের লোক না?’
এবার পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষটিও তাল মিলালো, ‘আরে হেই তো। আমি কি ভুল দেহি নাকি? এখন অস্বীকার যাইতাছে।’
‘কী মুশকিল, কীসের অস্বীকার? আচ্ছা ব্যাপারটা কি বলুন তো?’ জানতে চাইলাম তাদের কাছে। এবার কম বয়সী মেয়েটি হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁটের নিচে জমে থাকা ঘাম মুছে বলল, ‘আপনে নাকি সকাল থাইকা আব্বারে এইখানে দাঁড়া করায়ে রাখছেন, চাইল দিবেন কইয়া? চাইল কই? মাইনসের লগে মিছা কতা কন ক্যা?’
এবার আমি নিশ্চিত হলাম কোথাও তাদের ভুল হচ্ছে। বললাম, ‘কীসের চাল বলবেন?’
‘কীসের চাইল বুঝেন না? ভাত রান্দনের চাইল। ব্যাটা আবাল। কীসের চাইল হেইডাও বোঝে না।’ এবার বয়স্ক নারীটি মেয়েটিকে মৃদু ধমকের সুরে বললেন, ‘খাড়া গাইল দিছ না। আগে কউক হেয় মিছা কথা কইলো ক্যান? সেই সকালে নাকি কইয়া গেছে! এহন বেলা চাইট্টা।’
বললাম, ‘দেখুন আমি কাউকে চাল দেওয়া কথা বলিনি। তাছাড়া আমি তো এখানকার কেউ নই। হয়তো যে লোকটি আপনাদের বলে গিয়েছিলেন, তার সঙ্গে আপনারা আমায় মিলিয়ে ফেলছেন। ভুল হচ্ছে।’
‘কীয়ের ভুল হইতাছে। এই রকম কালা মাকশ পইরাই তো আছিল। আমি কি ভুল দেখছি? চশমাও আছিল চোখে।’ লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাতে নাচাতে বললেন।
‘আরে এই শহরে তো কত লোকই চশমা পরেন। হয়তো আপনি যার কথা বলছেন তার চোখেও চশমা ছিল। আর মাস্ক পরে থাকায় হয়তো আপনি তার চেহারাই দেখতে পাননি। মাস্ক পড়লে তো সবাইকে একই রকম লাগে।’ তাদের বুঝিয়ে বললাম।
কিন্তু লোকটি বুঝতে নারাজ। সে এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘আরে রাহেন। আপনেগো আমার চেনা আছে। পায়ে পায়ে মিছা কতা কন। আপনেরে কইলাম দশদিন হইতাছে রিকশা চালাই না। চাইল-ডাইল যা আছিল সব শেষ। ঘরে বুড়া একটা মা
আছে। তিনটা পোলাপাইন। কারো পেটে দানাপানি নাই তিনদিন। উয়াস থাকতাছে। এককেজি চাইল দেন রাইন্দা খাই। আপনে কইলেন, দাঁড়ান এইহানে, চাইল লইয়্যা আহি। তারপর আর খবর নাই। আঙ্গোর মতো গরিবের লগে মিছা কতা ক্যান কন? মিছা
আশা দেন ক্যান?’
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। বুঝতে পারছিলাম কেউ হয়তো কথা দিয়ে গেছেন। লোকটা হয়তো তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। অথচ সে আসেনি।
এবার মেয়েটি লোকটার হাত ধরে টানতে টানতে বলল, ‘আব্বা আয়েন যাইগা। হেরা গরিব মাইনসের কান্দন বোঝে না। হেগো দিলে পাত্তর। কাইন্দা লাভ নাই। লন বাসায় যাই। আল্লা একজন আছে। হের কাছে বিচার দেন।’
লোকটি অমত করলেন না। চোখ মুছতে মুছতে মেয়েটির পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন। তার পেছনে বয়স্ক নারীও হাঁটছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। মানিব্যাগটা বের করে হাতে নিলাম। দরকারি কাগজগুলোর ফাঁকে একটি
পঞ্চাশ, তিনটি দশ ও একটি কুড়ি টাকার নোট ভাজ হয়ে আছে। একবার ম্যানিব্যাগের দিকে, আর একবার তাদের তিনজনের দিকে তাকাতে লাগলাম। এই মুহূর্তে নিজেকে আমার গাছ বলে মনে হচ্ছে।
শতবর্ষী বটগাছ। শিকড়গুলো বড্ড শক্ত হয়ে ঢুকে গেছে মাটির গভীরে। নড়তে পারছি না। একদম না। এত লম্বা শিকড় চাইলেই উপরে ফেলা যায় না।